এই পৃথিবীতে সারা বিশ্বে হাওয়া আমাদের অনুকূলে৷ বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ মানবতার জন্যে কোনো কিছু করার এটাই উপযুক্ত সময়৷ এই সন্ধিক্ষণে এক মুহূর্ত একশত বৎসরের সমান৷ তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগাও৷ প্রবল উৎসাহের সঙ্গে তোমার কর্তব্য করে যাও৷ তোমাদের কাজের গতিকে দ্রুততর করতেই হবে৷
ৰুদ্ধি আর জাগতিকতা–এই দু’টির মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক একটি ছাড়া আর একটির অস্তিত্ব থাকতেই পারে না৷ আরকোনো জড় বস্তু যেমন জল, তার নিজস্ব ৰুদ্ধি নেই৷ জড়বস্তু ভূমাসত্তার ইচ্ছায় পরিচালিত হয়৷ কিন্তু প্রতিটি জীবিত সত্তার অণুমন আছে৷ তাই মানুষ পরমপুরুষ ছাড়া থাকতে পারেনা৷
জড়বাদী তত্ত্ব কম্যুনিজম আজ মৃতপ্রায়৷ এই শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারলে অন্য কোনো দানবীয় তত্ত্ব তার স্থান দখল করে নেবে৷ এটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়৷ তাই তুমি অলস হয়ে বসে থাকতে পার না৷ তোমাকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলতে হবে৷ কম্যুনিজমের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে তার অবিবেচনাপূর্ণ, অমানবিক ও মনস্তত্ত্ববিরোধী তত্ত্ব৷
তোমার অধ্যাত্মিক ভিত্তিভূমিকে সুদৃঢ় করতে হবে৷ বেদোত্তর যুগে জড়বাদী চার্বাক দর্শন আসলে আধ্যাত্মিকতাকেই শক্তিশালী করেছে৷ ঠিক তেমনি গত তিনশ বছরে যে আধ্যাত্মিক ভিত্তিভূমি হারিয়ে যেতে বসেছিল তাকে শক্তিশালী করার জন্যেই কম্যুনিজমের আগমন৷ কোনো প্রকৃত ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনের (God-Centred Philosophy) — অস্তিত্ব ছিলনা৷ যা কিছু তত্ত্ব বা দর্শন ছিল তারা অধিকাংশই ছিল ভাবজড়তা কেন্দ্রিক (Dogma-Centred) বা আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক (Self-centred)৷ কিছু কিছু দর্শন আবার ভৌম–ভাবাবেগ (Geo-Sentiment) বা ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক ভাবাবেগ (Socio-sentiment) বা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে৷ তাদের অনতিবিলম্বে চলে যেতে হয়েছে৷ এই ধরনের সব তত্ত্ব বা দর্শনকেও চলে যেতে হবে৷ তাই তোমরা গতিশীল হও৷ মনে রাখবে গতিই বিশ্বের বিধান৷
বৈদিক যুগে সামাজিক সাম্য ছিল কি?–না, সে যুগে বিভিন্ন গোত্র, tribes–এর অস্তিত্ব ছিল৷ বেদোত্তর যুগেও কি সামাজিক সাম্য ছিল?–না, কেননা সেই সময় জাত–ব্যবস্থা (Cast-system) বজায় ছিল৷ ৰুদ্ধের পূর্বে মহাভারতের যুগে জাত–ব্যবস্থা ছিল যদিও তার কঠোরতা ছিল না৷ তবুও বিদূর সিংহাসন পেলেন না কেননা তাঁর মা ছিলেন বৈশ্যকুলের৷ ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন নিয়মমাফিক রাজা কিন্তু তিনি জন্মান্ধ হওয়ায় কার্যতঃ রাজকার্য চালাতেন পাণ্ডু৷ জারজ সন্তান হওয়ায় কর্ণকেও রাজা হতে দেওয়া হয়নি যদিও সে ব্যাপারে তাঁর কোনো অন্যায় ছিল না৷
ৰুদ্ধের সময় ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে সমতা যদিও বজায় ছিল কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থায় অসাম্য ছিল৷ ৰুদ্ধ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের দীক্ষিত করার পরেও তারা জাতিগত পরিচয় ত্যাগ করেনি৷ এমনকি ৰুদ্ধের মৃত্যুর পরে তার চিতাভস্মের অধিকার নিয়ে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছিল৷ তৎকালীন মগধরাজ দাবী করলেন, যেহেতু ৰুদ্ধ ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশজাত, তাই তাঁর চিতাভস্মের অধিকার একমাত্র ক্ষত্রিয়দেরই আছে৷
ৰুদ্ধের পরে, পৌরাণিক ব্যবস্থায় জাতিভেদ অত্যন্ত প্রবল ছিল আজও জাতপাত দুর হয়ে যায় নি৷ আমরাই প্রথম তীব্রতর ভাবে এর বিরোধিতা করেছি৷ প্রতিটি মানুষের মধ্যে দোষগুণ থাকবেই৷ তাই জাতপাতের পেছনে কোনো যৌক্তিকতাই নেই৷ যারা এই জাতিবিভাজন জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল তারা ছিল পাপী ও বিকৃত মনোভাবসম্পন্ন দৈত্যবিশেষ৷
যখন মানসিক বিকাশ ও আধ্যাত্মিক বিকাশ এই দুইয়ের কোনো একটির চেয়ে জড়শক্তির গতি বেশী হয় তখন সমাজ চরম নিষ্পেষণের কবলে পড়ে৷ যার একটি উদাহরণ কম্যুনিজম৷ আবার যখন আধ্যাত্মিকতার চেয়ে মানসিক বিকাশের গতি বেড়ে যায় তখন ৰুদ্ধিবৃত্তির কোনো অবলম্বনই থাকে না৷ উদাহরণস্বরূপ পৌরাণিক যুগে যদিও কিছুটা ৰৌদ্ধিক বিকাশ ছিল কিন্তু সমাজ ভাবজড়তায় দীর্ণবিদীর্ণ ছিল৷ তাই যখন মুসলিম শক্তি ভারত আক্রমণ করল, তা ঠিকমত প্রতিহত করা সম্ভব হল না৷
পৃথিবী দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে৷ মানসিক বিকাশও তেমনি দ্রুততর হয়েছে৷ এটা ৰুঝে তোমাদের কর্তব্য সম্পাদনের দ্রুতিও বাড়িয়ে দাও৷ আর নিজেরা এই পরিবর্ত্তিত দ্রুতির সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গতিবিধান করে চল৷ সর্বক্ষেত্রেই মানবীয় মনস্তত্ত্ব পরিচালিত হবে স্থিরৰুদ্ধি ও বিচারশীলতা দ্বারা৷ বিশ্ব চলবে মানবিকতার বিধানে৷
২৫ মার্চ ১৯৯০, কলিকাতা