যারা অনন্যমনসা–অনন্যভাক্ হয়ে পরমপুরুষের ভজনা করে, জাগতিক অন্যান্য চিন্তা–ভাবনাকে পরিত্যাগ করে মানসচিন্তায় সুকোমল মসৃণতা নিয়ে কেবল পরমপুরুষের দিকেই এগিয়ে যায় তারা গোপী৷ এই রকম ধরণের গোপীদের ছবি আঁকা যায় না৷ কারণ গোপীর গোপীত্ব তার অন্তরের সুকোমল ভাবরাজি, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত৷ এটা একেবারে ভেতরের জিনিস–মনের জিনিস৷ এই ধরণের ভক্তি ভাবসমন্বিত গোপীদের ভাষাও ব্যক্ত করা যায় না৷
এখন এই যে গোপীভাব–এটা জন্ম–জন্মান্তরের সাধনা৷ সুকৃতির ফলেও আসতে পারে৷ দীর্ঘদিনের সাধনা ও সুকৃতির ফলে অল্প পরিমাণ গোপীভাবের অধ্যারোপ করতে করতে কালক্রমে এই গোপীভাবের উন্নীত হতে পারে৷ আবার এমনও হতে পারে যে অল্প সময়ের ব্যবধানে এক–দুই ঘণ্ঢার মধ্যেও পরমপুরুষের প্রতি ঐকান্তিক অনুরুক্তি হেতু এই গোপীভাবের জাগরণ ঘটতে পারে৷ তাই গোপী হওয়া দীর্ঘকালের ব্যবধানেও হতে পারে, আবার অত্যল্প কালেও হতে পারে৷ গোপীভাব কখনো কালের শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়৷ যে মানুষের অন্তরের সম্যক মসৃণতা দিয়ে, সরলতা দিয়ে, গভীর মাধুর্যপূর্ণ মনোভাবের দ্বারা তার দিকে এগিয়ে যাবে সেই গোপী৷ গোপীত্বে এটাই হ’ল মূল ভাব বা মূল পরিচিতি৷
‘‘সম্যঙ্ মসৃণিতো শান্তো’’
এখন এইভাবে থেকেও কোন কোন সময় এমনও হয় যে মনটা কিছূটা যেন ক্ষণিকের জন্যে জাগতিকতার পানে ছুটতে চায়৷ ফলে গোপীমনের সরসতায় অল্প অল্প আবিলতা এসে পড়ে বৈকি৷ যেমন, কোন কোন দারিদ্র্যগ্রস্ত মানুষ ধনীর বিপুল ধনরাজি দেখে ভেবে বসে, ‘‘আমারও যদি ওই রকম ধন থাকত তাহলে আমি আরও বেশী মাত্রায় জনসেবা করতে পারতাম–পরমপুরুষের সেবা করতে পারতাম৷’’ কারও মধ্যে কিছুটা বাগ্মীতা রয়েছে,–সে ভেবে বসে, আমার মধ্যে যদি আরও বাগ্মীতাশক্তি থাকত, তাহলে আমিও অপূর্ব বাগ্মীতার দ্বারা ঈশ্বরের গুণগান করতে পারতাম৷ কেউ হয়ত মোটামুটি কাজ চালাবার মত পাণ্ডিত্যের অধিকারী৷ তার মনে এমনও ভাব জাগে, ‘‘আমার যদি আরও পাণ্ডিত্য থাকত তাহলে আরও অপূর্ব যুক্তিজালের দ্বারা পরমপুরুষের কথা আরও ভাল করে বলতে পারতাম৷’’ এই যে অধিকতর অর্থ–স্বাচ্ছন্দ্যের আকাঙক্ষা বাগ্মীতা বা পাণ্ডিত্যের আকাঙক্ষা–এতে তো ভক্তমনের মাধুর্য বা মসৃণতার ক্ষেত্রে আবিলতা বৈকি৷ হয়তো লক্ষ্যগত ত্রুটি এতে নেই, কিন্তু ভাবগত ত্রুটিতো অবশ্যই আছে৷ কারণ, পরমপুরুষ যাকে যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই দিয়েই সে সাধ্যমত কাজ করবে–সেটাইতো পরমপুরুষের অভীপ্সা৷
