জগৎগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আনন্দনগরে আনন্দমার্গের ধর্মমহাসম্মেলন

সংবাদদাতা
আচার্য মোহনানন্দ অবধূত
সময়

আনন্দনগর ঃ গত ২৪,২৫, ২৬শে মে জগদ্গুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ৯৮তম জন্মবার্ষিকী  উৎসব উপলক্ষ্যে আনন্দনগরে তিনদিন ব্যাপী ধর্মমহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’ল৷ এই ধর্ম মহাসম্মেলনে দেশ বিদেশ থেকে দলে দলে আনন্দমার্গীরা যোগদান করেন৷ ধমহাসম্মেলনে আনন্দমার্গের পুরোধা প্রমুখ আচার্য কিংশুকরঞ্জন সরকার মার্গগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে আধ্যাত্মিক প্রবচন দেন৷ তিনদিন ব্যাপী তাঁর প্রবচনে তিনি কীভাবে প্রতিটি মানুষ সাধনা ও সেবার মাধ্যমে জীবনের সার্থকতা অর্জন করতে পারে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন৷ তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ধর্ম মহাসম্মেলনের মূল প্রবচনে তিনি যা বলেন তার সার সংক্ষেপ নিম্নে প্রদত্ত হ’ল---

এই  বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সবই চলে চলেছে--- কোন কিছু  থেমে নেই৷ তাই সবাইকে চলতে হবে৷ কিন্তু মানুষের  ক্ষেত্রে চলাটাতে সমস্যা আছে৷ কারণ মানুষের মনে অনেক বৃত্তি আছে৷ এই বৃত্তিগুলির মধ্যে কিছু ভাল বৃত্তি আছে যা মানুষকে প্রগতির দিকে নিয়ে চলে আর কিছু  খারাপ বৃত্তি থাকে যার প্রভাবে  মানুষ খারাপ পথে চলতে থাকে৷ ওই খারাপ বৃত্তিগুলির  প্রভাবে মানুষ জড়ভোগে মত্ত হয়ে ওঠে৷ এরফলে মানুষ জড়ত্ব প্রাপ্ত হয়৷ জড়ভোগের  দিকে  গেলে মনের বন্ধন বেড়ে যায় আর সূক্ষ্মের  দিকে বৃত্তিগুলির  প্রবাহ  হলে মানুষের বন্ধন থেকে, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি ঘটে৷ জড়ের প্রতি গতিকে বলা হয় প্রবৃত্তি আর সূক্ষ্মের দিকে গতি হ’ল নিবৃত্তি৷  মানুষ জড়ভোগের  জন্য ছুটে বেড়ালে মানুষের  নিম্নগতি  হয় যার ফলে  মানুষের পরবর্তী জীবনে আর মানব শরীর না থেকে নিম্নজীবের  শরীর প্রাপ্ত হয়৷ তখন  মানুষের গতি হয় পিছনের দিকে প্রতি সঞ্চরধারার ঋণাত্মক দিকে৷ চরম সূক্ষ্মসত্তা হলেন পরমপুরুষ৷ তার দিকে মানুষকে চলতে হবে৷ এই পরমপুরুষের  পথে চলতে গেলে মানুষকে কিছু নিয়ম-পালন করতে হবে৷ এসব নিয়ম হলো যম-নিয়ম পালন করা, ষোড়শবিধি  মেনে চলা৷ তবে প্রবৃত্তিগুলিকে খুব প্রবলভাবে অবদমন  করলে এর প্রতিক্রিয়া খারাপ হবে৷ ব্রাহ্মী ভাবনা নিয়ে সাধনা করলে ধীরে ধীরে প্রবৃত্তিগুলি নিবৃত্তি হতে থাকে৷

এখন মানুষ ইচ্ছার দ্বারা সম্প্রেষিত হয়ে চলে৷ আর শুধু ইচ্ছা করলে তো হবে না৷ ইচ্ছাকে কার্যে রূপান্তরের চেষ্টা করাকে বলে এষণা৷ পরমপুরুষের দিকে যারা এগিয়ে চলতে চায় তাদের প্রাথমিকভাবে---

               ১) আমাকে বড় হতে হবে এই ভাবনা থাকা উচিত৷

               ২) পরমপুরুষের রসপ্রবাহে তাকে ভেসে  চলতে হবে৷

               ৩) ভাল ভাল কাজ করে মনে সন্তুষ্টি লাভ করার প্রয়াস করতে হবে৷

এর ফলে নেগেটিভ  চিন্তা আমাদের গ্রাস করবে না৷ নেগেটিভ চিন্তা রোধ  করতে হলে ভাল চিন্তা রাখতে হবে ও ভাল কর্মে ব্যস্ত থাকতে হবে৷ ভাল চিন্তা বলতে পরমপুরুষের চিন্তা, যত পরমপুরুষের ভাবনা নেব মন তত প্রসারিত হতে থাকবে ও মনের  চরম প্রসারণ ঘটবে৷ আর কাজ তো আমাদের করতে হবে৷ তবে গুরুমন্ত্রের সঙ্গে  কাজ করে  চলতে হবে৷ যাতে তার রসপ্রবাহটা মনে অটুট থাকে৷ পরমপুরুষের ভাবনা সদা মনে রাখলে মনের কোনো অধোগতি  হবে না৷ তাই পরমপুরুষের ভাবনা হলো সাধককে  শুভচিন্তার  প্রবাহের মূল উৎসের perennial source)-এর সঙ্গে যুক্ত রাখা৷ অহংকার পতনের কারণ৷ সেবার  মধ্যেও অহংকার আসে৷ তাই যখন সেবাকার্য করবো তখন ভাবতে হবে তাঁরই  কৃপায় তাঁরই শক্তিতে তাঁর সৃষ্ট জগতের সেবা করছি, মানে তাঁরই সেবা করে চলেছি৷

