এ যুগের অভিমন্যু দীপ্তি কুমারী

সংবাদদাতা
পত্রিকা প্রতিনিধি
সময়

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সেই দৃশ্য--- অভিমন্যু একা চক্রবূ্যহ ভেদ করে ঢুকে পড়েছেন আর কৌরবপক্ষের ১৪ মহারথী ও ৫ অক্ষৌহিনী সৈন্য সেই বালককে ঘিরে ফেলেছে কিন্তু সেই বালকবীরের তেজের সামনে কৌরবপক্ষের বড় বড় মহারথীরাও দাঁড়াতে পারছেন না৷ কৃপ, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, দুঃশাসন, অশ্বত্থামা, শকুনি--- সবাই তার কাছে পরাজিত৷ কৌরব সৈন্যরা অভিমন্যুর বাণে কচুকাটা হয়ে যাচ্ছে৷ দুর্র্যেধন তা দেখে বললেন, ‘‘আজ এই বালক তো একাই পুরো কৌরব সৈন্যকে মেরে করবে, আপনারা কিছু করুন!

দ্রোণ বললেন, ‘‘যতক্ষণ এই বীরের হাতে ধনুক আছে ততক্ষণ একে হারানো অসম্ভব! আগে এর হাতের ধনুক কাটো! দেখতে দেখতে ১৪ মহারথীর সম্মিলিত আক্রমণে বালক অভিমন্যুর হাতের ধনুক কাটা গেল৷ চক্রবূ্যহে একলা ধনুর্ধরের হাতে ধনুক না-থাকলে তার ঠিক কতটা অসহায় লাগে, সেটা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন তীরন্দাজ, ঝাড়খণ্ডের দীপ্তি কুমারীকে জিগ্যেস করুন!

ঝাড়খণ্ডের হতদরিদ্র আদিবাসী পরিবারের এই কন্যাটির  বাবা-মা দুজনেই দিনমজুর৷ মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে, বাবার বানিয়ে দেওয়া বাঁশের ধনুক নিয়েই দীপ্তি স্কুল লেভেলের আর্চারিতে চ্যাম্পিয়ন৷ বাঁশের ধনুক নিয়ে স্কুল লেভেল থেকে স্টেট লেভেলের যাত্রাপথে তার সংগ্রহ আরও ৬৬টি মেডেল৷ কিন্তু স্টেট লেভেলে বাঁশের ধনুক চলে না৷ দিনমজুর মা, দেড় লক্ষ টাকা ধার করে তাকে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত একটি আধুনিক ধনুক কিনে দেন৷ সেই ধনুক দিয়েই স্টেট লেভেল থেকে রেকর্ড সময়ে জাতীয় লেভেলে পৌঁছে যায় দীপ্তি, সংগ্রহ করে আরো প্রায় ৪০টি মেডেল-কোনো ব্যক্তিগত কোচের সাহায্য ছাড়াই!

আরো ভালো প্রশিক্ষণের জন্য দীপ্তি ডাক পায় ঝাড়খণ্ডের বিরসা মুন্ডা আর্চারি অ্যাকাডেমিতে৷ দীপ্তিকে আর থামানো যায়নি৷ বাঁশের ধনুক ছেড়ে, আধুনিক ধনুক ধরার মাত্র দু’বছরের মধ্যে জাতীয় চ্যাম্পিয়ানশিপের প্রতিযোগিতায় দীপ্তি হারিয়ে দেয় জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন কামালিকা বারিকে জিতে নেয় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নের সোনার মেডেল৷

