দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা ও কেন্দ্রের প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ও ৭১ বছরেরর দুর্বল শাসনে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস

লেখক
প্রভাত খাঁ

আমরা অখন্ড ভারতবর্ষকে খন্ড খন্ড করে  রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাই ১৯৪৭ সালের  ১৫ই আগষ্ট৷ ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারীর দিনটিকে আমরা সাধারণতন্ত্র  দিবস হিসেবে ঘোষণা করি৷

তাই আজ  ৭১ বছর  হলো  আমরা গণতান্ত্রিক  রাষ্ট্রে বাস করছি৷ পা পা করে  অনেক বছর হলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ  স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে  পাশাপাশি  রয়েছে৷ স্মরণে থাকে  যে পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ  পূর্ব বাংলাই বাংলাদেশ হয়  পরবর্ত্তীকালে  বাংলাভাষা আন্দোলনের  মাধ্যমে৷

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সারা পৃথিবীতে এমন এক রাজনৈতিক  অস্থিরতার সৃষ্টি  হয় যা ভয়ঙ্কর৷  সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আগ্রাসীনীতির কারণে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে৷ এই বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে ১৯৩৯ সালের  মাঝামাঝি  আর শেষ হয় ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি হিরোসিমা নাগাসাকিতে এ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে৷ এই সর্বনাশা বিশ্বযুদ্ধে সারা বিশ্ব বিধবস্ত হয়৷ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও বিধবস্ত হয় ও বিশ্বের  বুকে ভয়ংকর  ক্ষয়ক্ষতি হয়৷  এর দরুণ পৃথিবীতে যে উপনিবেশবাদের  ভয়ংঙ্কর শোষণ চলছিল সেটার অন্তিম দশা নেমে আসে৷

বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড  অত্যধিকভাবে  আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে৷ ভারতে  সহিংস ও অহিংস আন্দোলনে  ইংরেজ  সরকার অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ তাই তারা ভারতবর্ষকে  চিরকালের  মত সাম্প্রদায়িক শক্তি  পাকিস্তানের  দ্বারা আক্রান্ত  হয়ে যাতে এদেশের আর্থিক তথা সামাজিক উন্নতি না হতে পারে সেইভাবে টুকরো  টুকরো করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে যায়৷  জওহরলাল হন প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি দেশ ভাগে সম্মতিপ্রদান ও স্বাক্ষর দান করেন৷ যেহেতু জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর দল কংগ্রেস এই সর্বনাশা স্বাক্ষর করে স্বাধীনতা আনয়ন করেন তাই তাঁর দল ব্যাপকভাবে প্রচার করে কংগ্রেস স্বাধীনতা এনেছে৷ এই স্বাধীনতা হলো ইংরেজের চক্রান্ত৷ চিরকালের মতো এই বিশাল ভূখন্ডকে পঙ্গু করে দেওয়ার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র৷ তাই এই দেশকে কয়েকবার পাকিস্তান আক্রমণ করে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি করে দিয়েছে৷ এদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশু ও জোয়ানদের  আমরা হারাতে  বাধ্য হয়েছি৷  আজ পাকিস্তান সীমান্তে  অনুপ্রবেশ  ঘটিয়ে ভারতীয়দের ও সীমান্তের ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে হত্যা করে চলেছে৷ অবৈধভাবে ভারতের অনুপ্রবেশ  ঘটিয়ে৷

জহওরলাল নেহেরু হলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি  ১৯৪৭ সাল থেকে  ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত শাসন চালান৷ তারপর কিছুদিন  প্রধানমন্ত্রী হন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী৷ পাকিস্তান যুদ্ধে আহ্বান  করে  ভারতকে৷ জয় কিষাণ  ও জয় জোয়ান  ‘‘শ্লোগান দিয়ে  দেশকে উজ্জীবিত  করেন ৷  ১৯৬৬-তে ইন্দিরাগান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে শাস্ত্রীর পর দেশ শাসনে হাত দেন৷

১৯৬৯ সালে ইন্দিরা জগজীবন  রামকে সভাপতি করে নিজের পৃথক কংগ্রেস দল গড়েন৷ কংগ্রেস দলে ভাঙ্গন ধরে৷ ১৯৭৫ সালে তিনি ২৫শে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন৷ ৫ই আগষ্ট ২৩টি  সংঘটনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷  ১৯৭৬ সালের ৯ই জানুয়ারী দেশবাসীর মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রপতির আদেশে  স্থগিত হয়৷ মোদ্দাকথা ভারতের  গণতন্ত্রকে ধবংস  করে দেওয়া হয়৷ ১৯৭৭ সালের, ২১শে মার্চ জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার৷  নির্বাচনে  গান্ধী পরিবার  হেরে যায়৷  ২৪শে মার্চ ভারতে  প্রথম অকংগ্রেসীরা মিলিতভাবে জনতা পার্টি তৈরী করে ক্ষমতায় আসে৷ প্রধানমন্ত্রী হলেন মোরারজী দেশাই৷  এই সরকার  সিপিএমের  সঙ্গে  আঁতাত করে৷ অটল বিহারী বাজপেয়ী বিদেশমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জে হিন্দিতে ভাষণ দেন৷ কয়েকটন সোনা বাজারে সরকার  ছেড়ে দেন ৷ ১৫ই জুলাই মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন৷

১৭ জুলাই  জনতা ও কংগ্রেস (সংঘটন)-এর কোয়লিশনের  নেতা চরণ সিং প্রধানমন্ত্রী হলেন৷ আগষ্ট ২১, রাষ্ট্রপতি  সংসদ ভেঙ্গে দেন৷ ১৯৮০ জানুয়ারী  ১০, ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস (ই) লোকসভায় দুই -তৃতীয়াংশ গরষ্ঠতা নিয়ে শাসনে বসেন৷ ৬ এপ্রিল জনতা পার্টিতে ভাঙণ এল৷ আর এস এস এর সঙ্গে  সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী সদস্যরা অটল বিহারীকে সভাপতি করে ভারতীয় জনতা পার্টি  গড়ে তুললেন৷ ২৩শে জুন সঞ্জয় গান্ধী নয়াদিল্লীতে  বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন৷

১৯৮২ তে ৩০শে এপ্রিল গভীর চক্রান্তে কলকাতার বিজনসেতু ও বন্দেল গেটে আনন্দমার্গের  ১৭জন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী দিবালোকে নিহত হলেন৷ বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে কোন মন্তব্য করা হয় নি৷ তার সুবিচার ও হয়নি অদ্যাপি৷

১৯৮৪তে ৫ই জুন অপারেশন ব্লুষ্টার জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে সহ  ৩২৫ জন এর বেশী নিহত হন পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরের আশেপাশে৷ ৩১শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীর  বাসভবনে  নিরাপত্তারক্ষীর  গুলিতে নিহত হন৷ তারপর প্রধানমন্ত্রী হন রাজীব গান্ধী৷ ১৯৮৯ সালে ২২শে নভেম্বর নবম লোকসভা নির্বাচনের জন্যে বোট গ্রহণ শুরু হয়৷ ২রা ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে জনতা দল নেতা ভিপি সিংয়ের শপথ গ্রহণ৷ ১৯৯০ এর ৭ই  নভেম্বর ভিপি সিং আস্থা বোটে  পদত্যাগ করেন৷  ১০ই নভেম্বর তরুণ  তুর্কী এস চন্দ্রশেখর  প্রধানমন্ত্রী  ও উপপ্রধানমন্ত্রী গান্ধী নিহত হন৷  ১৫ই জুন লোকসভা নির্বাচনে  কংগ্রেসের  নরসিংহ  রাও মন্ত্রীসভার  পথ নেন৷  ১৯৯৬ এর ২২শে মে  লোকসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হয়৷ ২৮শে মে  আস্থাবোটের  দেবেগৌড়ার নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার  শপথ  গ্রহণ হয়৷  পুনরায় ১৯৯৭ এর ১৯শে এপ্রিল কেন্দ্রের যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্র্বচিত  হলেন ইন্দ্রকুমার  গুজরাল৷

