মানব জীবনের লক্ষ্য কী? ঘাত–প্রতিঘাতের মাধ্যমে এগিয়ে চলতে হবে৷ সঞ্চরধারায় যে বিশুদ্ধ আত্মিক ভাব থেকে পঞ্চভূতাত্মক জড়জগতের উৎপত্তি বা প্রপঞ্চের সৃষ্টি হয়েছিল, প্রতিসঞ্চর ধারায় ওই প্রপঞ্চকে পুনরায় আত্মধাতুতে– মূলাধাতুতে রূপান্তরিত করতে হবে৷ এটাই মানবজীবনের লক্ষ্য, যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই পঁৌছে যাওয়া৷ চক্রের আবর্তন পূর্ণ করা৷ এটাই মানবজীবনের লক্ষ্য৷ পশুজীবনের লক্ষ্য জড়তার উপাসনা করা৷ মানবজীবনের লক্ষ্য কেন্দ্রে (নিউক্লিয়াসে) পঁৌছে যাওয়া৷ এছাড়া মানবজীবনের দ্বিতীয় কোনো লক্ষ্য থাকতে পারে না৷ মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আধ্যাত্মিক সাধনা করা, অন্য কোনো সাধনা নয়৷
বলা যেতে পারে, এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
যে পর্যন্ত মন ক্ষুদ্র থাকে, যে পর্যন্ত চিত্তকে অহং–এ সমাহিত করার চেষ্টা নেই, সে পর্যন্ত মানুষ বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা প্রেরিত হয়ে কাজ করবে, মানুষ স্বার্থপর হবে৷ ৰৃহৎকে যখন ধ্যেয় করা হবে তখন ক্রমশঃ স্থূল ভাবনাগুলো সূক্ষ্মে রূপান্তরিত হতে থাকবে, আর তখন তার মধ্যে ত্যাগের ভাবনা বৃদ্ধি পাবে৷ অর্থাৎ সংকল্প হবে, ‘সামূহিক কল্যাণের জন্যে বৈয়ষ্টিক স্বার্থ ত্যাগ করব৷’ মানুষ যতই সাধনার পথে অগ্রসর হবে, ততই তার মধ্যে সামূহিক ৰুদ্ধি জাগ্রত হবে, ভূমা ৰুদ্ধি জাগ্রত হবে৷ বলা হয়, যতদিন মানুষ স্বার্থৰুদ্ধি নিয়ে চলে, যতদিন মানুষ জীবভাব নিয়ে কাজ করে, ততদিন তার ধ্যেয়প্রাপ্তি– লক্ষ্যপ্রাপ্তি হয় না৷ ততদিন কী হয়? মানুষ নিজের রসপ্রবাহে প্রবাহিত হতে থাকে৷ মানুষের যে ভাবনাসমুদ্র– তা রসাত্মক, তরল প্তন্শুব্ভন্স্তুগ্গ, অর্থাৎ তুমি মনে যে ধরনের তরঙ্গ ওঠাতে চাও, সেই ধরনের তরঙ্গ ওঠাতে পারবে৷ মন ঠিক একটা তরল পদার্থের মত৷ তুমি তোমার ইচ্ছামত তরঙ্গ তৈরী করতে পারবে৷ এটা কী?– না, স্বরস, নিজের রস৷ আর পরমাত্মার যে রসপ্রবাহ তা সমগ্র বিশ্বে ব্যক্ত– প্রবাহিত৷ মানুষের বৈয়ষ্টিক রসপ্রবাহ কী? তার নিজের মনের স্বার্থকেন্দ্রিক ভাবনা– ‘আমি এটা করব, আমি ওটা করব’ –এ ধরনের ছোট ‘আমি’–কেন্দ্রিক রসপ্রবাহ৷ পরমাত্মার ক্ষেত্রে তেমনি রসপ্রবাহ অনেক বিস্তৃত৷ ওই রস কী? –না, বিশ্বকেন্দ্রিক অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের জন্যে আমি এটা করব, ওটা করব– এই ধরনের ভাবনা৷ এইজন্যে পরমাত্মার সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘রসঃ বৈ সঃ’’–পরমাত্মা রসসমুদ্র যে আস্বাদন করে– সেই হচ্ছে ‘রসিক’৷ ‘রসিক’ শব্দের এই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা৷ জীব বৈয়ষ্টিক রসে প্রবাহিত হতে থাকে৷ তাই পাতঞ্জল যোগসূত্রে বলা হয়েছে–
‘‘স্বরসবাহী বিদ্যুষোপি তথারূঢ়ো অভি নিবেশঃ’’৷
