আমি যেখানকার কথা বলছি সেখানে যাত্রাগানের পালা ছিল ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’৷ যাত্রাদলের বিবেকের কাজ হচ্ছে গানের মাধ্যমে যে ঘটনা হচ্ছে বা হতে চলেছে তার একটা আভাস দেওয়া৷ কিন্তু এখানকার বিবেক সে পথ না মাড়িয়ে রাবণের বিরুদ্ধে জমিদারবাবুকে চটিয়ে দিয়ে বখশিসের ব্যবস্থা করতে চাইল৷
‘‘রাবণ আসিল জুদ্দে পইর্যা ক্ষুট জুতা,
হনুমান মারে তারে লাতি–সর–গুতা৷
সর কাইয়া রাবণ রাজা জায় গরাগরি,
হনুমান বলে, ‘‘তোরে মাইরাসি সাপরি৷৷
সাপর মারিনি তোরে মাইরাসি সাপরি’’৷
সাপর মারিলে তুই জইতিস জমের বারি’’৷৷
জমিদারবাবু মহা খুশী৷ তিনি সঙ্গে সঙ্গে খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন–‘‘বিবেকডারে দশডা টাহা বক্শিস দাও৷’’ রাবণের ভূমিকায় যে নেক্ষেছে সে নিষ্ঠার সঙ্গে পার্ট করে চলেছে৷ অস্ত্রের ঝনৎকার....পৌরুষের চরম অভিব্যক্তি৷ রাম একেবারে কোণঠাসা৷ ভয়ে ভাবনায় দুশ্চিন্তায় রামের মুখে কথা সরে না৷ সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি জমিদারবাবুর তা সহ্য হ’ল না৷ তিনি বললেন–‘‘রাবণডার এ্যাকডা মুণ্ডু কাইট্যা ফ্যালাইয়া দাও৷ আস্পর্দা কত দশানন দশানন আজ তাইক্যা নয়ানন অইয়া গেল৷’’
তোমরা জানো, নাটকের রাবণের একটা আসল মুণ্ডু থাকে আর বাকী নয়টা নকল মুণ্ডু৷ জমিদারের পাইক–বরকন্দাজরা একটা নকল মুণ্ডুকেটে দিলে৷ রাবণ লক্ষ্মণের ওপর চরম আঘাত হেনেছে...লক্ষ্মণের শক্তিশেল৷
হনুমান ছুটেছে মৃতসঞ্জীবনীর খোঁজে... বিশল্যকরণীর খোঁজে৷ রাক্ষসদের শিবিরে আনন্দের গুঞ্জরণ, রামের শিবিরে শোকের রোল, ক্রন্দনের আর্ত্তনাদ৷ জমিদারবাবু আর সহ্য করতে পারলেন না৷ তিনি বললেন–‘‘হারামজাদাডার অহনও আক্কেল অয় নাই৷ ওর আর্যাকডা মুণ্ডু কাইট্যা লও৷ দশানন দশানন আজ তাইক্যা আটানন অইয়া গেল৷’’
এর পরের দৃশ্য ঃ চাকা ঘুরে গেছে৷ লড়াইয়ে রাবণের হার হয়ে চলেছে৷ রাবণ কাতরভাবে শিবের উদ্দেশ্যে বলছেন–শিব, তুমি আশুতোষ৷ যত পাপই করে থাকি না কেন, আমি তোমার সন্তান৷ তুমি কৃপাদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাও৷ তোমার কৃপা ছাড়া আমার জয়ের তো কোনো পথই নেই, বাঁচবারও কোনো পথ নেই৷
রাবণ কাতরস্বরে বলে চলেছেন আর অঝোরে কেঁদে চলেছেন৷ দৃশ্য দেখে জমিদারবাবুর মনে দয়া হইল৷ তিনি বললেন–‘‘রাবণডার দুঃখু দেইখ্যা মন–প্রাণ বিগলিত অইয়া জায়৷ আহাহা, আহাহা ওর মুণ্ডু দুইডা আবার জোড়া লাগাইয়া দাও৷ আবার ওরে দশানন কইর্যা দাও৷’’