মানুষের কাকে কতটুকু সামর্থ্য দেওয়া উচিত সে তো পরমপুরুষই বেশী জানেন৷ তাই আমার আরও টাকা হলে ভাল হত, বাগ্মীতাশক্তি বা পাণ্ডিত্য থাকলে ভাল হত–এগুলো গোপী মনোভাবের সঙ্গে খাপ খায় না৷ তাই ভক্ত বা গোপীকে একথা মনে রাখতে হবে, পরমপুরুষ আমাকে যতটুকু শক্তি দিয়েছেন–আমার উচিত তাই দিয়েই তাঁর যথাসাধ্য সেবা করা৷ অবশ্য এই ধরণের অধিকতর কিছু শক্তি সামর্থ্য চাওয়াতে লক্ষ্যগত অনুপপত্তি না থাকলেও চরমগত বা ভাবগত ত্রুটি অবশ্যই রয়েছে৷ এখন এই যে টাকা, বাগ্মীতা, পাণ্ডিত্য–এগুলো সবই হ’ল বর্ণময়৷ মানুষ যখন টাকার চিন্তা করে তখন তার স্থূল বর্ণময়তা তার মনে আবিলতা এনে দেয়৷ তেমনি বাগ্মীতা বা পাণ্ডিত্য অন্য ধরণের আবিলতা এনে দেয়৷ মনে ষোল আনা সরসতা অক্ষুণ্ণ থাকে না৷ শাস্ত্রে পরমপুরুষ সম্বন্ধে বলা হয়েছে–‘‘রসো বৈ সঃ’’ অর্থাৎ তিনি আনন্দময়, রসময় সত্তা৷ অণুমনের ষোল আনা সরসতা থাকলে তবেই সে রসঘন আনন্দময় সত্তার সাথে একাত্মতা স্থাপন করা সম্ভব হয়৷ যে প্রকৃত গোপী এ তত্ত্বটা মানে, তাই গোপী করবে কি –না সে পরমপুরুষকে বলবে, আমার যে আবিলতা, আমার যা ত্রুটি–বিচ্যুতি–তা সবই থাক৷ কিন্তু এই যে পাণ্ডিত্য বা অর্থ–স্বাচ্ছন্দ্য বা বাগ্মীতার প্রতি আমার দুর্বলতা এগুলো যেন না থাকে৷ কারণ তুমি ছাড়া আর অন্য কিছু চাওয়াটা আমার ভুল হয়ে যাচ্ছে৷ এই যে আমি ভুলটা করলাম–অন্যায়টা করলাম, চলার পথে চলতে গিয়ে এই যে হোঁচট খেলাম–বর্ণময় জাগতিক বস্তু চাইতে গিয়ে আমার মধ্যে যে সাময়িক আবিলতা এসে গেছে, তার জন্যে আমি আমার ভুল স্বীকার করছি৷ তাই আমার মনের বর্ণ তোমার বর্ণে মিশিয়ে দিয়ে আমি বর্ণহীন হতে চাই–আমার মানস চিন্তার ত্রুটির জন্যে আমি সাময়িকভাবে যে বর্ণাধীনতায় এসে গিয়েছি, আমি এই ভাবে সেটা কাটিয়ে উঠতে চাই৷ তাই ভক্তকে বর্ণাতীত হবার সাধনায় রত হতে হবে৷ বসন্তোৎসবের মূল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এখানেই৷
এই বসন্তোৎসব বাঙলার উৎসব নয়, এই উৎসব পালিত হ’ত উত্তর ভারতে–নাম ছিল হোলী৷ উত্তর ভারতের মানুষ শীতের জড়তা বা জাড্য ভাবকে কাটিয়ে উঠে যেন বসন্তের ক্রমোচ্ছ্বলতা সজীবতায় প্রাণ ফিরে পেতে চাইত৷
শীত হ’ল জড়তা বা নৈষ্ক্র্মের প্রতিভূ৷ আর বসন্ত দুর্দম প্রাণোচ্ছ্বলতা, প্রচণ্ড কর্মময়তার অভিপ্রকাশ৷ মানুষ তাই শৈত্যের–স্থাণুত্বের প্রতিভূ হোলীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বসন্তের আবাহন করত৷ এই একই উৎসব বিহারের ‘ফাগুয়া’ নামে পরিচিত৷ আজ থেকে প্রায় ৫৫০ বছর আগে চৈতন্য মহাপ্রভু একবার বৃন্দাবন গিয়েছিলেন৷ তিনি সেখানে উত্তর ভারতের হোলী উৎসব প্রত্যক্ষ করেন৷ অতঃপর বাঙলাদেশে ফিরে এসে হোলী উৎসবের নির্যাসটুকুকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা প্রচলন করেন৷
একই বসন্তোৎসব কিন্তু উত্তর ভারতে সেটাই হ’ল হোলী–বিহারে হ’ল ফাগুয়া–বাঙলায় হ’ল শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা৷ উত্তর ভারতে এটা হ’ল মূলতঃ সামাজিক উৎসব, কিন্তু বাঙলায় এটা হ’ল ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সাধনাগত বা গোপীমনোভাবগত উৎসব হ’ল এই বসন্তোৎসব৷
Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী