ভেতর থেকে পরিবর্তন চাই

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

সব রাজনৈতিক নেতারাই তারস্বরে গণতন্ত্রের সুনাম করেন৷ রাজতন্ত্র, অভিজাত–তন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব নয়– এমন বোধ করি একজনও নেতা বা নেত্রী পাওয়া যাবে না৷ তবুও এ প্রশ্ণটা অত্যন্ত সঙ্গত যে– গণতন্ত্রকে কেউ কি মানে?

গণতন্ত্র মানে তো জনগণ, কারও চাপে নয়, স্বাধীন ভাবে বিচার–বিবেচনা করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে৷ আর সেই জনপ্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করবে৷ তবে তাকে বলা হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের জন্যে–জনগণের সরকার৷ একেই বলে গণতন্ত্র৷

জনমতকে তাদের পক্ষে রাখার জন্যে বিভিন্ন পার্টি তাদের নীতি জনগণকে বোঝাবে, অন্যান্য পার্টির নীতির চেয়ে তাদের নীতি ও কার্যক্রম যে সর্বোৎকৃষ্ট– তা প্রতিটি পার্টি প্রচারপত্র, ফেষ্টুন, মিটিং প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে বোঝাবে৷ তারপর জনগণ তাদের পছন্দ মত প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে৷ এটাই তো গণতন্ত্রের নীতি৷

কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে, পার্টির নেতা–নেত্রীদের বক্তব্যে নিজ নীতি ব্যাখ্যার চেয়ে অন্যকে গালাগালি বেশী করে থাকে৷ এমনকি ভদ্র সমাজে কহতব্য নয়–এমন ভাষাও ব্যবহার করা হয়৷ প্রতিপক্ষকে হুমকী দেওয়া হয়৷ ঘরে ঘরে গিয়ে পার্টির ক্যাডাররা নিরীহ জনগণকে নানান, প্রলোভন দেখান, হুমকীও দিতে দ্বিধাবোধ করেন না৷ প্রতিপক্ষদের ওপর হামলা, মারধোর, খুন, জখম করে’ একটা সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যাতে করে জনগণ প্রতিপক্ষকে ভোট দিতে সাহস না করে৷ সর্বত্রই নেতানেত্রীরা সব জেনেও এই জিনিসটাকে প্রশ্রয় দেন৷

এ থেকে তো সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায়, আসলে নেতা–নেত্রীরা মুখে গণতন্ত্রের জয়গান গাইলেও গণতন্ত্রের ওপর এদের কারোর আস্থা নেই৷ এদের আস্থা ‘ জোর যার মুলুম তার’–এই নীতির ওপর৷ অর্থাৎ বলা বাহুল্য বাহুৰল, অর্থৰলের ওপরেই এদের আস্থা–গণতন্ত্রের ওপর নয়৷ আজকের সমাজে বৈশ্যযুগ চলছে৷ অর্থাৎ দুনিয়াটা কার বশ? আজকের পরিস্থিতিতে এর উত্তর, দুনিয়া টাকার বশ৷ তাই যাদের হাতে টাকা আছে, অর্থাৎ পুঁজিপতিরা এই সুযোগ গ্রহণ করে’ টাকার বস্তা নিয়ে বসে থাকে৷ যে পার্টি তাদের কারবারে সাহায্য করবে–তাদের তারা দরকার মত টাকার বস্তা সরবরাহ করবে৷ যে টাকা নিয়ে গুণ্ডা পোষাও যাবে ও টাকা ছড়িয়ে ভোটও কেনা যাবে৷

আশা করি, উদাহরণ দিয়ে এটাকে বোঝাতে হবে না৷ একটু চোখ–কাণ খোলা রাখলে ও ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখলেই এটা সহজে হূদয়ঙ্গম করা যাবে৷

তাহলে গণতন্ত্র কোথায় এসে দাঁড়াল? গুণ্ডাতন্ত্র হয়ে পুঁজিবাদতন্ত্রে৷ ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্রের পূজারী নামে যাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেই সর্বত্রই এই জিনিসটা দেখা যাবে৷ খুব বেশি আগে গিয়ে লাভ নেই৷ কেননা, আগের ব্যাপারে সবার অভিজ্ঞতা নেই৷ কিন্তু বামফ্রণ্টের ৩৪ বছরের অভিজ্ঞতা তো আজকের বেশির ভাগ মানুষের স্মৃতিপটে এখনও জ্বলজ্বল করছে৷ কংগ্রেসকে সরাসরি পুঁজিবাদের দালাল বলে’ যে সাচ্চা (?) কম্যুনিষ্টরা এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল, নিজেদের তারা প্রগতিশীল বলত, প্রকৃত জনগণের সরকার বলে নিজেদের দাবী করত, তারাই তো এরাজ্যে গণতন্ত্রের নামে চরম সন্ত্রাস আমদানী করেছে৷ প্রতি কথাতেই তারা ‘জনগণ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতান্ত্রিক’ মন্ত্র জপ করত৷ কিন্তু বাস্তবে তারা গুণ্ডাতন্ত্র বা হার্মাদতন্ত্রই কায়েম করেছিল৷ বর্ধমানের সাঁইবাড়ী হত্যাকাণ্ড, মরিচঝাঁপিতে বাঙালী গণহত্যা, বিজনসেতু সন্ন্যাসী হত্যা, আনন্দনগরের সন্ন্যাসী হত্যা, নেতাই, লালগড়, গড়বেতা, নন্দীগ্রাম–সর্বত্র গণহত্যার রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল৷ এ রাজ্যে গণতন্ত্রের মেশিনটাকে এমন বানিয়েছিল যে এসব করেও বার বার নির্বাচনে তারাই বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে জয়লাভ করত৷ জনগণকে কাঠের পুতুল হিসেব সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে হার্মাদরাই ভোটের বাক্স ভরে দিত৷ কারোর কিছু বলার ছিল না৷ বললেই বা কে মূল্য দিত? দীর্ঘ ৩৪ বছর পর জনগণের মধ্যে সৃষ্ট চরম ক্ষোভ ও মমতার মরণপন লড়াই শুধু নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে বুথে বুথে হার্মাদ বাহিনীর পৈশাচিক নৃত্য বন্ধ করতে যখন কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিল, তখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হ’ল৷ কমূ্যনিষ্টরা যে ভেবেছিল, তাদের রাজত্বে সূর্য ডুববে না৷ কিন্তু সূর্য শেষ পর্যন্ত ডুবল৷

তারপর এল পরিবর্তনপন্থী মমতা সরকার৷ মমতার ওপর রাজ্যবাসীর অনেক আশা ছিল৷ কিন্তু দেখা গেল, বামরাজত্বে যারা গ্রামে গ্রামে হার্মাদগিরি করত তারা কোন্ ফাঁকে পরিবর্তিত সরকারেও ভীড়ে গেছে৷ ফলে রাজ্যবাসী এখন চিন্তিত৷

তাহলে পথ কী? মানুষ না পরিবর্তন হলে একই মানুষগুলোই তো দেখা যায় কংগ্রেস থেকে সিপিএমে, সিপিএম থেকে তৃণমূলে, আবার তারাই ভীড় জমাচ্ছে নতুন মাথা তোলা বিজেপিতে৷ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির তো একই দশা সেই পুরাতন পানীয় নতুন বোতলে৷  এতে কোন কাজ হবে না৷ চাই নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষ, চাই নতুন নীতি, নতুন পরিকল্পনা৷ কেবল ওপরে–ওপরে পরিবর্তনে লাভ হবে না৷ ভেতর থেকে পরিবর্তন চাই৷