এবার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা কিন্তু তার জন্য দরকার আন্তর্জাতিক মানের ধনুক৷ সে ধনুক কেনার ক্ষমতা দীপ্তির নেই৷ দীপ্তির মা এবার ধার করেন সাড়ে চার লক্ষ টাকা৷ ঘটি-বাটি বন্ধক দিয়ে ও ধার করা টাকা দীপ্তি হাতে পায় প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ধনুক ও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবার দরুন আমন্ত্রিত হয় আমেরিকার একটি তীরন্দাজি প্রতিযোগিতায়৷ কিন্তু বিধি বাম৷ সেই প্রতিযোগিতার মাঝপথে দীপ্তির নতুন ধনুকটি ভেঙে যায়৷ ধনুকহীন দীপ্তিকে বাকি প্রতিযোগিতাটিতে সাইডলাইনেই বসে থাকতে হয়৷

আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে এসে দীপ্তি দ্যাখে, মা কঠিন অসুখে হাসপাতালে ভর্তি৷ মাথার উপর অনেক ধার৷ তার উপর মায়ের চিকিৎসার জন্য চড়া সুদে আরো টাকা ধার করতে হয়৷ বাবার সামান্য রোজগার৷ দাদা রিক্সাচালক৷ মাত্র ৬ মাসে পুরো পরিবারটি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে৷ ধনুর্ধরের হাতে ধনুক নেই, সামনে আগ্রাসী ঋণের চক্রবূ্যহ৷  কুরুক্ষেত্রে অভিমন্যু কী করেছিলেন? হাতের ধনুক কাটা যাবার পরেও তিনি যুদ্ধ ছাড়েননি৷ শুধু তলোয়ার নিয়ে রথ থেকে মাটিতে নেমে পড়েছিলেন৷ সারথি সুমিত্র তাঁকে বাধা দিতে গেলে অভিমন্যু বলেছিলেন, ‘দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং বজ্র হাতে এলেও আমি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করবো! তীরন্দাজ হিসেবে সেই শেষ যুদ্ধটাই করছেন দীপ্তি৷ বাঁচার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য ৬০ হাজার টাকা ধার করে একটি চায়ের দোকান খুলেছেন৷ এক স্থানীয় পত্রিকার জার্নালিষ্ট সেই দোকানে চা খেতে এসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দীপ্তিকে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে যান৷ দীপ্তি তাঁর পা জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘স্যার, সহানুভূতি চাই না৷ শুধু একটা প্রতিযোগিতার উপযুক্ত ধনুক জোগাড় করে দিন৷ কথা দিচ্ছি জান-প্রাণ লড়িয়ে দেবো৷ জাতীয় চ্যাম্পিয়নের মেডেলটা আবার জিতবই! তারপর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, অলিম্পিক-দেশকে মেডেল এনে দেবই! চাই শুধু একটা ধনুক৷ একটু দেখুন না, স্যার৷ যদি কিছু করা যায়৷’’ সাংবাদিক ভদ্রলোক তাঁর সাধ্যমতো সরকারি, বেসরকারি আর্থিক সাহায্যের জন্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তেমন কোনো সাহায্যই জোগাড় করতে পারেননি৷

অভিমন্যু যেদিন চক্রবূ্যহে প্রবেশ করেন, সেদিন যুদ্ধ শুরুর আগে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করার সময় শ্রীকৃষ্ণ তাকে ‘যশস্বী ভব’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন৷ তা শুনে, অভিমন্যুর মা সুভদ্রা জিগ্যেস করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ‘বিজয়ী ভব’ বলে আশীর্বাদ করলেন না কেন? শ্রীকৃষ্ণ উত্তরে বলেছিলেন---সব যোদ্ধার কপালে বিজয় লেখা থাকে না কিন্তু বীরত্ব ও তাঁদের লড়াইটা মহাকাল চিরদিন মনে রাখে৷

চরম আর্থিক দুরবস্থায়, সামান্য একটি চায়ের দোকানকে সম্বল করে, ঋণের চক্রবূ্যহে দাঁড়িয়ে, ধনুকহীন একা এক ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন আদিবাসী-কন্যার এই লড়াইটাও হয়তো ভারতীয় তীরন্দাজির ইতিহাসে সেভাবেই লেখা থাকবে! নাকি রাষ্ট্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে৷      (সংগৃহীত)