গণতন্ত্র না সদ্বিপ্রতন্ত্র ?

লেখক
সুকুমার সরকার

সাধারণ একটি পঞ্চায়েৎ  নির্বাচনকে কেন্দ্র করে  পশ্চিমবঙ্গে যে প্রহসনের  রঙ্গমঞ্চ শুরু হয়েছে  তাতে করে স্পষ্ট, এই ধরণের  গণতন্ত্র একুশ শতকের রাজ্য রাজনীতিতে  অচল৷ যতই আমরা গর্ব করে বলি না কেন, বিশ্বের প্রথম প্রজাতন্ত্র ভারতবর্ষের লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্র৷ কিংবা ভারতের  বর্তমান  গণতন্ত্র বিশ্বের  অন্যতম  বৃহৎ গণতন্ত্র --- আসলে  এটা ধাপ্পাতন্ত্র৷

প্রথমতঃ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অসৎ লোকের দ্বারা পরিচালিত গণতন্ত্র কোনোদিনই কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না৷ অতীতের  রাজতন্ত্রে অনেক  সময় প্রজাবৎসল রাজাদের  দ্বারা যে কল্যাণ জনগণের  হোত, আজকের  তথাকথিত গণতন্ত্রে সেটুকু কল্যাণও জনগণ পায় না৷  যেটুকু কল্যাণ আজকের বিশ্বে হচ্ছে, তা পুঁজিবাদতন্ত্রের ফসল গণতন্ত্রের সুফল নয়৷ ঠিক  এই সত্যটুকুই  আজকের  রাষ্ট্র নেতারা বা রাজনৈতিক  নেতারা  বুঝতে  পারছেন না৷ কিংবা বুঝতে পেরেও শাসক ও শোষক হবার বাসনায় আসল সত্যকে  উন্মোচন  করছেন  না৷ পাছে ক্ষমতা  চলে যায়৷ তাই গণতন্ত্রের নামে একটি মোহতন্ত্রের  টুপি জনগণের  মাথায় পরানো আছে৷ আর পরোক্ষে চলছে  পুঁজিবাদতন্ত্র৷

শুধু শিক্ষিত হলেই যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে এমনটি নজিরও দেখা যাচ্ছে না৷ মার্কিন মুলুকে  এত  যে শিক্ষিতের  বড়াই--- সেখানেও  তথাকথিত গণতান্ত্রিক  নির্র্বচনে  জনমতের  চেয়ে  পুঁজিবাদতন্ত্রের  বাড়বাড়ন্ত৷ নইলে গণতন্ত্রের নিরিখে  তো হিলারীর জেতার কথা ছিল৷ কিন্তু জিতে গেল ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ আসলে পুঁজিবাদতন্ত্র তাদের  পছন্দমতো শাসককে ক্ষমতার অলিন্দে বসিয়ে শাসন ও শোষণ করার মানসেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতায়  বসাতে  তৎপর ছিল একই অবস্থা সমগ্র বিশ্বে৷ যেখানে যে তাস খেলা দরকার সেখানে সেই তাস  খেলে পুঁজিবাদীরা৷ আজকের তথাকথিত গণতন্ত্রের পক্ষে  বিপদটা সেখানেই৷

পুঁজিবাদ এখন কর্পোরেট পুঁজিবাদতন্ত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত৷ তাকে বোঝার ও সরানোর মতো কোন তন্ত্র  একদিন ছিল না৷ পুঁজিবাদের  আর্থসামাজিক - সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যে সূক্ষ্মমনস্তাত্ত্বিক  জাল সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে, তার থেকে মুক্ত কেউ না৷ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও পুঁজিবাদতন্ত্রের সূক্ষ্ম ছলা-কলার কাছে  পুরস্কার  বা অর্থের লোভে  মগজ বিকিয়ে আছেন৷ যে সংবাদমাধ্যমগুলি একসময় ভারতীয় রাজ্য-রাজনীতির দিশা  দেখাবার মুখপত্র ছিল, সেইসব সংবাদ মাধ্যমগুলি  এখন পুঁজিবাদতন্ত্রের মুখপত্র হয়ে গেছে৷

