(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘ) মহামতি গোখলে বাঙালীর মেধাবৃত্তিতে বিস্মিত হয়ে বলে ছিলেন--- ‘হোয়াট্ বেঙ্গল থিংক্স টুডে, ইণ্ডিয়া উইল্ থিংক টুমরো৷ তাঁর সহজ কথাটা হল--- বাঙালী বুদ্ধিমান জাতি৷ এই বুদ্ধিমত্তাও প্রকৃতির দান৷ বাঙলার মাটিতে উৎপন্ন শাক সবজি ও ভাত বাঙালীর প্রধান খাদ্য৷ অনেকের পাতে মাছও প্রিয়৷ পুষ্টি বিজ্ঞানীদের একটি সমীক্ষায় প্রকাশ যে ভোজন রসিক বাঙালীর প্রধান-খাদ্যের তালিকাটি বুদ্ধির পুষ্টির সহায়ক৷ অর্থাৎ বাঙালীর খাদ্যাভ্যাস বাঙালীর বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের সাহায্য করে৷ এই সঙ্গে অতিরিক্ত অবসরের সুযোগে অতিরিক্ত মনন ক্রিয়ায় অন্তর্মুখী ঘাত প্রতিঘাতে বাঙালীর বুদ্ধিবৃত্তি শানিত হয়েছে৷
ঙ) ‘পূর্র্বর্দ্র তত্ত্ব অনুযায়ী পশ্চিমভারতের মানুষদের তুলনায় পূর্ব ভারতের মানুষদের কর্মক্ষমতা কিছুটা কম, কিন্তু কর্মপটুত্বে খামতি নেই (স্মরণীয়, কর্মক্ষমতা আর কর্মপটুত্ব বা কর্মদক্ষতা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার)৷ একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে আর্দ্র জলবায়ুর অধিবাসীরা যে পরিমাণ কর্মক্ষম তার চেয়ে ঢের বেশী কর্মক্ষম শুষ্ক অঞ্চলের অধিবাসীরা৷ জলবায়ুর আর্দ্রতা ও উষ্ণতা একযোগে স্থানীয় অধিবাসীদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে কিছুটা আলস্যে প্রবণ করে দেয়৷ ভারতের সবচেয়ে উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চল হচ্ছে পূর্বভারতের অসমঞ্চল আর শুষ্কঞ্চল হল (মরুঞ্চল বাদ দিলে) উত্তর-পশ্চিম ভারতের পঞ্জাব অঞ্চল৷ তাই স্বাভাবিক অবস্থায় ভারতের পূর্ব থেকে যতই পশ্চিমে অগ্রসর হওয়া যায় ও আর্দ্রতা যতই কমতে থাকে ততই মানুষ কর্মঠ হয়৷ একারণে প্রকৃতিজাত ভাবেই সাধারণ অবস্থায় পূর্বভারতের মানুষ হিসেবে নিম্নবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের মানুষ দৈহিক শ্রমনির্ভর কঠোর শ্রমের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের থেকে পিছিয়ে৷ কিন্তু শুষ্ক জলবায়ুর কারণে পশ্চিম রাঢ়ের মানুষের কর্মক্ষমতা অনেক বেশী৷ তাই পূর্বাদ্রতত্ত্বে গুরুত্ব দিয়েও একবাক্যে একথা বলা যায়না সব বাঙালী কুর্মকুন্ঠ৷ কারণ বাঙলার প্রায় পাঁচলক্ষ বর্গ কিমি এলাকার মধ্যে উষ্ণতার ও আর্দ্রতার পার্থক্য আছে৷ কাজেই কর্মক্ষমতারও পার্থক্য আছে, বৈচিত্র্য আছে৷ আর একটা কথা হল---মানুস অভ্যাসের দাস শরীরের নাম মহাশয় যাহা সহাইবে তাহাই সয়৷ দুর্জয় ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অক্ষমতাকে জয় করা যায়, অসাধ্য সাধন করা যায়৷ বাঙালী তা বার বার করে দেখিয়েছে৷ তাছাড়া প্রতিকূল পরিবেশে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই বাঙালীকে বাড়তি শক্তি যুগিয়েছে৷ তাই তারা উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর বাধাকে জয় করে কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়েছে ও এক অনন্য বদ্বীপীয় সভ্যতার জন্ম দিয়েছে৷
