সাধারণ একটি পঞ্চায়েৎ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে যে প্রহসনের রঙ্গমঞ্চ শুরু হয়েছে তাতে করে স্পষ্ট, এই ধরণের গণতন্ত্র একুশ শতকের রাজ্য রাজনীতিতে অচল৷ যতই আমরা গর্ব করে বলি না কেন, বিশ্বের প্রথম প্রজাতন্ত্র ভারতবর্ষের লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্র৷ কিংবা ভারতের বর্তমান গণতন্ত্র বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্র --- আসলে এটা ধাপ্পাতন্ত্র৷
প্রথমতঃ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অসৎ লোকের দ্বারা পরিচালিত গণতন্ত্র কোনোদিনই কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না৷ অতীতের রাজতন্ত্রে অনেক সময় প্রজাবৎসল রাজাদের দ্বারা যে কল্যাণ জনগণের হোত, আজকের তথাকথিত গণতন্ত্রে সেটুকু কল্যাণও জনগণ পায় না৷ যেটুকু কল্যাণ আজকের বিশ্বে হচ্ছে, তা পুঁজিবাদতন্ত্রের ফসল গণতন্ত্রের সুফল নয়৷ ঠিক এই সত্যটুকুই আজকের রাষ্ট্র নেতারা বা রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারছেন না৷ কিংবা বুঝতে পেরেও শাসক ও শোষক হবার বাসনায় আসল সত্যকে উন্মোচন করছেন না৷ পাছে ক্ষমতা চলে যায়৷ তাই গণতন্ত্রের নামে একটি মোহতন্ত্রের টুপি জনগণের মাথায় পরানো আছে৷ আর পরোক্ষে চলছে পুঁজিবাদতন্ত্র৷
শুধু শিক্ষিত হলেই যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে এমনটি নজিরও দেখা যাচ্ছে না৷ মার্কিন মুলুকে এত যে শিক্ষিতের বড়াই--- সেখানেও তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্র্বচনে জনমতের চেয়ে পুঁজিবাদতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত৷ নইলে গণতন্ত্রের নিরিখে তো হিলারীর জেতার কথা ছিল৷ কিন্তু জিতে গেল ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ আসলে পুঁজিবাদতন্ত্র তাদের পছন্দমতো শাসককে ক্ষমতার অলিন্দে বসিয়ে শাসন ও শোষণ করার মানসেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসাতে তৎপর ছিল একই অবস্থা সমগ্র বিশ্বে৷ যেখানে যে তাস খেলা দরকার সেখানে সেই তাস খেলে পুঁজিবাদীরা৷ আজকের তথাকথিত গণতন্ত্রের পক্ষে বিপদটা সেখানেই৷
পুঁজিবাদ এখন কর্পোরেট পুঁজিবাদতন্ত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত৷ তাকে বোঝার ও সরানোর মতো কোন তন্ত্র একদিন ছিল না৷ পুঁজিবাদের আর্থসামাজিক - সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যে সূক্ষ্মমনস্তাত্ত্বিক জাল সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে, তার থেকে মুক্ত কেউ না৷ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও পুঁজিবাদতন্ত্রের সূক্ষ্ম ছলা-কলার কাছে পুরস্কার বা অর্থের লোভে মগজ বিকিয়ে আছেন৷ যে সংবাদমাধ্যমগুলি একসময় ভারতীয় রাজ্য-রাজনীতির দিশা দেখাবার মুখপত্র ছিল, সেইসব সংবাদ মাধ্যমগুলি এখন পুঁজিবাদতন্ত্রের মুখপত্র হয়ে গেছে৷
তাদের পরিবেশিত সবকিছুর পেছনে কাজ করছে কর্পোরেট পুঁজিবাদতন্ত্রের বাণিজ্য বিপনন মুহূর্মুহূ বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া তারই প্রমাণ৷
পুঁজিবাদ এমনভাবে জাল বিস্তার করেছে যে , অন্য সকল বাদ (ইজম্) পুঁজিবাদের জালে বন্দি৷ সবাই পুঁজিবাদীদের কৃপা-করুণায় বেঁচে বর্তে আছি৷ ফলে কেউই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি রা শব্দও এখন উচ্চারণ করছেন না৷ এক সময় রা করা কমিউনিষ্টরাও এখন পুঁজিবাদীদের ছোলাগুড় খেয়ে বেঁচে বর্তে আছে বিলুপ্ত প্রজাতির মতো৷ সুতরাং এমতাবস্থায় সঠিক গণতন্ত্র কামনা করা মুর্খের স্বর্গে বাস৷
একটি পঞ্চায়েত নির্বাচন অনেক বার্তা দিয়ে গেল৷ রঙ্গমঞ্চে কলাকুশলিরা যেমন দিয়ে যায়৷ কিন্তু বোঝে কয়জন?