নিজের রস হচ্ছে আমিত্ব–কেন্দ্রিক বৈয়ষ্টিক, ছোট আমিকে কেন্দ্র করে৷ হতে পারে অনেক শাস্ত্র পাঠ করেছে– শিয়াল পণ্ডিতের মত৷ অনেক শাস্ত্র পড়েছে– কিন্তু মন একেবারে নরকে পড়ে আছে৷ মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত৷ শাস্ত্র যখন পাঠ করছে– এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, খুব বলবে৷ মঞ্চে খুব ভাষণ দেবে, ত্যাগ কর, এটা কর, ওটা কর, কিন্তু নিজে কিছু করবে না৷ এ ধরনের লোক হয়৷ কেন এমনটা হয়? ভিতরে ছোট আমি–কেন্দ্রিক রসপ্রবাহ, আর বাইরে লম্বা–চওড়া বুলি৷
‘‘স্বরসবাহী বিদ্যুষোপি তথারূঢ়ো অভি নিবেশঃ’’৷
‘বিদুষ’ মানে বিদ্বান৷ খুব বিদ্বান, কিন্তু ভিতরে ছোট– আমি–কেন্দ্রিক রসপ্রবাহ৷ যখন মুহূর্তের জন্যেও শাস্ত্রপড়া বন্ধ হ’ল, সঙ্গে সঙ্গে মন নরকের দিকে দৌড়তে শুরু করল৷ তাই বিদ্বান অন্যায় কাজকে অন্যায় বলে ৰুঝেও সেটাই করে যায়৷ ঘুসখোর ঘুস নেওয়া অন্যায় জেনেও ঘুস নেয়৷ চোর চুরি করা অন্যায় জেনেও চুরি করে৷ এর কারণ হচ্ছে, তার স্বরসই ত্রুটিপূর্ণ, এদিকে শাস্ত্রের জ্ঞান খুব৷ এমন তোমরা সাধারণত দেখ না? হ্যাঁ, এই ধরনের হয়৷ কোনো একজন ঘুসখোরকে জিজ্ঞেস কর, ঘুস নেওয়া ভালো কি? সে বলবে, ‘‘না, না ঘুস নেওয়া মোটেই ভালো নয়’’৷ তা সত্ত্বেও সে ঘুস নেবে৷ কেউ হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘তুমি আনন্দমার্গে আস না কেন?’’ সে উত্তরে হয়তো বলবে, ‘‘আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে৷ তার পরে আসব৷’’ এমনি হয়৷
সাধক কী করবে? নিজের স্বরসকে ব্রহ্ম–রসসমুদ্রে মিলিয়ে দেবে, লয় করে দেবে৷ এই ৰৃহৎ ব্রহ্ম–রসসমুদ্রে এই যে ছোট ছোট রসের বিন্দু– রসের বুদ্বুদ্– এ সবকে নিয়ে বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রে, নিউক্লিয়াসে, যিনি লীলা করে চলেছেন, তিনি হচ্ছেন পরমাত্মা৷ আর একেই বলা হয় কৃষ্ণের রাসলীলা৷ সাধক কী করবে? এই যে বৈয়ষ্টিক রস–বিন্দুগুলো– এগুলিকে ব্রহ্মসমুদ্রে মিলিয়ে দেবে৷ পৃথক সত্তা হিসেবে রাখবে না৷ অর্থাৎ তার ক্ষেত্রে তখন স্বরস আর পরমরস এক হয়ে যাবে৷ নিজের সমস্ত ভাবনাকে ব্রহ্মভাবনায় মিলিয়ে দেবে, ক্ষুদ্র ভাবনাকে ৰৃহৎ ভাবনায় মিশিয়ে দেবে, ভোগাত্মক বৃত্তিকে ত্যাগাত্মক বৃত্তিতে মিলিয়ে দেবে– এ হচ্ছে চরম অবস্থা৷ মানুষের কর্তব্য কী, মানুষের ধ্যেয় কী? যে প্রত্যন্ত বিন্দু থেকে জীবের উদ্ভুতি, ওই প্রত্যন্ত বিন্দুতে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া৷ এটাই জীবের একমাত্র ধ্যেয়৷ এটাই মানুষের একমাত্র কর্তব্য৷ এছাড়া মানুষের অন্য কোনো করণীয় নেই৷ কেউ যদি ভাবে, তার অন্য কর্তব্য রয়েছে, তাহলে আমি বলব, সে মানুষের শরীর পেয়েছে কিন্তু মানুষের মন এখনও লাভ করেনি৷
(আনন্দবচনামৃতম–সপ্তবিংশ খণ্ড)