মানুষের...খোঁজে....

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

ইতো পূর্বে বিবৃত তথ্য-বিচার থেকে একটা সহজ সত্য বেরিয়ে আসছে৷ অর্থাৎ জীবকুলে প্রজাতি (স্পেসিস্‌) হিসেবে---বর্তমান বিশ্বে মানুষ জাতি (জীব প্রজাতি) হচ্ছে এক একটি বিশিষ্ট অঞ্চলগত ভৌগোলিক বেষ্টনিতে, সামাজিক ঐতিহ্য পোষিত, ভাষা-সংস্কৃতি সমন্বিত ও সামাজিক অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য-স্বয়ম্ভরতা মণ্ডিত অসংখ্য জনগোষ্ঠীর সিমবায়োটিক-বৈচিত্র্যময়-সামবায়িক সমষ্টি মাত্র৷ আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে এই ধারণাটাকে বিশেষিত করা হয়৷ ব্যঞ্জনার্থক, অখণ্ড মানুষের  সমাজ ‘বোধাত্মক শব্দসমষ্টি  দিয়ে৷ আর শর্ত সাপেক্ষে প্রতিটি বিশেষিত জনগোষ্ঠীই এক একটি সমাজ৷ কিন্তু একালের ‘নেশন বা ‘আন্তর্জাতীয়তা’র স্থান এর বিপরীত মেরুতে৷ তাই এবার দেখা যাক কী কী গুণ বা বৈশিষ্ট্য বা শর্র্তবলী আধারিত জনগোষ্ঠী ‘সমাজ’ নামে  চিহ্ণিত হবে, পরিচিতি লাভ করবে৷ যেমন---

অ. এই ‘বিশেষিত জনগোষ্ঠী’ সমার্থক সমাজ পরিচয় থেকে বা নয়া ‘সমাজ’ ‘শিরনামা’ থেকে পরিষ্কার যে সমাজবদ্ধ মানুষ অন্যোন্যজীবী জীব৷ --- মানে মানুষ জাতটা পরস্পর নির্ভরতা মধ্যে দিয়ে সুষ্ঠু জীবন যাপন করতে ‘প্রকৃতি-বন্ধনে’ (ল অব্‌ দ্য নেচার্‌) আবদ্ধ৷ জগতে কেউই একা বাঁচতে পারে না, না ব্যষ্টিগত না একক গোষ্ঠীগতভাবে৷ এই সিম্‌বায়োসিস (অন্যোন্যজীবিতা) মানসিকতা ‘সমাজ’ হওয়ার গোড়ার কথা৷ বাঙলায় ‘নবশাখ’ সৃষ্টিই হয়েছিল সমাজের সিম্‌বায়োটিক্‌ স্বভাবধর্ম থেকে৷ মানে কর্ষক-ধোপা-নামিত-কামার কুমোর-তাঁতি-জেলে-ছুতোরাদি সকলেই একদিকে যেমন একের ওপর অন্যে নির্ভরশীল তেমনি সমানভাবে একে অন্যের পরিপূরকও বটে৷ কেননা নূ্যনতম প্রয়োজন মেটাতে  একে অস্বীকার করারও উপায়ও ছিল না, আজো (এই গুরুত্ব, অবদান, আবশ্যকীয়তা স্বীকার না করা হলেও) নেই৷

এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, অন্যোন্যজীবিতা ছাড়াও একসঙ্গে চলার আরো কতগুলো স্বভাবগুণ বা উপধর্ম আছে৷

একটি হল স্বয়ংক্রিয়-দায়বদ্ধতা৷ অটোমেটিক (স্বতঃস্ফূর্তভাবে) এসে যায় না করলে খাবো কী! বাঁচব কী করে! মা শিশুকে মাতৃস্তন্য পান করান--- এটাও স্বতঃস্ফূর্ত, কেউ চাপিয়ে দেয়না, করতে বাধ্য করে না৷

একটি---পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালবাসা বা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভেতরের টান৷ এগুলো না থাকলে অন্যোন্য জীবিতা, দায়বদ্ধতা আসে না৷ একটি ---একই উৎসজাত  বলে পারস্পরিক অদৃশ্য একাঙ্গীবন্ধনী টান, বা বিপরীত সত্তায়  আমিত্ব বোধ৷ অর্থাৎ অন্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া বা দেখা বা অন্যের প্রতি মমত্ববোধ৷ এটা না হলে একসঙ্গে চলার তাগিদটাই জাগে না৷