তাদের পরিবেশিত সবকিছুর  পেছনে কাজ  করছে কর্পোরেট পুঁজিবাদতন্ত্রের বাণিজ্য বিপনন মুহূর্মুহূ বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া তারই প্রমাণ৷

পুঁজিবাদ এমনভাবে জাল বিস্তার করেছে যে , অন্য সকল ‘বাদ’ (ইজম্) পুঁজিবাদের জালে বন্দি৷ সবাই  পুঁজিবাদীদের  কৃপা-করুণায় বেঁচে বর্তে আছি৷ ফলে কেউই পুঁজিবাদের  বিরুদ্ধে একটি ‘রা’ শব্দও এখন  উচ্চারণ করছেন না৷ এক  সময়  ‘রা’ করা  কমিউনিষ্টরাও এখন পুঁজিবাদীদের ছোলাগুড় খেয়ে বেঁচে বর্তে আছে বিলুপ্ত প্রজাতির মতো৷ সুতরাং এমতাবস্থায় সঠিক গণতন্ত্র কামনা করা মুর্খের স্বর্গে বাস৷

একটি পঞ্চায়েত নির্বাচন অনেক বার্তা দিয়ে গেল৷ রঙ্গমঞ্চে কলাকুশলিরা যেমন দিয়ে যায়৷ কিন্তু বোঝে কয়জন?

বামফ্রন্টের  আমলে নির্বাচন হতো তবে জনগণের  ভোট দেবার স্বাধীনতা  ছিল না৷ ভোটারদের বাড়ি বাড়ি  গিয়ে  প্রভাবিত  করা হতো৷ তৃণমূল  কংগ্রেস  আরও  এক কাঠি  ওপরে  ভোটারদের  বাড়ি বাড়ি গিয়ে এত লোককে প্রভাবিত করার কী দরকার ? তারা ভোটে  দাঁড়ানো বিরোধী প্রার্থীদের  কব্জা করার কৌশল  নিলেন৷ ভোটে  দাঁড়াতেই  দেবার দরকার নেই৷ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়  জয় ছিনিয়ে নাও৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে বোমা পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে যাও৷  ঘর থেকে ভয়ে আর কেউ বেরোবে না৷ এই হলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন!  আর তার প্রধান  পুরোহিত নির্বাচন  কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ ! বিবেকের ভূমিকায় আদালতের  বিচারপতিরা মাঝে মাঝে  উদয় হন বটে কিন্তু তাদের  নির্দেশ কেউ মানে না৷ এই বর্তমান  পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের চিত্র ও চরিত্র৷

--- এ চিত্র ও চরিত্রের বদল ঘটবে কোন তন্ত্রের মাধ্যমে?

--- অবশ্যই পুঁজিপতিদের  দ্বারা পরিচালিত কোনো  তন্ত্রেই  নয় নোতুন কোনো তন্ত্র খুঁজতে হবে৷ একুশ শতকের নোতুন পৃথিবীর জন্যে নোতুন তন্ত্র, এসেও গেছে৷ সেইতন্ত্রের নাম প্রাউটের সদবিপ্রতন্ত্র৷

প্রকৃত সৎ, নিষ্ঠাবান, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক গুণসম্পন্ন মানুষদের  নিয়ে  সদবিপ্রতন্ত্র আনতে হবে৷  নইলে যতই তত্ত্বের কচকচানি করা হোক  কর্পোরেট পুঁজিবাদতন্ত্রের বিস্তৃত জালে  তা ধাপ্পাতন্ত্রেই পরিণত হবেই৷

