“ভ্রমতি মস্তকে”

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

মনে পড়ে গেল একটা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ আখ্যায়িকা৷ গ্রামের নাম কুড়িয়ে–খাওয়া৷ সেখানকার সুপ্রসিদ্ধ মানুষ ছিলেন শ্রীযুক্ত বাবু কিপ্ঢেকঞ্জুস কর৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস বৈধ অবৈধ নানান ভাবে টাকা রোজগার করত৷ সে ভেবে দেখলে, হঠাৎ–বড়লোক হতে গেলে শিব ঠাকুরের কাছ থেকে বরদান নিতে হবে৷ অন্য দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্যে কঠোর তপস্যার প্রয়োজন৷ কিন্তু শিব তো ভোলানাথ .....আশুতোষ৷ একটা আকন্দ ফুল আর কয়েকটা বেলপাতা দিলেই সন্তুষ্ট হয়ে যান৷ তাই তাঁকেই ডাকি৷

কিপ্ঢেকঞ্জুসের জানা ছিল শিবের দয়ার শরীর৷ দানব–রাক্ষসেরা শিবের কাছ থেকে বর দান পেত৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস শিবের তপস্যায় বসে গেল৷ অল্প দিনের তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ বললেন–‘‘চোখ খুলে চা বেটা, আমি এসেছি৷’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘এসেছো যখন ঠাকুর, আমার মনস্কামনা পূর্ণ করো৷’’

শিব বললেন–‘‘কী তোর মনস্কামনা? তুই আমাকে চাস, না আমার কাছ থেকে আর কিছু চাস?’’

তখন কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘তুমি তো ছাইমাখা ভিখিরি৷ তোমাকে নিয়ে আমার লাভ কী তুমি আমার বোঝা হয়ে দাঁড়াবে৷ তুমি বরং আমাকে বর দান করো যাতে দু’পয়সার মুখ দেখতে পাই৷’’

শিব বললেন–‘‘এই মাত্র বললি, আমি ছাইমাখা ভিখিরি৷ আবার আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা চাইছিস কোন যুক্তিতে?’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘তুমি যে ছাইমাখা ভিখিরি একথা তো  ঠিকই ৷ কিন্তু দুপুরবেলায় হক্ষিষ্যি করার পর ধনৈশ্বর্যের দেবতা কুবের এসে তোমাকে ম্যাসাজ (হাত–পা টিপে দেওয়া) করে দিয়ে যায়৷ ম্যাসাজ করতে করতে কুবের যখন তোমাকে বলবে–‘ঠাকুর, এবার ডানপাশ ফিরে শোও, সেই ফাঁকতালে তুমি বলে দিও, কুবের কিপ্ঢেকঞ্জুসের দিকে মুখ তুলে চা৷ ওকে কিছু পাইয়ে দে৷’’

শিবঠাকুর বললেন–কুবের যদি আমার কথা না রাখে......

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘ত্রিভুবনে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে তোমার কথা ঠেলতে পারে৷ কুবের তোমার কথা শুনবেই শুনবে৷’’

শিব বললেন–‘‘আমি কুবেরকে বলে দোব৷ আর কুবের যা বলবে তোকে জানাব৷’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘ঠাকুর বেশ কিছুদিন ধরে তপস্যা করে আজ তোমার ইন্টারভিউ পেয়েছি৷ আবার দ্বিতীয়বার ইন্টারভিউ পেতে গেলে অনেকদিন তপস্যা করতে হবে৷ এদিকে আমাদের দোকানের কেনাবেচা লাটে উঠতে বসেছে৷ কুবেরের কী উত্তর হবে তা অনুমান করে নিয়ে তুমি আগাম বলে দাও আমাকে কী করতে হবে৷’’

শিব বললেন–‘‘আহাহা বেচারা বারবার কেনই বা আমার জন্যে তপস্যা করবে আহাহা বেচারা ......... মোহগ্রস্ত বেচারা’’

শিব কিপ্ঢেকঞ্জুসকে বললেন–‘‘ওই যে দিগন্তবিস্তৃত অরণ্যানী*১ তুই নাকের সোজা ওর ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলতে থাক৷ কথাটা আমি কুবেরকে জানাব৷ সে দরকারমত ব্যবস্থা করবে৷’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলল..........এগিয়ে চলল তার অশেষ গতিতে৷ গাছপালা সে দেখছে না...........গাছপালা নিয়ে গবেষণা করতে সে আসেনি৷ পশুপক্ষীর জীবন–চর্যার দিকেও সে তাকাচ্ছে না কারণ তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তার নেই৷ সে কি শিবঠাকুরের কথা ভাবছে? না না না শিবঠাকুর তখন তার কাছে পর্দার আড়ালে সরে যাওয়া জিনিস৷ সেকি কুবেরের কথা ভাবছে?–না, তাও নয়৷ সে ভাবছে কুবেরের ধন–সম্পদের কথা৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলেছে৷ তার বাঘের ভয় নেই......সাপের ভয় নেই........জল থেকে উঠে–আসা কুমীরের ভয় নেই৷ ধনসম্পদের মোহে সে আচ্ছন্ন৷ মোহের চশমায় তার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে গেছে৷ কে কী বলবে, কে কী ভাববে, তা ভাবার অবসর তার নেই৷ সে চলেছে......সে চলেছে.........অর্থগৃধ্ণুতার চরমত্বের দিকে৷ হঠাৎ কী যেন একটা দেখে কিপ্ঢেকঞ্জুস থমকে দাঁড়াল৷ সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না.....সামনে কড়ির*২  পাহাড়..........ডাইনে কড়ির পর্বত........ বাঁয়ে কড়ির টিলা........পেছনে কড়ির ঢিবি৷ সে জয় ঘোষণা করলে কিন্তু কার জয়? শিবের জয় নয়......কুবেরের জয়  নয়......কড়ির জয় পরক্ষণেই সে ভাবলে–কড়ির আর দাম কতটুকু সঙ্গে তো তার রয়েছে ছটা পকেট–কোটের চারটে পকেট আর প্যান্টের দুটো পকেট, ছটা পকেট–ভরতি কড়ি নিলেও তার দাম এমন কিছু হবে না৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস কড়িকে খারিজ করে এগিয়ে চলল৷    (ক্রমশঃ)