আমরা অনেক ইচ্ছা করি৷ আমরা ইচ্ছা করি, কারুর চাকরী হয়ে যাক, কারুর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাক---ইত্যাদি৷ এসব শুভ ইচ্ছা৷ আর কারুর ক্ষতি চাওয়া হ’ল  নেগেটিভ ভাবনা৷ তাই মনে সবসময় পজিটিভ ভাবনা পোষণ করে চলতে হবে৷ এরফলে মনের প্রসারণ ঘটবে৷

পরমপুরুষের স্পন্দন সারা বিশ্বে প্রবাহিত হয়ে চলছে৷ সেই স্পন্দনের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হবে ও সেই সঙ্গে প্রতিকর্মে গুরুমন্ত্র প্রয়োগ করতে হবে৷

মানুষ আজকাল বেশি করে মানসিক রোগে ভুগছে৷ মানুষ যদি গুরুমন্ত্র প্রয়োগের অভ্যাস করে তবে এসব  রোগ থেকে মানুষ মুক্ত  থাকবে৷  এসবের  সাথে সাথে  আমাদের ভক্তির জাগরণের চেষ্টা করতে হবে৷ ভক্তিজাগরণের জন্যে আমাদের শ্রবণ-মনন- নিদিধ্যাসন, তত্ত্বভাবনা, যোজনা ও অভিধ্যান অভ্যাস করতে হবে৷

শ্রবণ কী ? আমরা যা কিছু শুণব পরমপুরুষের কথা শুণব৷ তবে কিন্তু আমাদের তো অনেক খারাপ কথাও অন্যের থেকে শুণতে হয়৷ তখন গুরুমন্ত্রের প্রয়োগ করে পরমপুরুষের ভাবনা নেওয়া উচিত৷

মনন কী? মানুষকে চিন্তা করতেই হয়৷ যদি চিন্তা  করতে হয় তো পরমপুরুষের চিন্তায় ব্যস্ত থাকা উচিত৷ অর্র্থৎ বিরামহীনভাবে ইষ্টমন্ত্র  জপ করে চলা হলো মনন৷ নিদিধ্যাসন মানে তৈলধারাবৎ ইষ্ট বা পরমপুরুষের  চিন্তা মনে রাখা৷ এই হলো নিদিধ্যাসন৷ এসবের  ফলে মানুষের মনে কোনো ছল-চাতুরী থাকবে না, তার মন, বাক্য ও কর্ম এক হবে৷  এরা  হবেন উত্তমস্তরের মানুষ৷ তত্ত্বভাব মানে হলো সব কিছুতে তাঁরই চিন্তা বা তাঁকেই দেখা কারণ সব কিছুর সৃষ্টি তারই থেকে হয়েছে৷ ভাবতে হবে  সবকিছুতেই তিনি অনুপ্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন৷ আর যোজনা (যোজনাৎ) মানে মনকে  সবসময় তার সঙ্গে যুক্ত  রাখা৷ অনুধ্যান ও প্রণিধ্যান এ দুইয়ের  সম্মিলিত রূপ হ’ল ধ্যান৷ অণু মানে পশ্চাৎ৷ ধ্যান করতে করতে  যখন মনে  অন্য চিন্তা এসে গেল, তখন  আবার মনকে  তাঁর চিন্তায় ছুটিয়ে  দিতে হবে৷ অর্থাৎ ইষ্ট থেকে মন সরে যাচ্ছে  কিন্তু  মন তার পিছনে  পিছনে  ছুটে চলেছে৷ তাঁকে  কোনভাবে  ছাড়বে  না---এ হ’ল অনুধ্যান৷ আর  প্রণিধ্যান হলো সবই  তারই ইচ্ছার  উপর ছেড়ে দিয়ে কেবল তারই ভাবনায় ভেসে চলা৷ এইভাবে জীবনকে গড়ে তুললে মনে খারাপ বা নেগেটিভ চিন্তা আসার অবকাশ পাবে না৷ মানুষ এইভাবে নিজের চেষ্টাতে পরমপুরুষের  সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যাবে৷ তাঁকে পেতে গেলে জীবনের  কিছু সময় অবশ্যই দিতে হবে৷ এই পরমপুরুষের  দিকে চলাই হলো মানুষের মানুষ হিসাবে  প্রকৃত পরিচয়৷ সাধনা করলেই পরমলক্ষ্য বা পরমপ্রাপ্তি লাভ হবে৷ বাবা এই সাধনা কত সস্তায় দান করে গেছেন৷ তাই আমরা এর মূল্য দিই না৷ কিন্তু  আগেকার যুগে সাধনা পাওয়ার জন্য বা গুরুর কাছ থেকে মন্ত্র পাওয়ার জন্য শিষ্যকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হতো৷ সহজে এই উন্নত সাধনা পেয়ে যাচ্ছে বলে মানুষ এই সাধনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না৷  এই সাধনা আমাদের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, এই ভাবনা আমাদের রেখে  চলতে হবে৷