জীবন-পথে কঠিন ব্রতে

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

 মানুষ পৃথিবীতে আসে সীমিত সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে ৷  শুধুমাত্র ভোজন , শয়ন , পর্যটনের মাধ্যমে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া  মানব জীবনের লক্ষ্য নয়, কারণ এই কর্মগুলিতো জীব-জন্তুরাও করে থাকে৷  তাহলে মানুষ আর জীব-জন্তুর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?  মানুষ ঈশ্বরের সর্র্বেত্তম সৃষ্টি, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হয় তার মান ও হুঁশের প্রয়োগে৷ মানুষের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধি, বিবেক ও বিচারশীলতা আর  এইসকল গুণের প্রেরণায় ও প্রয়োগে জীবনকে পরিচালিত করাই মানুষের কর্ত্তব্য ৷ এর  জন্য চাই  কঠোর ও নিবিড় অনুশীলন, আত্যন্তিকী  নিষ্ঠা৷ মানুষ যখন প্রথম ভূমিষ্ঠ হয়ে  মাতৃক্রোড়ে লালিত-পালিত হয় তখন মাতৃস্নেহে ও পরিচর্র্যয় বেড়ে ওঠে৷ পরবর্তী পর্র্যয়ে সে যখন একটু একটু করে চলতে শুরু করে,  আধো আধো বুলিতে নিজেকে প্রকাশ করতে থাকে, তখন থেকেই তাকে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলতে হয়৷  জীবনের  পথে সে যখন আরেকটু অগ্রসর হয়,  সেই পর্র্যয়ে পাঠাভ্যাস বা খেলাধূলা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও  সঠিক নিয়ম বিধি মেনেই  অধ্যবসায় ও প্রচেষ্টার দ্বারা সাফল্য লাভ করতে হয়৷  এইভাবেই এক দিকে শারীরিক সক্ষমতা ও সুস্বাস্থ্য, অপরদিকে বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে পারদর্শিতা , সাফল্য ও চরিত্র গঠনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে নিরন্তর অনুশীলনের প্রয়োজন আর তা একেবারে প্রথম থেকেই সমান তালে চালিয়ে যেতে হবে৷  এরফলেই একটি মানব শিশুরূপী কুঁড়ি ধীরে ধীরে পূর্ণ প্রস্ফূটিত পুষ্পের মতো পরিপূর্ণ সার্থক মানুষে পরিণত হতে পারে৷

মানব অস্তিত্ব ত্রিমুখী--- শারীরিক, মানসিক ও  আধ্যাত্মিক স্তরে বিন্যস্ত৷  মানবজীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে হলে  তিনটি স্তরেই সুষম উন্নতি বিধান প্রয়োজন৷ পুষ্টিকর ও প্রমিত আহার,  শরীর চর্র্চ, আসন-ব্যায়াম ইতাদির দ্বারা যেমন প্রতিনিয়ত  স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে,  সমভাবে মানসিক উৎকর্ষ বিধানের উদ্দেশ্যে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির চর্র্চ ও আধ্যাত্মিক প্রগতির জন্য ধ্যান--ধারণা -সাধনার  দ্বারা ভূমাভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নিরলস প্রয়াস  একান্ত প্রয়োজনীয়৷ বলিষ্ঠ চরিত্র গঠন ও  নৈতিক দৃঢ়তা একমাত্র আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমেই সম্ভব৷  শরীর, মন ও আত্মা তিনেরই প্রগতির জন্যে বাল্যাবস্থা থেকেই গুরুত্বসহকারে নিয়মিত অভ্যাস করতে হবে৷  এরফলেই প্রত্যেক মানুষ  সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও  দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী  হয়ে উঠতে পারে৷  সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হয় তবে সেই সমাজও  সুন্দর হয়ে উঠতে বাধ্য ৷ একটা মালার প্রতিটি ফুল সজীব, সতেজ ও সুন্দর হলে মালাটিও সুন্দর হয়৷  এই সকল মানুষের মিলনে যে সমাজ তৈরী হয় সেই সমাজে  প্রতিটি সদস্যের মধ্যে ‘‘সত্যম-শিবম-সুন্দরম্’’ এর পরিপূর্ণ প্রকাশ সম্ভব৷  মানুষের মন সর্বদা বিস্তার চায়, ক্রমাগত বিস্তৃতির মাধ্যমে বৃহতের ভাবনায় ভাবিত হয়েই  ক্ষুদ্রত্বের বন্ধনকে ছিঁড়ে ভূমাভাবে  প্রতিষ্ঠিত হতে প্রয়াসী হয়৷