বামফ্রন্টের আমলে নির্বাচন হতো তবে জনগণের ভোট দেবার স্বাধীনতা ছিল না৷ ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রভাবিত করা হতো৷ তৃণমূল কংগ্রেস আরও এক কাঠি ওপরে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এত লোককে প্রভাবিত করার কী দরকার ? তারা ভোটে দাঁড়ানো বিরোধী প্রার্থীদের কব্জা করার কৌশল নিলেন৷ ভোটে দাঁড়াতেই দেবার দরকার নেই৷ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় ছিনিয়ে নাও৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে বোমা পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে যাও৷ ঘর থেকে ভয়ে আর কেউ বেরোবে না৷ এই হলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন! আর তার প্রধান পুরোহিত নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ ! বিবেকের ভূমিকায় আদালতের বিচারপতিরা মাঝে মাঝে উদয় হন বটে কিন্তু তাদের নির্দেশ কেউ মানে না৷ এই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের চিত্র ও চরিত্র৷
--- এ চিত্র ও চরিত্রের বদল ঘটবে কোন তন্ত্রের মাধ্যমে?
--- অবশ্যই পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিচালিত কোনো তন্ত্রেই নয় নোতুন কোনো তন্ত্র খুঁজতে হবে৷ একুশ শতকের নোতুন পৃথিবীর জন্যে নোতুন তন্ত্র, এসেও গেছে৷ সেইতন্ত্রের নাম প্রাউটের সদবিপ্রতন্ত্র৷
প্রকৃত সৎ, নিষ্ঠাবান, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক গুণসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে সদবিপ্রতন্ত্র আনতে হবে৷ নইলে যতই তত্ত্বের কচকচানি করা হোক কর্পোরেট পুঁজিবাদতন্ত্রের বিস্তৃত জালে তা ধাপ্পাতন্ত্রেই পরিণত হবেই৷
না, আর কালক্ষেপ নয়, সকলকে এই মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷ পুঁজিবাদের অস্ত্রেই পুঁজিবাদকে ঘায়েল করতে হবে৷ বৈজ্ঞানিক আবিস্কার যেভাবে পুঁজিপতিদের কুটকৌশলে কুফলে পরিণত হয়েছে, সেভাবেই আবিস্কারকে সুকৌশলে সুফলে পরিণত করতে হবে৷ বিজ্ঞান আজ পুঁজিপতিদের দখলে বটে, তবে বৈজ্ঞানিকরা কিন্তু ঋষিপুরুষ৷ তাঁদের বহু ত্যাগতিতিক্ষ্যা ও সাধনার ফল এভাবে পুঁজিপতিদের কুটকৌশলের কুফলে পরিণত করে দেওয়া উচিৎ নয়৷ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে সদবিপ্রদের দ্বারা জনগণের সার্বিক কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে৷ প্রযুক্তির আবর্জনা বা কুফলদায়িনী বিষয়গুলিকে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে আগত প্রজন্মকে সুন্দর সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে হবে৷
গণতন্ত্রের নির্বাচন ও নির্র্বচিত প্রতিনিধিরাই সেই দায়িত্ব পালন করেন রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমে৷ অতএব এ তত্ত্বালোচনা অমূলক নয় এটাই আসল কথা! এই সত্য বিস্মৃত হলে দেশ ও জাতির সমূহ ক্ষতি৷ ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে ধাবিত হবে৷ ক্ষমতা প্রয়োগের রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়া ভালমন্দ কোনো তন্ত্রই জনগণের কল্যাণে আসবে না৷ সে তত্ত্ব আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবে৷ কিছু ভাল মানুষ সে তত্ত্ব নিয়ে তত্ত্বের কচকচানি করবেন৷ কিন্তু ফল কিছু ফলবে না ৷ যে কোনো তত্ত্বের সুফল পেতে গেলে সর্বসাধারণের কল্যাণে প্রয়োগ করতে রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমেই তা করতে হবে৷ আর সে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে হবে সদবিপ্রের গণতন্ত্রের মাধ্যমে৷ সদ্বিপ্র পরিচালিত এযাবৎকাল আমরা যে গণতন্ত্র দেখে আসছি তা পুঁজিবাদীদের গণতন্ত্র৷ এই গণতন্ত্রের হিসেব সংখ্যা গরিষ্ঠতার নিরিখে৷ এ গণতন্ত্রে শতকরা ৭০জন মানুষ যদি বলেন সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে, তাহলে সেটাই মেনে নিতে হবে৷ প্রাউটের নোতুন সদ্বিপ্রের গণতন্ত্র যুক্তিবিচারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত মানবে৷ এখানেই পুঁজিবাদীদের গণতন্ত্র আর প্রাউটের সদ্বিপ্রের গণতন্ত্রের পার্থক্য৷
এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন যুক্তির কোনো নিরিখেই সঠিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন হচ্ছে না৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই মেনে নিতে হবে৷ আগামী পাঁচ বছর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতি রাজে এই প্রতিনিধিরাই ক্ষমতা চালাবে৷ বুঝতেই পারছেন কতটা সুশাসন চলবে, আর কতটা শোষণ! আর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কৃষি নির্ভর গ্রাম বাঙলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি!
সুতরাং পুঁজিপতি ধাঁচের এই গণতন্ত্র আমরা চাই না! চাই প্রকৃত উন্নয়নের দিশা (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের) প্রাউটের সদবিপ্রের গণতন্ত্র৷
- Log in to post comments