মানুষের সামনে দুটি পথ–একটি শ্রেয়ের পথ, অন্যটি প্রেয়ের পথ৷ প্রেয়ের পথে মানুষ পায় ক্ষণিক সুখ, আর শেষে দুঃখ৷ আর শ্রেয়ের পথে চললে তাতে সাময়িক দূুঃখ–ক্লেশ এলেও শেষপর্যন্ত সেই পথেই মানুষের ৰৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়৷ মানুষ যখন প্রেয়ের পথ ধরে তখন সে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সেন্টিমেন্টের (ভাবপ্রবণতার) বশে চলে আর যখন শ্রেয়ের পথ নেয়,তখনও যুক্তির দ্বারা নয়, কল্যাণৰোধের ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে চলে৷ ভাবে, এই যে পথে আমি চলেছি, কাজ করছি, এটা কল্যাণের পথ– মঙ্গলের পথ৷ এই পথেই জনসেবা–জনকল্যাণ সর্বাধিক হবে৷
‘যুক্তি’ শব্দের অর্থ কোন কথার সঙ্গে হূদয়ের একাত্ম হয়ে যাওয়া, থিওরির সঙ্গে হূদয়ের মিল হয়ে যাওয়া৷ যেখানে কল্যাণের মনোভাব রয়েছে সেখানেও ওই একই কথা অর্থাৎ পরমপুরুষের সঙ্গে হূদয়ের মিল হওয়া৷ তাই মানুষ চলবে আদর্শের পথে– শ্রেয়ের পথে৷ প্রেয়ের পথে আপাতঃ সুখ থাকলেও পরিণামে জোটে বুকভাঙ্গা কান্না৷ কাউকে কোন প্রকারেই সে পথে চলবার পরামর্শ দেওয়া উচিত নয়, তাকে পরামর্শ দিতে হবে শ্রেয়ের পথে চলবার যাতে ব্যষ্টিরও কল্যাণ, সমষ্টিরও কল্যাণ সংসাধিত হয়৷ কল্যাণের রাস্তা যে নিয়েছে তাকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যারা কাউকেই ভাল কাজ করতে দিতে চায় না৷ এমন লোক খুব কমই আছে যারা অন্যের খারাপ কাজে ৰাধা দেবে, কিন্তু এমন লোক অনেক পাওয়া যাবে যারা ভাল কাজে ৰাধা দেবে, শুভ কর্মেও বিঘ্ণ সৃষ্টি করবে৷
মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে এই যে, যদি অন্যে কেউ কোথাও ভাল কাজ করে তাহলে সে ভীত–সন্ত্রস্ত হয়ে যায় এই ভেবে যে অন্য লোক ভাল কাজ করলে সহজে তাদের প্রতিষ্ঠা হবে, আর তার নিজের প্রতিষ্ঠা লোপ পাবে, লোকে তাকে মানবে না৷ এই ভাবনায় প্রেষিত হয়ে সে ভাল কাজের বিরোধিতা করে৷ আসল কথাটা এই ৷ তাই বলা হয়েছে–
‘‘নিন্দন্তু নীতিনিপুণাঃ যদি বা স্তুবন্তু৷
লক্ষ্মী সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্৷
অদ্যৈব মরণমস্তু যুগান্তরে বা
ন্যায়্যাৎ পথঃ প্রতিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ ৷৷’’
যদি মস্ত বড় পণ্ডিতেরাও নিন্দা করতে থাকেন , আর বলেন যে এ কাজ হতে দোব না, ত াহলে তাঁদের সম্বন্ধে খোঁজ নিলে দেখবে যে তাঁরা নিজেরা মস্তবড় অকর্ম্মণ্য, নিজেদের কিছু করবার সামর্থ্য নেই , কিছু করবার ইচ্ছাও নেই৷ ওঁদের কেবল একটাই কাজ আর তা হচ্ছে অন্যের কাজে ৰাধা সৃষ্টি করা৷ যদি তারা বিরোধিতা করে তো করতে দাও৷ আমরা আমাদের আদর্শের পথেই চলব৷ কল্যাণাত্মক ভাবনা নিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে৷ বড় বড় পণ্ডিতদের আর একটা স্বভাব হচেছ এই যে ওরা যখন দেখে যে বহুসংখ্যক মানুষ কোন একজনকে সমর্থন করছে, ওরাও তখন তাকে সমর্থন করতে শুরু করে ৷ বিপদের সময় বলবে আমরা ওর সমর্থক নই , কিন্তু প্রশংসার সময় বলবে, আমরা ওর সব থেকে বড় সমর্থক ছিলুম ও এখনও আছি৷ তাই তাদের প্রশংসা বা নিন্দার কোন মূল্যই নেই৷ তোমরা তোমাদের আদর্শের পথ ধরে নিজের রাস্তায় চলতে থাক ৷ কে তোমাদের নিন্দা করছে, কে তোমাদের প্রশংসা করছে, সেদিকে তাকানো তোমাদের কাজ নয়৷ ওদিকে তাকালে সময় নষ্ট হবে৷ তোমাদের সময় খুবই মূল্যবান, তাই তোমরা ওদিকে তাকাবে না৷
তোমার কাজের জন্যে যদি লক্ষ্মী তোমার ঘরে এসে যান তাতেও কিছু আসে যায় না, আর যদি বলেন যে আমি এখানে থাকব না তাতেও কিছু আসে যায় না৷ তুমি তাকে বলবে, তুমি যেখানে খুশী যাও৷
খাঁটি মানুষ ধর্মের সঙ্গে থাকবেন৷ কে প্রশংসা করছে , কে নিন্দা করছে, সেদিকে তাকাবেন না৷ ধর্ম সঙ্গী–এর চেয়ে বড় আর কী আছে ধর্মবল সব চেয়ে বড় বল আর ধর্মবল যার আছে তার সামনে পৃথিবীর আর সব শক্তিই নিষ্প্রভ৷ তোমরা ধর্মের সঙ্গে রয়েছ, ধর্মের সঙ্গে ছিলে, আর ধর্মের সঙ্গে থাকবেও, কাউকে ভয় করবে না, কোন পরিস্থিতিতে ঘাবড়াবে না৷ ধর্মপথে অবিচল থাকবে৷
লক্ষ্মী ছেড়ে চলে গেলেও ধর্মের পথ আঁাঁকড়ে ধরে থাকবে৷ ধর্মের বিরুদ্ধে যে যাবে তার অস্তিত্ব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে, সে যেই হোক না কেন৷ ধর্মের জন্যে যদি মৃত্যুও হয় তাতে, কিছু আসে যায় না৷ অনন্তকাল পর্যন্ত যদি বেঁচেও থাকতে হয় কিছু আসে যায় না৷ সঙ্কল্প হবে এই যে যদি বাঁচতে হয় ধর্মকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচব, যদি মরতে হয় ধর্মকে নিয়েই মরব৷
মানুষ তিন প্রকারের – উত্তম, মধ্যম ও অধম ৷ অধম স্বভাবের লোক ভাবে, এটা তো খুব বড় কাজ– আমার দ্বারা কি এটা সম্ভব ? আমি কি করতে পারব? – না, ৰোধ হয় আমি করতে পারব না৷ এই ভেবে তারা মহৎ কার্য্য থেকে দূরে থেকে যায়৷ অধম মানুষ মহৎ কার্য থেকে দূরেই থেকে যায়, ভাল কাজে হাতই লাগায় না৷ মধ্যম শ্রেণীর লোক ভাল কাজে হাত লাগিয়ে দেয় কিন্তু যখন ৰাধা আসে, তখন ৰাধার ভয়ে তারা মহান কর্ম থেকে সরে পড়ে৷ কিন্তু যারা উত্তম শ্রেণীর লোক তাঁরা হয় দৃঢ়চেতা৷ তাঁরা যে ভাল কাজে হাত লাগান তার থেকে সরে যান না৷ তাঁরা ধর্মের পথ থেকে সরে যান না – কোন অবস্থাতেই ঘাবড়ান না৷ পৃথিবীতে এই শ্রেণীর লোকেদেরই জয়–জয়কার হয়৷ পরিণামে এঁদেরই জয় হয় আর এই ধরনের মানুষেরাই সমাজ নির্মাণ করেছেন, নির্মাণ করছেন ও নির্মাণ করতে থাকবেন৷ তাই বলি, খাঁটি মানুষ হও, ধর্মের পথে চল, কোন পাপ–শক্তিকেই কোন পরিস্থিতিতেই ভয় কোর না, ঘাবড়ে যেওনা৷ জয় তোমাদের অবশ্যম্ভাবী৷ তোমাদের ঘাবড়াবার কোন কারণই নেই৷ জয়ের জন্যে হাহাকার করতে হবে না ৷ তোমরা জয়ের পেছনে পেছনে দৌড়োবে না৷ জয় তোমাদের পেছনে পেছনে দৌড়োবে৷