*১ ক্ষৃহৎ অরণ্য এই অর্থে অরণ্যানী৷ ক্ষৃহৎ হিম অর্থাৎ অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হিম এই অর্থে হিমানী৷ কিন্তু ক্ষৃহৎ যবন এই অর্থে ‘যবনানী’ নয়, ‘যবনানী’ মানে যবনের লিপি বা লেখা৷ ‘অরণ্যানী’ শব্দ শুদ্ধ হলেও ‘বনানী’ শব্দ শুদ্ধ নয়৷

*২ কড়ির জন্যে সংস্কৃতে অনেকগুলি শব্দ থাকলেও কটিকা ও ক্কথিকা–এই দুটো শব্দই বেশী প্রচলিত৷ প্রাচীনকালে হাটেবাজারে লেনদেনে কড়িই বেশী চলত৷ তাম্রমূদ্রা অচল ছিল না৷ তবে বাজার–চালু তাম্রমুদ্রার সংখ্যা বা পরিমাণ ছিল কম৷ কড়ি তৈরীর জন্য টংকশালার (টাঁকশালার) দরকার পড়ে না৷ তাই লেনদেনে ছিল তারই অবাধ ব্যবহার৷ খুব বেশী দামী জিনিসের লেনদেনে টংকক (টাকা) বা রৌপ্যকম্ (রূপেয়া) ব্যবহার করা হত৷ এই টংকক বা রৌপ্যকমের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না৷ এমনকি সাধারণ মানুষ অনেক সময় কড়ির ব্যবহার না করে অদলবদল প্রথায় কাজ চালাত৷ এই ‘অদলবদল’ শব্দটি আমাদের ছোটবেলায় রােে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হত৷ ছোটবেলাতে তাই দেখেছি এক কুনকে চালের বিনিময়ে শাক–মাছ–তরীতরকা নানান জিনিস কেনা চলত৷ বীরভূমের খয়রাসোল থানায় দেখেছি ছুতোর কাঠের পিলশুজ তৈরী করে হাটে বসে চালের বিনিময়ে তা বেচছে৷ আধুনিক যুগের বার্টার ব্যবসায় প্রথাও কতকটা এই ধরনের৷

তা যাই হোক রূপোর টাকার ব্যবহার খুবই অল্পই ছিল৷ মুদ্রা মানে সোনাই চলত৷ কিন্তু বাজারে সাধারণ লেনদেনে সোণা বা স্বর্ণমুদ্রার (সীনক) ব্যবহার ছিল না৷ সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে তাই কড়ি অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকত৷ আগেকার দিনে মেয়েরা যে লক্ষ্মীপুজো করতেন তাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে অবশ্যই কড়ি থাকত৷ আমাদের ছোটবেলায় কোলকাতায় দেখতুম বিয়েতে বরণের সময় বরকে বলা হত ঃ

‘‘কড়ি দিয়ে কিনলুম, দড়ি দিয়ে বাঁধলুম,

হাতে দিলুম মাকু একবার ভ্যা কর তো বাপু৷’’

জানি না কোনো কোনো বোকা বর সত্যিসত্যিই ভ্যা করত কিনা৷ এখনও আমরা ব্যবহারের ভাষায় টাকাকড়ি, পয়সাকড়ি, মাইনেকড়ি বলে থাকি, যদিও কড়ি বড় একটা চোখে দেখি না৷

যেসব মায়েদের মৃতবৎসা রোগ ছিল তারা সন্তান যাতে না মরে সেইজন্যে ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে ধাইকে (দাই–midwife, সংস্কৃতে ‘ধাত্রী’) দান করত৷ তারপর যেন অন্যের ছেলেকে কিনছে এই রকম ভান করে সেই ধাইয়ের কাছ থেকে একটা কড়ি, তিনটে কড়ি, পাঁচটা কড়ি, সাতটা কড়ি বা ন’টা কড়ি দিয়ে কিনে নিত৷ আর সন্তানেরও নাম ঠিক তেমনি রাখা হত৷ সেকালে কড়ি নিয়ে বেচাকেনা চলত বলেই ছাত্রদের অঙ্ক শিখবার সময় কড়াক্রান্তি শিখতে হত৷