চাই ‘আমরা বাঙালী’ ভাবাবেগ

লেখক
আনন্দমোহন দেব

 

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

বাংলায়-শোষনের যুগ শুরু হয়েছে মোগল সম্রাট আকবরের যুগ থেকে৷ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষনের ফলে বাঙলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল৷ বাংলার বার ভুঁইয়ারা মোগল সম্রাট বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেছিলেন৷ তারপর বাঙলায় আসে ব্রিটিশদের ঔপনিবেসিক-শোষণ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ৷ এই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ও প্রাণ বলিদান করেছে বাঙলার বিপ্লবী ও সংগ্রামীরা আর তা করেছে ভারতের সকল জাতির মুক্তির জন্য৷ কিন্তু এই স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বেশী শোষিত হচ্ছে বাঙালী,আর বাঙালীর শরণার্থী হয়ে গৃহহীন হয়ে  জীবন কাটাচ্ছে৷ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বাংলা ভাষা আজ স্বাধীন ভারতে নানাভাবে অবদমিত ও উপেক্ষিত হয়ে চলেছে৷ স্বাধীনতা লাভের প্রথম পর্বে ক্ষুদ্র পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে  সবচেয়ে বেশী অগ্রসর রাজ্য৷ পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক আয় ছিল অন্যান্য রাজ্যের আয় অপেক্ষা বেশী৷ বাঙালী শিল্পপতি পশ্চিবঙ্গের অর্থনীতিতে বিরাজ করত৷ কিন্তু জাতীয়তাবাদের সুবাদে অর্থাৎ এক জাতি-এক দেশের নামে বহিরাগতরা বাংলায় এসে বাঙলার শিল্পপতিদের উৎখাত করেছে আর বাংলার সম্পদ থেকে  বহিরাগত পুঁজিপতিরা কোটি কোটি টাকা যেমন মুনাফা লাভ করছে তেমনি কেন্দ্র বা দিল্লী সরকার বাংলার সম্পদ থেকে রয়্যালটি ও ট্যাক্স বাবদ কোটি কোটি টাকা আয়  করছে৷ আর বাংলাকে কেন্দ্রীয় অনুদানের ক্ষেত্রে নানাভাবে বঞ্চনা করে চলেছে৷ বাঙলার সম্পদে, কেন্দ্রেরও অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা উপকৃত হচ্ছে৷ আজ বাংলা অন্যান্য প্রদেশগুলি থেকে শিক্ষায় ও মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রদেশগুলির থেকে অনেক অনেক  নীচের স্থানের হয়ে গেছে৷

এখানে উল্লেখযোগ্য যে মানুষের সাধারণত মাটি কেন্দ্র করে এক ধরণের আকর্ষণ তৈরী হয় যাকে বলা হয় ভৌম-ভাবাবেগ (geo Sentiment)৷ যা নিজ নিজভূমির  কল্যাণচিন্তা করা অন্যভূমির মানুষের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করা যেমন গ্রামকেন্দ্রিক ভাবাবেগ৷ আবার বিশেষ জনগোষ্ঠীর গত ভাবাবেগ যা বিশেষ জনগোষ্ঠীর  মাত্রেরই কল্যাণ চিন্তা করা একে বলা হয় সামাজিক ভাবাবেগ (Socio Sentiment) যা অন্যগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করে৷ যেমন গোষ্ঠী ট্রাইব - জাত, কুল, সম্প্রদায়,জাতীয়তাবাদ, আন্তজাতীয়তাবাদ ইত্যাদি৷ এই ভৌমভাবাবেগ বা উগ্র সামাজিক ভাবাবেগ গুলি পৃথিবীতে অনেক রক্তপাত ঘটিয়েছে ও ভবিষ্যতে ঘটাবে৷ যেমন গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীদ্বন্দ দেখে মানুষ গোষ্ঠীগত দ্বন্দ দূর করবার জন্য রাজ্য শাসন পদ্ধতি শুরু করল আর রাজ্যে রাজ্যে দ্বন্দ করবার জন্য তৈরী হলো সাম্রাজ্য বা জাতীয়তাবাদ৷ আবার-এক জাতীয়তাবাদীর সঙ্গে অন্য জাতীয়তাবাদীদের সংগ্রামের সম্ভাবনা সৃষ্টি হল৷ তেমনি সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘাত হতে লাগল, রক্তপাত হতে থাকল৷ এসব দেখে কিছু কিছু চিন্তাবিদ নিদান দিলেন মানবতাবাদ৷ কিন্তু মহান দার্শনিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বললেন গাছ-পালা, জীবজন্তুকে  বাদ দিয়ে কেবল মানুষের  জন্যে চিন্তা করা হলো ভূয়া মানবতাবাদ বা মেকী মানবতাবাদ অর্থাৎ মানবতাবাদ নয়৷ কারণ গাছপালা-জন্তু-জানোয়ারা মানুষের দ্বারা নির্মমভাবে ধবংস হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে মানুষজাতিও রক্ষা পাবে না৷ তাই তিনি বললেন মানুষ কেবল মানুষের রক্ষার কথা ভাবলে চলবে না তাকে গাছপালা জীবজন্তু, এমনকি অজৈব সত্তার রক্ষা করতে হবে যাতে  সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে৷ তবেই মানুষজাতিও রক্ষা পাবে৷ এইটাকে তিনি নাম দিয়েছেন নব্যমানবতাবাদ৷ তাই মানবজীবনে সর্র্বেচ্চ ভাবধারা হলো বিশ্বৈকতাবাদের সংগে নব্যমানবতাবাদী ভাবধারা৷