একটি---সমাজে অন্যদের অস্তিত্বে, ভূমিকায় ও তাদের  কাজের প্রয়োজনের  অনিবার্যতার স্বীকৃতি, মান্যতা ও মর্যাদা৷ এই গুণ না থাকলে ‘একসঙ্গে -চলা ’ কথাটার কোন মানেই হয় না৷ একটা সর্বোপরি একসঙ্গে চলতে গেলে শক্তি চাই৷  শক্তির ইন্ধন না থাকলে মানুষ চলবে কী করে! সামাজিক মানুষের এ শক্তি ত্রিবিধ-জৈবিক, মানসিক ও আত্মিক৷ মানুষ জৈবিক শক্তি পায় খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা রূপ নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্তির মধ্যে দিয়ে --- যা ভৌমিক বা অবস্থানগত৷ কেউ যদি না খেয়ে শুকিয়ে মরে, শিক্ষা-চিকিৎসা-মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে কেউ যদি খাদ্যের অজস্র অপচয় করে অঢেল সুখ বিলাসে অট্টালিকায় দিন কাটায়---তাহলে কী তাদের একসঙ্গে পায়ে পায়ে এক ছন্দে  চলা সম্ভব? সমাজে সকলের জন্যেই তিনেরই নিশ্চিততা, নিরাপত্তা, সুরক্ষা দরকার৷ তবেই-না ‘সংগচ্ছধবম্‌

আ. এর থেকে যে সত্য সামনে আসছে তা হ’ল ---রূঢ় বাস্তবের  মাটিতে টিকে থাকতে হলে বা উদ্বর্তনায় এগিয়ে  যেতে হলে সবাইকে নিয়ে  একসঙ্গে একই তালে একই ছন্দে চলতেই হবে৷ এক কথায় একেই বলে ‘সমাজ’ (একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে)৷ তাই তো মানুষকে বলা হয় সমাজবদ্ধ জীব৷ নেশন আন্তর্জাতিকতার মধ্যে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার জন্য পিছন থেকে ঠেলার সংবেদ বা সামনে থেকে টানার আকর্ষণ নেই৷ এ কেবল অনেককে একতাবদ্ধ করার স্বল্পায়ু কিন্তু শক্তিশালী ও ইস্যুভিত্তিক সেন্টিমেন্ট বা ভাবাবেগ মাত্র৷ অথচ সমাজ ভাবনায় পিছন থেকে ঠেলছে কে না বেঁচে থাকার ও উদ্বর্তনার তাগিদ, আর  সামনে থেকে টানছে কে না বৃহতের আকর্ষণ৷

ই. ‘সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এক সঙ্গে চলা’--- এই সমাজ-সত্য  থেকে এটাও পরিষ্কার যে-যে আসে, সে যায়৷ আর আসা -যাওয়াটা সমতালিক বা সমদর্শী নয় বা সাইক্লিকও নয়, এ হচ্ছে ক্রমবিবর্তিত ও শঙ্কিল (এভারএক্সটেন্ডিং এণ্ড স্পাইর্যাল্‌)৷ কেননা পৃথিবীর ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসই তা দেখাচ্ছে৷

ঈ. এই সঙ্গে আরও একটা সত্যের দিকে দৃষ্টি টানছে যে আসাটা হচ্ছে কোথায় থেকে, আর যাচ্ছে  বা যাবেই বা কোথায়? দর্শন, অধ্যাত্মবিজ্ঞান বা প্রকৃতিবিজ্ঞান অনুসারে উত্তর একটাই ---‘মানুষের উৎপত্তির উৎস ও তার গতির পরিসমাপ্তি একই৷ একই সত্তা থেকে সৃষ্ট হয়ে একই সত্তায় মিলে যাওয়াই প্রাকৃতিক নিয়ম৷ পৃথিবীর যত মানুষ তাদের সবার মৌলিক উপাদান হ’ল চৈতন্য সত্তা (সুপ্রীম্‌ কন্‌সাসনেস), মানুষের তথা সমাজের সঠিক চলাটার লক্ষ্যটা সব সময়ই অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে, অর্থাৎ সেই মৌলিক সত্তার দিকে৷ তাই সমাজের তো একটা স্থির লক্ষ্য আছে, বিশেষ প্রেরণায় আকর্ষণে জীব সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ কিন্তু নেশন আন্তর্জাতিকতায় তেমন কোন একলব্যের স্থির লক্ষ্য নেই, আছে শুধু স্থান-কাল-পাত্র ভিত্তিক তথা ইসু ভিত্তিক এক সঙ্গে মিলনের প্রয়াস ৷ (ক্রমশঃ)