গত ১৭ই ডিসেম্বর কলকাতা প্রেসক্লাবে ‘দলিত সংখ্যা লঘু উন্নয়ন পর্ষদে’র পক্ষ থেকে অসমের ‘বাঙালী গণহত্যা, আত্মহত্যা, ডি-ভোটার ও ডিটেনসন ক্যাম্পে’র ওপর এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ এই আলোচনা সভায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন অরাজনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘটনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন৷
এই আলোচনা সভায় স্বাভাবিকভাবে বক্তব্য রাখার জন্য ‘আমরা বাঙালী’র কেন্দ্রীয় সচিব বকুল চন্দ্র রায় ও আমরা বাঙালী নেতা তারাপদ বিশ্বাসও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন৷ উক্ত আলোচনা সভায় আরও যাঁরা বক্তব্য রাখেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রীমতী তিস্তা শীতলাবাদ (জেনারেল সেক্রেটারী, সি আই পি, মুম্বাই), সমরেশ ব্যানার্জী (কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি), তপোধীশ ভট্টাচার্য (গুয়াহাটি ইয়ূনিবারসিটির প্রাক্তন উপাচার্য), মিঃ মৃত্যুঞ্জয় মল্লিক (পঃবঙ্গ রাজ্য সভাপতি, পি.পি.আই) গর্গ চ্যাটার্জী ( ‘বাংলা পক্ষে’র জাতীয় সভাপতি), সর্দার আমজাদ আলি (প্রাক্তন এম.পি) জনাব খালেদ আবদুল্লা (অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস মাইনরিটি সেল) প্রমুখ৷
আলোচনাসভার দ্বিতীয় পর্বে বক্তব্য রাখেন অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী অশোক গাঙ্গুলি, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সোমনাথ চ্যাটার্জী, সিপিএম-এর বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী, ‘আমরা বাঙালী’র নেতা তারাপদ বিশ্বাস, সর্দার আমজাদ আলি (প্রাক্তন সাংসদ), ওমপ্রকাশ মিশ্র, জনাব খালেদ আবদুল্লা প্রমুখ৷ আলোচনা সভার ১ম পর্বে মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল অসমের বাঙালী গণহত্যা ও আত্মহত্যা৷ আলোচনা সভার প্রতিটি বক্তাই জানান, অসমে যে বাঙালীদের হত্যা করা হচ্ছে ও অন্যায়ভাবে ‘বিদেশী’ নামে চিহ্ণিত করার ফলে অপমানে ও হতাশায় একে একে বাঙালীরা আত্মহত্যা করছেন, অসমের বাঙালী বিদ্বেষী উগ্র আলফা ও বিজেপি শাসিত সরকার এজন্যে সমভাবে দায়ী৷ বাঙালী বিদ্বেষকে পুঁজি করে আলফাদের সাহায্যে অসমে ক্ষমতায় টিকে থাকাই বিজেপি’র লক্ষ্য৷ আমরা বাঙালীর কেন্দ্রীয় সচিব বকুলচন্দ্র রায় স্বাধীনতার পর থেকেই এ পর্যন্ত অসমে বাঙালী নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, সম্প্রতি এন.আর.সি রিপোর্ট ও ডিটেনসন ক্যাম্পে নির্যাতনের ফলে ৪২ জন বাঙালী আত্মহত্যা করেছেন৷ তিনি এর মধ্যে ২৮ জনের নাম- ঠিকানাও পেশ করেন৷ তিনি বলেন, অসমের ধুবড়ি-গোয়ালপাড়া থেকে শিলচর-বরাক উপতক্যা পর্যন্ত বিশাল এলাকা বাঙলারই অংশ ব্রিটিশ আমলে ও স্বাধীনতার সময় অসমের সঙ্গে অন্যায়ভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে৷ তাই বর্তমান অসম বাঙালীদের মাতৃভূমি৷ পরবর্তীকালে প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ থেকে যাঁরা স্বাধীনতার বলি রূপে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে এসেছেন তারাও আইনতঃ ভারতীয় নাগরিক ৷ এটা তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভারই ঘোষিত নীতি৷ তাই কোনভাবেই অসমের একটিও বাঙালী ‘বিদেশী’ নয়৷ এখানে ভিত্তিবর্ষের প্রশ্ণও ওঠে না৷ অথচ স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালীদের ওপর বিদেশী তক্মা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে ও হচ্ছে৷
আমরা বাঙালী নেতা এই নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বর্তমানে সারা উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালীদের সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান হ’ল অসমের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা সহ পূর্বভারতের সমস্ত বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে ‘বাঙালীস্তান’ গড়ে তোলা৷ ভারতের বর্তমান সংবিধানের ধারা মেনেই তা’ সম্ভব৷ এটা না হওয়া পর্যন্ত বাঙালীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবার আশা করা যায় না৷
আলোচনা সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে (১-৩০ থেকে ৩-০০) অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেন, বর্তমানে অনেকের নাম ভোটার তালিকায় থাকা সত্ত্বেও এন.আর.সি তালিকা থেকে ওই নাম বাদ গেছে৷ এ প্রসঙ্গে শ্রী গগৈ বলেন নির্বাচন কমিশন সংবিধান স্বীকৃত একটি সংস্থা৷ আর এন. আর .সি (ন্যাশান্যাল রেজিষ্টার অব্ সিটিজেনস্ অব্ ইণ্ডিয়া) সরকারের অতিরিক্ত সচিব স্তরের এক আধিকারিককে দিয়ে চালানো এক ব্যবস্থা৷ তাই ২০১৪ সালে ভোটার তালিকায় যাদের নাম ছিল তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা যায় না৷ তিনি বলেন, এই মর্মে তিনি সুপ্রিম কোর্টে ২০১৬ সালে হলফনামা দায়ের করেছেন৷ তিনি সেখানে বলেছেন, কমিশন যাকে কার্ড দিয়েছে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল হয় কী করে? তাহলে তো সংবিধান স্বীকৃত কমিশনকে উপেক্ষা করা হচ্ছে৷ গগৈয়ের দাবী, বিজেপি সরকারের আসার পর থেকেই রাজনৈতিক স্বার্থে এন.আর.সি’কে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে৷
অন্যান্য বক্তারাও স্বাধীনতার পর থেকে অসমে বাঙালী নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন ৷ আবার অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেন, অসমীয়া ও বাংলা দুটোই অসমের সরকারী ভাষা৷ তিনি চান বাঙালী ও অসমীয়া--- উভয়েই এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করুক৷
আমরা বাঙালীর তারাপদ বিশ্বাস তরুণ গগৈ-এর প্রতি প্রশ্ণ ছঁুড়ে দেন, গগৈ যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তো নেলী-হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, বাঙালীদের ওপর নানান্ভাবে নির্যাতন চলছিল---মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গগৈ তখন কী করেছিলেন৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গগৈ ‘আমরা বাঙালী’ ‘বাংলা পক্ষে’র এই সব প্রশ্ণের সদুত্তর দিতে পারেন নি৷ পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ তখন তরুণ গগৈ সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান৷ ‘আমরা বাঙালী’ ও ‘বাংলা পক্ষে’র সদস্যরা তখন তরুণ গগৈ-এর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শুরু করেন৷