এখন যারা গোষ্ঠী বা ট্রাইপ ভাবধারা নিয়ে চলে তাদের থেকে উচ্চ ভাবধারা হলো মানবতাবাদী ভাবধারা৷ মানবতাবাদীরা গোষ্ঠী বা টাইব  ভাবধারা লোকদের নিন্দা  করবে তাদের ক্ষুদ্ধ ভাবধারা নিয়ে চলার জন্যে৷ তাই যে মানুষ উন্নত ভাবধারায় প্রেষিত হয় সে অন্যের কাছে প্রশংসিত হয়৷ কিন্তু ওই উন্নত ভাবধারাগুলিরও খারাপ দিকও আছে৷ উন্নত ভাবধারার ফলে রক্তপাত হয়ত বন্ধ হয়, কিন্তু উন্নত ভাবধারায় নাম ভাঙিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ অন্যশ্রেণীর লোককে নির্মমভাবে শোষণ করে৷  যেমন মানবতার নাম নিয়ে চালাকচতুর মানুষ অন্য জায়গার মানুষেরা শিক্ষায় দীক্ষায় পেছিয়ে আছে বলে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়ে মানবতাবাদী বলে সুখ্যাতি অর্জন করে৷ আর সব জায়গার কাঁচামাল অর্থাৎ সম্পদ নিজের রাজ্যে যা দেশে নিয়ে আসে৷ তার থেকে  প্রভূত লাভ করে৷ তেমনি গোষ্ঠী গোষ্ঠী দ্বন্দ দূর করার জন্য রাজা তৈরী হলে গোষ্ঠী গত দ্বন্দ্ব হয়ত  কমে গেল কিন্তু যে গোষ্ঠীর  মানুষ শাসক হলো সে গোষ্ঠীর মানুষেরা অন্যগোষ্ঠীকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে শোষণযন্ত্র সচল রাখবে৷ বা ওই গোষ্ঠীদের মধ্যে শক্তিশালী গোষ্ঠী দুর্বল গোষ্ঠীকে অবাধে শোষণ করার সুযোগ পাবে যে তারা একই রাজ্যের মানুষ এই সুবাদে৷ গোষ্ঠী, রাজ্য বা প্রাদেশিকতার থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে উন্নত ভাবধারা৷ কিন্তু জাতীয়তাবাদের নামে দেশের-ক্ষমতায় আসীন বা আর্থিক দিক দিয়ে উন্নত গোষ্ঠীরা সহজে অন্যপ্রদেশে বা রাজ্যে সম্পদ আহরণ করার সুযোগ পায় ও অন্যরাজ্যের সম্পদকে কুক্ষিগত করে লাভবান হয়৷ এই হলো উন্নত ভাবধারাগুলির প্রভাব৷ জাতীয়তাবাদের নাম নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী বা তাদের পরিচিত পুঁজিপতিরা বা অন্যপ্রদেশের লোকেরা স্বাধীনতার পরে এ বাঙলায় এসে বাঙলাকে নির্মমভাবে আর্থিক ও সংসৃকতি শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে৷ বাঙলার মানুষ ও বাঙলার নেতৃস্থানীয় বা জাতীয়তাবাদের নামে এই শোষণের প্রতিকার করার ব্যাপারে চুপ থেকে গেছে৷ কারণ এব্যাপারে মুখ খুললে জাতীয়তার বিরোধী করা হবে, সংকীর্ণভাব ধারার মানুষ বলে পরিচিত হবে৷