আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে আমাদের জাতীয় জীবনে অধঃপতনের যে কারণ সুভাষচন্দ্র ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর তরণের স্বপ্ণ ও নোতুনের সন্ধানের গ্রন্থে তারই নির্বাচিত অংশ এখানে তুলে ধরা হল
অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, অপরিমেয় তেজ ও অদম্য সাহস লইয়া আমরা আসিয়াছি–তাই আমাদের জীবনের স্রোতে কেহ রোধ করিতে পারিবে না৷ অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যের পর্বতরাজি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াক অথবা সমবেত মনুষ্যজাতির প্রতিকূল শক্তি আমাদের আক্রমণ করুক,–আমাদের আনন্দময়ী গতি চিরকাল অক্ষুণ্ণই থাকিবে৷
আমাদের একটা বিশিষ্ট ধর্ম আছে–সেই ধর্মই আমরা অনুসরণ করি৷ যাহা নূতন, যাহা সরস, যাহা অনাস্বাদিত–তাহারই উপাসক আমরা৷ আমরা আনিয়া দিই পুরাতনের মধ্যে নূতনকে, জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে, প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং ৰন্ধনের মধ্যে অসীমকে৷ আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সময়ে মানিতে প্রস্তুত নই৷ আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালবাসি–অজানা ভবিষ্যৎই আমাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়৷ আমরা চাই ‘‘ব্ধড়ন্দ্ব ব্জন্ন্ধড়ব্ধ ব্ধপ্স প্প্ত্রন্সন্দ্ব ত্ব্প্তব্ভুস্তুন্দ্বব্জব্দ্’’ অর্থাৎ ‘‘ভুল করিবার অধিকার’’৷ তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই, আমরা অনেকের নিকট সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া৷
ইহাতেই আমাদের আনন্দ এখানেই আমাদের গর্ব৷ যৌবন বর্ষাকালে সর্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীহারা৷ অতৃপ্ত আকাঙক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটিয়া চলি–বিজ্ঞের উপদেশ শুনিবার পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই৷ ভুল করি, ভ্রমে পড়ি, আছাড় খাই, কিন্তু কিছুতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাদপদ হই না৷ আমাদের তাণ্ডবলীলার অন্ত নাই, কারণ–আমরা অবিরামগতি৷
আমারই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করিয়া থাকি৷ আমরা শান্তির জল ছিটাইতে এখানে আসি নাই৷ বিবাদ সৃষ্টি করিতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করিতে আমরা আসিয়া থাকি৷ যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামী, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সঙ্কীর্ণতা–সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই৷ আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল কণ্টকশূন্য রাখা, যেন সে পথ দিয়া মুক্তির সেনা অবলীলাক্রমে গমনাগমন করিতে পারে৷ (তরুণের স্বপ্ণ)
* * *
প্রত্যেক ব্যষ্টির বা জাতির একটা ধর্ম বা আদর্শ আছে৷ সে ঢস্তুন্দ্ব্ত্রপ্ত বা আদর্শকে অবলম্বন বা আশ্রয় করিয়া সে গড়িয়া ওঠে৷ সেই ঢস্তুন্দ্ব্ত্রপ্ত–কে সার্থক করাই তার জীবনের উদ্দেশ্য এবং সেই ঢস্তুন্দ্ব্ত্রপ্ত বা আদর্শকে বাদ দিলে তার জীবন নিষ্প্রয়োজন ও অর্থহীন হয়ে পড়ে৷ দেশ ও কালের গণ্ডীর মধ্যে আদর্শের ক্রমবিকাশ বা অভিব্যক্তি একদিনে বা এক বৎসরে হয় না৷....আদর্শ একটা প্রাণহীন বস্তু নয়৷ তার বেগ আছে, গতি আছে৷ প্রাণ–সঞ্চারিণী শক্তি আছে৷....