চ) বাঙালীর কর্ম-চরিত্র নিয়ে কথা বলতে গেলে---১) বাঙালীর ধর্মচেতনা ও বাঙলায় বিভিন্ন ধর্মমতের সুদূর প্রসারী প্রভাবের বিষয়ে ধারণা থাকা দরকার৷ বাঙলা শৈব সংস্কৃতির দেশ৷ শৈব আদর্শের উদগাতা হলেন সদাশিব৷ সে সাত সাড়ে সাত হাজার বছর আগেকার কথা৷ বাঙলাদেশ বা বাংলা ভাষার নামকরণ তখনও হয়নি৷ নামকরণের পরিচয় পাওয়া যায় আরো দেড়-দু’হাজার বছর পর থেকে৷ কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বে ব্রহ্মপুত্র উপতক্যা - আরাকানের রাখাইন - মায়ুনদি উপতক্যা, পশ্চিমে শোন নদী, উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে চিল্কা হ্রদ-বঙ্গোপসাগর---এই সীমা বেষ্টিত ভূভাগে এক স্বাতন্ত্র্য চিহ্ণিত জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে, ও সেই সময় থেকেই ওই জনগোষ্ঠী রক্তধারায় শৈব চেতনা বহন করে আসছে৷ আর এই জনগোষ্ঠী---ওই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক ভাঙা গড়া নিরপেক্ষ বসবাস করে করে আসছে৷ শৈব ভাবনার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে আদর্শে জীবনচর্যায় জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিনেরি সমান গুরুত্ব, কিন্তু এর বাস্তবায়নে কর্মমুখরতাকে অধিক মূল্য দেয়া হয়েছে৷ অর্থাৎ ব্যষ্টি তথা সমষ্টি জীবনে কর্মবাদকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ ফলে বেঁচে থাকার অলঙ্ঘনীয় তাগিদ ও ধর্ম ভাবনার আকর্ষণে বাঙালীর মজ্জাগত হয় কর্মস্পৃহা৷ কিন্তু এই প্রবণতা ধস্তে থাকে বঙ্গসম্রাট শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে৷ ব্যাপারটা হল--- তার পর থেকেই জৈন সংস্কৃতির নৈষ্কর্মবাদ, বৌদ্ধ সংস্কৃতির ভ্রান্ত অহিংসা নীতির অবাধ নিরঙ্কুশ প্রসার, (জ্ঞান ও কর্ম বিহীন ভক্তিবাদ অদৃষ্টবাদ রূপ নেয়) তৎসহ বৈষ্ণবীয় মাধুকরী সংস্কৃতিও বাঙালীর কর্মক্ষমতাকে ক্রমান্বয়ে পঙ্গু করে দিয়েছে৷ সম্রাট শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় একশত বছর পরে পালযুগে ওই কর্মসংস্কৃতি আবার ফিরে আসলেও পরবর্তীকালে একে খাদের আরো গভীরে ঠেলেছে সম্রাট বল্লালসেনের ভাগকর, শাসন কর নীতি মাত্রাতিরিক্ত জ্যোতিষ নির্ভরতা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জাতপাতের ভেদাভেদ-কৌম সমাজকে অধঃপতিত করা ও কৌলিণ্যপ্রথার প্রচলন৷
২) মোটামুটি দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের ঢেউ আছড়ে না পড়া পর্যন্ত বাঙালী তার প্রাণধর্ম খুঁইয়ে কুঁয়োর ব্যাঙের পরিণত হয়েছিল৷ কিন্তু ঘুণ ধরতে শুরু করেছিল বল্লালী দাওয়াই-এ সেন আমল (১১৫৮ খ্রীঃ) থেকেই৷ সুদীর্ঘকালের বৈদেশিক শাসন-অপশাসনে তথা রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক পরাধীনতায় বিদেশী শাসনাধীনে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে ছিল বাঙালী৷ সেন আমলকে বাঙলার যতই অন্যতম গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হোক না কেন, পাল আমলের চারশ বছরের ও বেশী সময়ের বিরাট কর্মযজ্ঞের ঐতিহ্যকে ধসিয়ে দেয় সেন যুগ৷ তারপর কয়েকশ বছর আরবীয় আগ্রাসনে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ ইলিয়াস শাহী হুসেন শাহের হাত ধরে বাঙালী স্বরূপে ফিরতে শুরু করে কিছুটা পুনুরুদ্ধারও করে৷ কিন্তু ব্রিটিশের জড়াভিমুখী ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি এসে ‘মসীজীবী-বাক্যবাগীশ, চালাকী, ধান্দাবাজী বাবুকালচারের ও ঔপনিবেশিক আবিষ্টতায় উদ্ভূত পাশ্চাত্তের অন্ধ অনুকরণের বরফজল তার ওপর ঢেলে দেয়৷ তার ওপর কমিউনিষ্টদের সস্তায়-বিনাশ্রমে পাইয়ে দেয়ার রাজনীতি ও হাঁস মেরে ডিম খাওয়ার নীতি তাকে হিমঘরে ঢুকিয়ে দেয়৷ সেই ট্রাডিশন আজো সমানে চলছে৷ (ক্রমশঃ)