আনন্দমার্গের পুরোধা প্রমুখ আচার্য কিংশুক রঞ্জন সরকার ধর্মমহাসম্মেলনের এই বিশাল আনন্দমার্গী সমাবেশে মার্গগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে প্রবচন দেন৷ তিন দিনই সকাল–সন্ধ্যায় তিনি প্রবচন দেন৷ ৩ তারিখ রাত্রিতে ধর্মমহাসম্মেলনের মূল প্রবচনে অর্থাৎ শেষ প্রবচনে তিনি যা বললেন তার সংক্ষিপ্তসার নিম্নে প্রদত্ত হ’ল ঃ
আমরা যে এত মানুষ এখানে বসে আছি, আমাদের মধ্যে যে পার্থক্য তা হ’ল মনের মধ্যে সংস্কারের পার্থক্য৷ সংস্কারের পার্থক্য থেকে মুক্ত হয়ে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাওয়াই আমাদের জীবনের লক্ষ্য৷ এই সংস্কার মুক্ত হতে হলে করতে হবে সাধনা৷ এই সাধনাকে ইংরেজীতে বলে ‘কাল্ট’ cult)৷ এই সাধনা পথে চলতে গেলে বহির্জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে adjustment) চলতে হবে পরাগতির দিকে৷ কেউ কেউ বলেন, পরাগতি স্বর্গে গিয়ে লাভ হবে৷ না---তা নয়৷ ‘ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম্’--- ধর্মের তত্ত্ব মনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে৷ ‘গুহা’ কথাটার একটা মানে পাহাড়ের গুহা, আর একটা মানে আমার মধ্যে যে অমিত্ব (I feeling) রয়েছে সেই আমিত্ব৷
যারা টাকা-পয়সা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সাধারণতঃ তাদের বলা হয় বিষয়ী৷ আর টাকা পয়সা হ’ল বিষয় ৷ এখন, মানসিক ক্ষেত্রে, আমাদের ইন্দ্রিয় সমূহ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ প্রভৃতি তন্মাত্র গ্রহণ করে৷
এই সব তন্মাত্রের তরঙ্গ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মনে গিয়ে পৌঁছায়৷ মনের তিনটি অংশ--- চিত্ত, অহংতত্ত্ব ও মহৎতত্ত্ব৷ তরঙ্গগুলি মনে পৌঁছলে মনের চিত্ত অংশ তন্মাত্রগুলোকে গ্রহণ করে তদ্ভাবে ভাবিত হয়৷ এক্ষেত্রে চিত্ত হ’ল বিষয়ী আর বিষয় হ’ল ইন্দ্রিয়সমূহ৷ চিত্তে বস্তুর ছাপ পড়ল (তখনকোন কিছু দেখল )৷ চিত্তে যে ছাপ পড়ল তাকে দেখে ‘অহং’ তত্ত্ব অর্থাৎ (Doer I feeling) ৷ এক্ষেত্রে অহংতত্ত্ব হ’ল বিষয়ী আর বিষয় হ’ল চিত্ত৷ মনে ‘আমি বোধ’ না থাকলে অহং কাজ করত পারেনা৷ তাই ‘আমি বোধ’ বা মহৎতত্ত্ব বিষয়ী হলে বিষয় হল অহংতত্ত্ব৷ কিন্তু ‘আমি জানি আমি আছি’--- এই যে ‘আমি জানি’ -এর আমি অর্র্থৎ জ্ঞ-সত্তা--- এই হ’ল আত্মা৷ আত্মার বিষয় হল মহৎতত্ত্ব৷ এক্ষেত্রে আত্মাবিষয়ী৷ আবার এর ওপর আর এক সত্তা আছেন যিনি ‘আমি জানি আমি আছি ’- এর জ্ঞাতা৷ তিনিই হ’লেন পরমাত্মা৷ তিনি পরম বিষয়ী৷ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটাতে হবে৷
পরমাত্মাই হলেন চরম বিষয়ী (supreme subject) আমরা যুগ যুগ ধরে তাঁরই খোঁজে ব্যস্ত৷ বিন্দু যেমন সিন্ধুতে এসে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, সিন্ধুতে এসে বিন্দুর সঙ্গে সিন্ধুর মহামিলন হয়, সেইভাবে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মহামিলন ঘটে৷ এই ক্ষণটিই হ’ল মানবজীবনের স্বর্ণিম মুহূর্ত৷
তিনি লীলা করে চলছেন, তাঁর লীলার ফলে আমরা হাসছি, কাঁদছি৷ তিনি অপেক্ষা করে আছেন কখন আমরা তাঁর কোলে এসে আমাদের হাহাকারময় জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে তাঁর আনন্দময় কোলে স্থান লাভ করি৷
এই যে মানবজীবনের চরম লক্ষ্য এ পথে চলব কীভাবে? বলা হয়েছে, ‘মহাজন: যেন গতঃ সঃপন্থা’৷ মহাজন যে পথে চলেছেন, তিনি যে পথে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদের সেই পথে চলতে হবে৷ মহাজন কারা? যাঁরা জ্ঞানকে কর্মে রূপান্তরিত করেছেন, কেবল তত্ত্ব নিয়ে থাকেননি, তাকে বাস্তবায়িতও করেছেন৷
আমাদের কাছে ‘মহাজন’ হলেন ‘গুরু’৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে---
‘‘গুর্রুরহ্মা, গুরুবিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরমবহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ’’
গুরুই সেই পথের হদিশ দেন৷ সেই পথ ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের চলতে হবে৷
শাস্ত্রে বলা হয়, ইদং তীর্থং ইদং তীর্থং
ভ্রমন্তি তামসাঃ জনাঃ৷
আত্মতীর্থং ন জানন্তি৷৷
কথং মোক্ষ বরামণনে৷
---আত্মতীর্থই প্রকৃত তীর্থ ৷৷
কীভাবে মনকে অন্তর্মুখী করে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটাবে, সেই পথই দেখিয়েছেন আমাদের পরমারাধ্য ‘ৰাৰা’৷ তিনি আমাদের কাছে ‘মহাজন’৷ পরমারাধ্য ৰাৰার প্রদর্শিত পথে চলেই আমাদের নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা করতে হবে৷
সাধনার ক্ষেত্রে ঢিলেমি করা একেবারে চলবে না৷ সময় নষ্ট করা উচিত নয়৷ সময়কে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে৷
আপনারা ঘর সংসার করে চলেছেন৷ সে কর্তব্য অবশ্যই করুন৷ কিন্তু সাধনাই জীবনের মূলকথা--- তা ভুললে চলবে না৷ ৰাৰা বলেছেন, আমরা ঘুমে জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ কাটিয়ে দিই, প্রায় এক তৃতীয়াংশ জাগতিক কর্তব্য কর্ম-করি, আর বাকি প্রায় এক তৃতীয়াংশ অপচয় করি৷ কিন্তু এই এক তৃতীয়াংশ অপচয় না করে সাধনাতে ব্যয় করার চেষ্টা করতে হবে৷ আমরা সবকিছুর জন্যে সময় দিতে পারি সাধনার জন্যে সময় দিতে পারব না কেন? উঠতে বসতে চলতে আমরা সবসময় তাঁর নাম জপ করতে পারি৷ সাধনার সময় আপনাদের কেউ বের করে দেবে না, আপনাদেরকেই সময় বের করে নিতে হবে৷ নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিত সাধনা করেই পরমপুরুষের সঙ্গে মহামিলনের আনন্দ লাভ করুন৷