প্রাচীনকালে কোনো লোক যদি অগ্ণিপরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে বেরিয়ে আসত অর্থাৎ সে যুগের সেই নিষ্ঠুর পরীক্ষাতেও দৈবলীলায় উত্তীর্ণ হয়ে আসত সেক্ষেত্রে এই উত্তীর্ণ হওয়াটাকে বলা হত ‘কোষশুদ্ধি’৷
কোনো জিনিস অযোগ্য লোকের হাতে পড়ে যদি অপব্যবহৃত হয়, তারপর সেটিকে যদি পবিত্র করা অর্থে পুড়িয়ে নেওয়া হয় তখন সেই বস্তুকেও ‘কোষশুদ্ধি’ বলা হয়৷
তখন চলছে ইংরেজ যুগের রমরমা৷ লেখক ছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কাজের তথ্য সংগ্রাহক৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বেধে গেছে৷ প্রতি মুহূর্তে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে পটপরিবর্ত্তন ঘটে চলেছে৷ লেখককে ক্রমশঃ নিতে হচ্ছে অধিকাধিক দায়িত্ব ও বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার বা অতিভার৷ সে সময়ে লেখকের যিনি চাপরাসি ছিলেন তাঁর নাম ধরো মুন্নীলাল মিশির৷ মুন্নীলালের বাড়ী ছিল এলাহাবাদে৷ কিন্তু আমাদের এখানে দীর্ঘকাল থেকে সে মুঙ্গের জেলার স্থানীয় ভাষা অঙ্গিকা বেশ রপ্ত করে নিয়েছিল৷ মুন্নীলালের ছিল অজস্র গুণ, কিন্তু দোষ ছিল দু’টি৷ মুন্নী কারণবারির খুব ভক্ত ছিল৷ অমাবস্যায় শনিবারে ও মঙ্গলবারে কালীপুজো দিয়ে কারণবারি পান না করে সে অন্ন গ্রহণ করত না৷ তার মাইনের দিনে লেখক বিশেষ ব্যবস্থার দ্বারা তাঁর স্ত্রীকে পে–ফিসের (বেতন অফিস) সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিতেন যাতে মুন্নী তাঁর পকেট–ভর্ত্তি টাকা নিয়ে বাড়ীতে যাবার পূর্বে শুঁড়িখানায় ঢুঁ মারবার সুযোগ না পায়৷ মুন্নীর স্ত্রী তাঁর অফিসের থেকে সব টাকা নিয়ে চলে যেত৷ কিন্তু মুন্নী তখন পেছনে দৌড়তে দৌড়তে বলত ঃ–
‘‘হে–গে সুমতিয়ার মায় তনিক্ কিরপা তো কর্ আই য়ে ভর কিরপা চাহয়ছী’য়ে৷’’ (ওগো সুমতির মা, একটু কৃপা তো করে যাও৷ আজকের জন্যে তোমার কাছ থেকে একটু কৃপা চাই) অর্থাৎ মুন্নী তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে কয়েকটা টাকা চাইত খাবার জন্যে৷ কিন্তু মুন্নীর স্ত্রী সুমতির মা সেই যে ছোঁ মেরে মুন্নীর পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিজের কোঁচড়ে বাঁধত তারপর একটি পয়সাও সে উপুড়হস্ত করত না৷ কিন্তু সুমতির মা সব সময় তো টাকা পাহারা দিয়ে রাখতে পারে না৷ তাই মুন্নী যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করে নিয়ে মদের দোকানে ঢুকে যেত ও কারণবারিতে গলা ভিজিয়ে ধর্ম রক্ষা করত৷
মুন্নীর দ্বিতীয় গুণ বা অবগুণ ছিল সে জাতপাত একটু বেশী করেই মানত......ছোঁয়া–ন্যাপার বিচার ছিল প্রচণ্ড রকমের৷ লেখক একদিন বলেই ফেললে–‘‘হ্যাঁরে তোর যখন ছোঁয়া–ন্যাপার এত বিচার কিন্তু তুই যে কারণবারি পান করিস ওটা কী কেবল কুলীন বামুণে ছোঁয়, না, ওটা ৭০০ জাতে ছোঁয় আবার কোনো কোনোটা তো বিদেশ থেকেও আসে, ম্লেচ্ছরাও তো ছোঁয়৷ তবে ও খেয়ে তোর জাত বাঁচছে কি? এ তো যেন জাত যায় কিন্তু পেট ভরে না’র মত ব্যাপার৷’’