যুব আন্দোলনের পশ্চাতে একটি মহান্ আদর্শবাদ আছে৷ এই আদর্শবাদ নূতন হইলেও বহু পুরাতন৷ যুগে যুগে এই আদর্শবাদই প্রাণকে সঞ্জীবনী সুধায় ভরপুর করিয়া নূতন জীবন নূতন শক্তি দান করিয়াছে৷ অতি প্রাচীনকালে আমাদের দেশে মানুষ ‘ধর্মরাজ্যের’ স্বপ্ণ দেখিত৷ মানুষ তখন চাইত তখনাকার সমাজ ও রাষ্ট্র ভাঙ্গিয়া ধর্মরাজ্য স্থাপন করিতে৷ প্রাচীনকালে গ্রীসদেশে সেখানকার ঋষিরা স্বপ্ণ দেখিত ঢস্তুন্দ্ব্ত্রপ্ত‘ত্মন্দ্বহ্মব্ভত্ব্প্তন্ন্’–এর–আদর্শ প্রজাতন্ত্রমূলক সমাজের৷ তারপর যুগের পর যুগ কত মনীষী কত ব্ভব্ধপ্সহ্মন্ত্র’এর স্বপ্ণ দেখিয়া আসিতেছেন৷ কেহ লিখিতেছেন ত্ত্বন্দ্বভ্র ট্টন্ধন্দ্ব–এর কথা, কেহ লিখিতেছেন ণ্ডব্জন্দ্ব্ত্রব্ধ ত্রপ্সন্তুন্ন্দ্বব্ধম্ভ’র কথা, কেহ লিখিতেছেন অনাগত সত্য যুগের কথা৷ নানা দিক দিয়া নানাভাবে নানারূপের মধ্যে তরুণের প্রাণ, যুগের পর যুগ একটা আদর্শ সমাজের এবং আদর্শ মানুষের স্বপ্ণ দেখিয়া আসিতেছে এবং সাধ্যমত তাহা বর্ণনা করিয়া আসিবার চেষ্টা করিতেছে৷.....
আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আদর্শ প্রেম ও আদর্শ নিষ্ঠার অভাব আছে–সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই৷ এই ভাব–দৈন্যের কারণ কি কারণ এই যে যাঁহারা আমাদের শিক্ষা দেন তাঁহারা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হূদয়ে আদর্শের বীজ বপন করেন না....মানুষের প্রাণ যদি উদ্বুদ্ধ করিতে হয়–তাহার রক্ত বিন্দুর মধ্যে যদি মৃত সঞ্জীবনী সুধা ঢ়ালিতে হয়, তাহার অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তির স্ফূরণ ঘটাইতে হয় তাহা হইলে একটা মহত্তর আদর্শের আস্বাদ তাহাকে দেওয়া চাই৷....
সে আদর্শ কি–যাহার প্রেরণায় মানুষ অমৃতের সন্ধান পায়, বিপুল আনন্দের আস্বাদ পায়৷ সে আদর্শ কি–যাহার পুণ্য পরশে দেশে দেশে যুগে যুগে মহাপুরুষের সৃষ্টি হইয়া থাকে....মহাপুরুষেরা মহত্ব লাভের সম্ভাবনা লইয়াই জন্মগ্রহণ করেন৷ সন্দেহ নাই সাধনা ব্যতীত তাঁহারা সে মহত্বের বিকাশ করিতে পারেন না৷....তোমরা যদি সেইরূপ চেষ্টা ও সাধনা কর তাহা হইলে তোমরাও একদিন মহাপুরুষের আসনে বসিতে পারিবে৷ তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ভস্মচ্ছাদিত বহ্ণির ন্যায় অসীম শক্তি আছে৷ সাধনায় সে ভস্মরাশি অপনীত হইবে এবং অন্তরের দেবত্ব কোটি সূর্যের উজ্জ্বলতার সহিত প্রকাশিত হইয়া মনুষ্য সমাজকে মুগ্ধ করিবে৷.....
আমাদের জাতীয় অধঃপতনের অনেক কারণ আছে–তন্মধ্যে একটা প্রধান কারণ এই যে আমাদের দেশে ব্যষ্টির ও জাতির জীবনে প্রেরণা বা নুন্ব্ধন্ত্রব্ধন্লন্দ্ব হ্রাস পাইয়াছে৷ আমরা বাধ্য না হইলে এবং কষাঘাত না খাইলে সহজে কিছু করিতে চাই না৷ বর্ত্তমানকে উপেক্ষা করিয়া, ভবিষ্যতের পানে তাকাইয়া যে অনেক সময় কাজ করা দরকার এবং বাস্তবের দৈন্যকে অগ্রাহ্য করিয়া আদর্শের প্রেরণায় জীবনটাকে অনেক সময় হাসিতে হাসিতে বিলাইয়া দেওয়া প্রয়োজন একথা আমরা কার্যতঃ স্বীকার করিতে চাই না৷...এই জন্যে প্রেরণা বা নুন্ব্ধন্ত্রব্ধন্লন্দ্ব অভাবের দরুণ ব্যক্তি ও জাতির ইচ্ছাশক্তি পুনরায় জাগাইতে না পারিলে মহৎ কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হইবে না৷.... (নুতনের সন্ধানে)