না, আর কালক্ষেপ নয়, সকলকে এই মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷ পুঁজিবাদের অস্ত্রেই পুঁজিবাদকে  ঘায়েল করতে হবে৷ বৈজ্ঞানিক আবিস্কার যেভাবে পুঁজিপতিদের কুটকৌশলে কুফলে  পরিণত হয়েছে, সেভাবেই   আবিস্কারকে সুকৌশলে  সুফলে পরিণত  করতে হবে৷ বিজ্ঞান আজ পুঁজিপতিদের দখলে  বটে, তবে বৈজ্ঞানিকরা কিন্তু ঋষিপুরুষ৷ তাঁদের বহু ত্যাগতিতিক্ষ্যা ও সাধনার ফল এভাবে পুঁজিপতিদের  কুটকৌশলের  কুফলে  পরিণত করে দেওয়া উচিৎ নয়৷ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে  সদবিপ্রদের  দ্বারা জনগণের সার্বিক কল্যাণে কাজে  লাগাতে  হবে৷  প্রযুক্তির আবর্জনা বা কুফলদায়িনী বিষয়গুলিকে সুকৌশলে  নিয়ন্ত্রণ করে আগত প্রজন্মকে সুন্দর সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে হবে৷

গণতন্ত্রের নির্বাচন ও নির্র্বচিত প্রতিনিধিরাই সেই দায়িত্ব পালন করেন রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমে৷ অতএব এ তত্ত্বালোচনা  অমূলক নয় এটাই আসল কথা! এই সত্য বিস্মৃত হলে দেশ ও জাতির সমূহ ক্ষতি৷ ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে ধাবিত হবে৷ ক্ষমতা  প্রয়োগের রাষ্ট্রযন্ত্র  ছাড়া ভালমন্দ  কোনো তন্ত্রই  জনগণের  কল্যাণে  আসবে না৷ সে তত্ত্ব আকাশে বাতাসে  ভেসে  বেড়াবে৷ কিছু ভাল মানুষ  সে তত্ত্ব নিয়ে  তত্ত্বের  কচকচানি  করবেন৷ কিন্তু ফল কিছু ফলবে না ৷ যে কোনো তত্ত্বের   সুফল পেতে  গেলে  সর্বসাধারণের কল্যাণে প্রয়োগ করতে রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমেই তা করতে হবে৷  আর সে রাষ্ট্রকে  পরিচালিত করতে  হবে সদবিপ্রের  গণতন্ত্রের  মাধ্যমে৷ সদ্বিপ্র পরিচালিত এযাবৎকাল আমরা যে গণতন্ত্র দেখে  আসছি তা পুঁজিবাদীদের গণতন্ত্র৷ এই গণতন্ত্রের হিসেব সংখ্যা গরিষ্ঠতার  নিরিখে৷  এ গণতন্ত্রে শতকরা ৭০জন মানুষ যদি  বলেন  সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে, তাহলে  সেটাই মেনে নিতে হবে৷ প্রাউটের  নোতুন ‘সদ্বিপ্রের’  গণতন্ত্র যুক্তিবিচারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত মানবে৷ এখানেই  পুঁজিবাদীদের  গণতন্ত্র আর প্রাউটের সদ্বিপ্রের গণতন্ত্রের পার্থক্য৷

এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন যুক্তির কোনো  নিরিখেই  সঠিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন হচ্ছে না৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই মেনে নিতে হবে৷ আগামী পাঁচ বছর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতি  রাজে এই প্রতিনিধিরাই ক্ষমতা চালাবে৷ বুঝতেই পারছেন কতটা সুশাসন চলবে, আর কতটা শোষণ! আর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে  কৃষি নির্ভর গ্রাম বাঙলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি!

সুতরাং  পুঁজিপতি ধাঁচের  এই গণতন্ত্র আমরা চাই না! চাই প্রকৃত উন্নয়নের দিশা (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের) প্রাউটের সদবিপ্রের গণতন্ত্র৷