ও বললে–‘‘সাহাব, আমি তো আর সোজাসুজি মদ খাই না৷ আমি তো ওগুলোকে মায়ের মন্দিরে নৈবেদ্য রূপে চড়িয়ে দিই৷ তারপর প্রসাদ হিসেবে ওটাকে কারণবারি রূপে পান করি–মদ রূপে নয়৷ প্রসাদে তো সাহাব দোষ নেই৷’’
আমি বললুম–সে কেমন
ও বললে–এই যেমন ধরুন না কত্তা, এই মায়ের মন্দিরে মণ্ডা আতপচাল নৈবেদ্য দিই৷ ওই মণ্ডা যে দুধে তৈরী হয়ে থাকে সেই দুধ যে তৈরী করে থাকে, সেই দুধটা যে এনেছিল তারাও তো আমার মত নৈকষ্য কুলীন নয় যেহেতু নৈবেদ্য চড়ানো হয়েছে তাই সেটা প্রসাদ হয়ে গেছে, সেই মণ্ডায় দোষ নেই৷
তারপর আমি বললুম–‘‘তোর যুক্তি গ্রহণযোগ্য৷’’
সে বললে–‘‘এই যে আতপ চাল, ওটা যার জমিতে হয়েছিল, যে কেটেছিল, যে কুটেছিল তারা কি আমার মত বনেদী বামুণ? নিশ্চয়ই তা নয়৷ ওই চালের মধ্যেই কি অল্পমাত্রায় জলও নিহিত ছিল না যেহেতু ওই আতপ চাল হয়ে গেল প্রসাদী তাই ওতে কোনো দোষ নেই৷ তাই দেশী হোক, বিদেশী হোক, মদ যখন পূজান্তে কারণবারিতে রূপান্তরিত হয় তখন তাতে দোষ থাকে না৷’’
একদিন মুন্নীলাল আমার এ্যালুমিনিয়ামের গেলাসটা নিয়ে গেছল অন্য কোনো অফিসারের টেবিলে৷ সে টেবিলের জনৈক মিলিটারী অফিসার তাঁকে তাঁর গেলাসটা দিয়ে এক গেলাস জল আনতে বললেন৷ সেদিন মাস পয়লা৷ সেদিন মুন্নীর মন থেকে অন্য সব চিন্তা অপসৃত হয়েছিল৷ তাঁর মাথায় কারণবারির কথাই ঘুরছিল৷ তাই সে ভুল করে আমার গেলাসে জল ভরে নিয়ে সেই সামরিক অফিসারটির টেবিলে রেখে দিলে আর তাঁর গেলাসটিতে জল ভরে রেখে দিলে আমার টেবিলে৷
আমি বললুম–‘‘মুন্নী, এ গেলাসটা তো আমার নয়৷ দেখিসনি, আমার গেলাসে স্বস্তিক চিহ্ণ আঁকা আছে৷’’
মুন্নী বললে–‘‘ভুল হোয় গেলয়’’ (ভুল হয়ে গেছে)৷
আমি বললুম–‘‘অখ্নি কী হোতেয়’’ (এখন কী হবে)?
মুন্নী সঙ্গে সঙ্গে বললে–‘‘কোষশুদ্ধি হোতেয়৷ শাস্ত্র মঁ একর বিধানোঁ ছে’’ (কোষশুদ্ধি হবে৷ শাস্ত্রে এর বিধানও আছে)৷
মুন্নী চলে গেল সেই ভদ্রলোকের গেলাসটা নিয়ে৷ কিছুক্ষণ পরে সে আমার গেলাসটা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল৷
ও বললে–‘‘কোষশুদ্ধি করীকে নানয়ছীয়ে’’ (কোষশুদ্ধি করে আনছি)৷
মুন্নী উধাও৷ খানিক বাদে যখন এল তখন তার দু’চোখে জল৷
আমি জিজ্ঞাসা করলুম–কী হোলয়......কী হোলছে (কী হল, কী হয়েছে)?
মুন্নী বলছে–জ্বরী গেলয়....জ্বরী চুকলছে (জ্বলে গেছে......গলে শেষ হয়ে গেছে)৷
আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না ও কী বলতে চায়৷ ও তখন পকেট থেকে এ্যালুমিনিয়ামের একটা ডেলা বের করে দেখালে৷
আসলে মুন্নী গেলাসটি রেখেছিল কোষশুদ্ধি করবার জন্যে ফার্ণেসের ওপরে৷ এ্যালুমিনিয়ামের গেলাস তো৷ অত উত্তাপ সহ্য করবে কেন সে গলে একটা এ্যালুমিনিয়ামের ডেলায় পরিণত হয়ে গেছে৷
আমি বললুম–শাস্ত্র মঁ একরে কোষশুদ্ধি কহয়ছে কী (শাস্ত্রে কি একেই কোষশুদ্ধি
বলে)?
যাই হোক্, তোমরা ‘কোষশুদ্ধি’ কাকে বলে বুঝে গেলে তো