আগে বলেছিলুম, ভালো কাজের জন্যে জিদ্ চাই৷ তাই সাধকের মনে জিদ্ থাকা দরকার৷ শাস্ত্রে আছে, পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই সংসারে উন্নতি করে, কী তার রহস্য? দেখতে পাচ্ছি, কেউ বড় বড় কাজ করে জীবনে মহান হয়, কেউ বা শুয়ে বসেই থাকে চিরকাল৷ কেউ কেউ তো কলুর বলদ হয়েই থেকে যায়, আবার কারো কারো উন্নতি হয়৷ কেউ অনেক পড়েও খারাপ ফল করে, কেউ বা অল্প পড়েও ভাল ফল করে৷ এই সমস্ত কিছুর পিছনে রহস্য কী?
উত্তরে শিব বললেন,
‘‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷
দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷
চতুর্থো সমতাভাবঃ পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷
ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহারঃ সপ্তমং নৈব বিদ্যতে৷৷’’
দৃঢ় প্রত্যয় অর্থাৎ I must be successful in my mission, এটাও এক ধরনের জিদ্৷ যার মধ্যে জিদ্ নেই, সে একটি ভোঁদুরাম, তার দ্বারা বড় কাজ হয় না৷ তোমাদের যার মধ্যে জিদ্ নেই, সে এই জিদ্ তৈরী করে নাও৷ তা হলেই তোমাদের দ্বারা অবশ্যই বড় বড় কাজ হবে৷
সেই মানুষেরই উন্নতি হয় যে কাজ সমাপ্ত না করে বিশ্রাম করা পাপ জ্ঞান করে৷ এই ধরনের কাজ ভক্তই করতে পারে, জ্ঞানী পারে না৷ আমি কিন্তু জ্ঞানীর বিপক্ষে নই৷ তবে এসব বলছি এই কারণে জ্ঞানীর যাতে প্রকৃত জ্ঞান হয়৷ জ্ঞানীর সাধারণ জ্ঞান দ্বারা কিছু হয় না৷ যে যত বড় জ্ঞানী সে তত বড় ভীতু৷ ভাল কাজ করতে গেলে জ্ঞানীর কাছে যেওনা, পরামর্শ চেও না, সে তোমাকে নিরুৎসাহ করবে৷
যে বীর, যে বাহাদুর, তার চলার নীতি কী হবে? প্রথমতঃ তাকে মনে রাখতে হবে, ‘‘নিন্দন্তু নীতিনিপুণাঃ যদি বা স্তুবন্তু’’, অর্থাৎ আদর্শের পথ ধরে চলবার সময় যদি কেউ তার নিন্দা করে, যদি শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে হতোৎসাহ করে, প্রাজ্ঞকে তাহলে এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে কেননা, তার মনেও ওরা ভয় ঢুকিয়ে দেবে৷ আবার নীতিবাগীশরা যদি স্তুতিও করে, যদি বলে আমি তো আগেই বলেছিলুম, তোমার জয় হবে, তবু তাদের খোসামোদের দিকে তোমার তাকানো উচিত হবে না৷ তোমাকে নিন্দা ও স্তুতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে৷
দ্বিতীয় নীতি হবে, ‘‘লক্ষ্মী সমাবিশতু গৃহং গচ্ছতু বা যথেষ্টম্৷’’ ধনদেবী লক্ষ্মী যদি তোমার গৃহে আসেন তো ভালই৷ এলেও তা নিয়ে আদিখ্যেতা করবে না৷ মনে রেখো, যেখানে পাপ সেখানেই লক্ষ্মী, যেখানে সাধুতা সেখানে লক্ষ্মী থাকে না৷ পাপের পঙ্কেই লক্ষ্মীর কমল ফোটে৷ দারিদ্র্য সাধুতারই দ্যোতক৷ লক্ষ্মী যদি তোমার জীবনে আসে, তাহলে মনের মধ্যে প্রশ্ণ তুলবে, লক্ষ্মী আমার কাছে কেন এসেছে, তাহলে কি আমার মধ্যে পাপ ঢুকেছে? লক্ষ্মী সন্তুষ্ট হন বা অসন্তুষ্ট হন, তার এক কানাকড়িও মূল্য দেবে না৷ তুমি যেন কখনো লক্ষ্মীর গোলাম হবে না৷ বরং লক্ষ্মীকেই সমাজের দাসী তৈরী করো৷ তাকে পুজো করতে নেই৷ লাড্ডু পুরী খেতে, না হয় ছাতু–লঙ্কা খাবে, কিন্তু লক্ষ্মীর দাসত্ব কখনো করবে না৷
তৃতীয় নীতি হ’ল, ‘‘অদ্যৈব মরণমস্তু যুগান্তরে বা৷’’ মনে রেখো, এই সংসারে যে এসেছে সে যাবে৷ যঃ আগচ্ছতি সঃ গচ্ছতি৷ এই বিশ্বক্ষ্রহ্মাণ্ডে গতিশীলতা আছে, তাই সবাই আসে ও যায়৷ মরণের জন্যে সাধক ভয় পাবে না৷ আদর্শের জন্যে যদি আজই মরণ আসে তাও ভাল, অথবা যদি এক যুগ পরে আসে, তাও ভাল৷ নীতিনিপুণরা যে ভয় দেখায়, তাদের শাস্ত্রের ঝুলি থেকে একটা করে হুলো বেড়াল বের করে, সে দিকে তাই বীর বাহাদুর ভ্রুক্ষেপ করবে না৷
আর তার চতুর্থ নীতি হবে, ‘‘ন্যায়াৎ পথাৎ প্রতিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ’’ অর্থাৎ ন্যায়ের রাস্তা থেকে সে বিচলিত হবে না৷ যে তাকে বিচলিত করতে চাইবে তাকে লাথি মেরে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেবে৷
গুরু আছেন তিন প্রকার–প্রথম প্রকারের গুরু মিষ্ট কথায় শিষ্যকে কর্তব্যাকর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দেন৷ তিনি অধম গুরু৷ দ্বিতীয় প্রকারের গুরু শিষ্যকে কিছু কিছু শেখান ও মাঝে মধ্যে অনুচিত কর্ম থেকে নিবৃত্ত হতে বলেন৷ তিনি মধ্যম গুরু৷ আর তৃতীয় প্রকারের গুরু শিষ্যকে উচিত–অনুচিত সব ক্ষুঝিয়ে দেন৷ পরে শিষ্য অনুচিত কর্ম করলে অবস্থার চাপ সৃষ্টি করে উচিত পথে চলতে বাধ্য করেন৷
তেমনি মানুষও তিন প্রকার৷ অধম মানুষ ভয়ের জন্যে কিছুতেই মহৎ কাজে হাত লাগায় না৷ মধ্যম স্তরের মানুষ যখন সকলেই কাজ শুরু করে তখন সেও হাত লাগায়, তবে কাজে বাধা এলে রণে ভঙ্গ দেয়৷ আর উত্তম স্তরের মানুষ পদে পদে বিঘ্ণ এলেও কাজ ছেড়ে দেয় না৷ এই যে সাত্ত্বিক জিদ, এতেই সব কাজ সুসম্পন্ন হয়৷
তোমরা লক্ষ লক্ষ সাধক, ইচ্ছা করলে সব কিছুই করতে পার৷ বড় কাজ তোমাদের করতেই হবে৷ জয় তোমাদের অনিবার্য আমি কেবল বলব, Be practical, don’t be theoreticians.