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি পরিদৃশ্যমান,  তা সত্যই মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর৷  মানুষে মানুষে হানাহানি,  সংঘাত, হিংসা, নানাবিধ ভেদাভেদ , অন্যায় , অত্যাচার, শোষণ, মিথ্যাচার সমগ্র মানব সমাজকে  পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত করে চলেছে৷ এর একমাত্র কারণ মানুষের  মনের সংকীর্ণতা , ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যেকোনো হীন ও অনৈতিক  কর্মকান্ডের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ৷  বিশ্বের যাবতীয় ধন সম্পদ  ও ক্ষমতা করায়ত্ত করার সীমাহীন আকাঙ্ক্ষায় এক শ্রেণীর অর্থগৃধ্নু মানুষ  যে কোনো ধরণের কুকাজ করতে কুন্ঠাবোধ করে না৷  তাই সমাজে বেলাগাম দুর্বৃত্তায়ন,  জিঘাংসা  ও অনাচারের জয় জয়কার৷ দুর্বৃত্তসমুদায়ের প্রচন্ড উল্লাসে  সৎ ও কল্যাণকামী মানুষের দল  ভীত, সন্ত্রস্ত্র , উৎপীড়িত , নির্র্যতিত৷ সত্যনিষ্ঠা, নৈতিকতা মদগর্বীদের  কাছে অলীক কল্পনার বিষয়--- অচল পয়সার মতো মূল্যহীন৷

সমাজতত্ববিদদের মতে  সমাজে এই মাৎস্যন্যায় অবস্থার জন্য দায়ী মানবিক মূল্যবোধ হ্রাস ও নীতিহীনতা৷ আধ্যাত্মিকতার আদর্শে জীবন পরিচালিত না হলে মানব জীবনে  নৈতিকতার ভিত্তি দৃঢ় হয় না৷  সত্য ও ন্যায়ের পথে সঠিক ভাবে  চলতে গেলে আধ্যাত্মিকতাকে জীবনচর্র্যর অঙ্গীভূত করতেই হবে  আর তা শুরু করতে হবে জীবনের গোড়া থেকেই৷  একমাত্র তখনই সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, নীতিবাদ প্রভৃতি শুভবৃত্তি ও গুণাবলীর শিকড়  মনের গভীরে প্রোথিত হবে আর এই আধ্যাত্মিক চেতনা সর্র্ববস্থাতেই  মানুষকে অবিচলিত রাখতে পারবে৷

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন মুষ্টিমেয় শোষকের অত্যাচারে, অবিচারে, অনাচারে সাধারণ সৎ মানুষ শোষিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত হয়েছে ও অত্যাচারের প্রাবল্যে কোনঠাসা হয়েছে--- তখনই মরিয়া এই মানুষের দল  বিক্ষুব্ধ হয়ে বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে ও শেষ পর্যন্ত তাদের দাবী, অধিকার ও সম্মান পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে৷  অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার রাত্রি ভয়ঙ্কর হলেও  নিশাবসানে যেমন ঊষার অভ্যুদয় ও রক্তিম আকাশে  অরুণোদয় অবশ্যম্ভাবী--- তেমনই  মানব সমাজের এই বিভীষিকাময় পরিবেশও উৎপীড়িত , উপেক্ষিত ও পদদলিত মানুষের দল আধ্যাত্মিকতার শুভ উদ্বোধনের দ্বারা দুর করতে সমর্থ হবে৷  এর জন্যে সকল মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলিত হয়ে সংগ্রামে সামিল হতে হবে৷  আর এ সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে সর্ব প্রথমে আধ্যাত্মিকতাকে জীবনের আদর্শ মেনে  সত্য ও ন্যায়ের পথে অগ্রসর হতে হবে৷  আধ্যাত্মিকতাই মানুষের মনে নৈতিক বল সঞ্চার করে ও  অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায় ৷  কাজটি বাস্তবে কঠিন মনে হলেও  অনলস অধ্যবসায় ও অনুশীলনের দ্বারা এই শক্তি অর্জন অবশ্যই সম্ভব৷  আগামী প্রজন্মের জন্যে শোষণমুক্ত সুন্দর মানব সমাজ  গড়ে তোলার লক্ষ্যে  প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে আধ্যাত্মিকতা সমন্বিত  জীবন চর্র্যর মাধ্যমে  সমস্ত রকম অনাচার, অবিচার ,শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতেই হবে৷ --- এ ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই ৷ সকল মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে গঠিত এই সমাজের প্রতিটি সদস্য (মানুষ, জীব, জড়, উদ্ভিদ)  বিশ্ব পিতার সন্তান হিসেবে অস্তি-ভাতি- আনন্দমের  সুযোগ পাবে৷  আর নব্যমানবতাবাদের আদর্শে এই সমাজ রচনাই আজকের মানুষের একমাত্র লক্ষ্য৷