১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারী দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচন ঘোষিত  হয়৷ এই নির্বাচনে  বিজেপির  হয়ে অটল বিহারীর  বাজপেয়ী মন্ত্রীসভা ঘটন  করেন৷ ১৯শে মার্চ৷ ৩রা  নভেম্বর মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন৷  প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার  করেন৷

১৯৯৯ সালে এপ্রিলের ১৭ই বাজপেয়ীর সরকার  ১৩মাসের মাথায় একবোটের  ব্যবধানে  পরাজিত হন (২৬৯-২৭০)৷ নিবার্চন কমিশন সেপ্ঢেম্বর অক্টোবরে  অর্থাৎ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) দলের বিজেপি ১৩জোট সঙ্গী নিয়ে  এই দল  ঘোষণা করে৷ ২০০৪ সাল পর্যন্ত  এই সরকার  চলে৷  ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনে  কংগ্রেস অ্যালায়েন্স দল সোনিয়া গান্ধীর সভাপতিত্বে মনমোহন সিংকে  প্রধানমন্ত্রী করে শাসন চালান দিল্লির দখল করে  ২০০৯ এর নির্বাচনে৷ পরে  ২০০৯ নির্বাচনেও কংগ্রেস অ্যালায়েন্স দিল্লী দখল করে৷ ২০০৯  পর ২০১৪ নির্বাচনে বিজেপি অ্যালায়েন্স  মোদির  নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ট  হয়ে  দিল্লির শাসন  কায়েম  করেছে৷ বিজেপির অ্যালায়েন্সের সরকারের শাসনাধীনে দেশ চলছে৷ যে উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন হয় সেই উদ্দেশ্য কী সফল হয়েছে?  এটাই  আজ বড়ো প্রশ্ণ৷  ইংরেজ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে৷ আর সেই সাম্প্রদায়িকতাই  হলো দেশের সর্বনাশের কারণ৷ দেশ এগুতে পারে নি৷ দেখা গেল জাতীয় দলগুলি নেতাদের সংকীর্ণ মানসিকতার  দরুণ ধীরে ধীরে  টুকরো টুকরো হয়ে ছোট ছোট আঞ্চলিক দলে রূপ নেয়৷ সেই দলগুলোর অধিকাংশই  পরিবার কেন্দ্রীক হয়ে পড়ে৷  রাজনীতি থেকে  সেবা, ত্যাগ উঠে যায়৷ আর দলীয় রাজনীতিতে  আবির্ভূত হয় চরম দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা৷ দেখা গেল যে দল বা গোষ্ঠী শাসনে আসে তারাই হয় প্রথমশ্রেণী নাগরিক আর বিরোধীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চলে  এই গণতান্ত্রিক শাসনে৷ চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকার সমস্যায় দেশ কাতর৷ জীবনে  নিরাপত্তাহীনতার  সাধারণ মানুষ কাতর৷ এই হ’ল বর্ত্তমানের ভারত৷ বর্ত্তমানে  স্বার্থান্বেষীরা রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে  যোগ দিচ্ছে আর সৎ, দেশসেবক নীতিবাদীরা রাজনীতি থেকে  দূরে  সরে যাচ্ছে৷ সেই কারণে গণতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, দূর্নীতি পরায়ন ধান্দাবাজদের  স্বর্গরাজ্য! তাই দেশের  কল্যাণে  সৎ নীতিবাদী,  দেশসেবকদের এগিয়ে এসে গণতন্ত্র  সার্থক ভাবে গড়ে তুলতে  হবে৷ আর জনগণকে  সার্থকভাবে  বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দিতে হবে৷ তা না হলে মাৎস্যন্যায় আরও বাড়বে আর নিরাপত্তাহীনতায় দেশ অন্ধকারে ডুবে যাবে৷