পঞ্চগৌড়ের দ্বিতীয় গৌড় বরেন্দ্রভূমি

লেখক
একর্ষি

‘ বরেন্দ্রভূমি’--- এই নামকরণে কয়েকটি যুক্তি---

(অ) বরেন্দ্র= বর+ ইন্দ্র ৷ আবার বর= ব+অ, এবং ইন্দ্র= ই+রক৷ অর্থাৎ ‘বৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রত্যয় হয় ‘বর’৷ বর মানে শ্রেষ্ঠ বা বরণ করা বা শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করা৷ সংস্কৃত ‘ইন্দ্র’ শব্দটির অর্থ শ্রেষ্ঠ৷ তাহলে বরেন্দ্র শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়াল শ্রেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ৷ আসলে বাঙলার উত্তরাংশ যা গঙ্গা বা পদ্মার বাম তীর অবস্থিত তা একদিন জ্ঞানে,বিজ্ঞানে, ধর্মে, ত্যাগে, তিতিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল৷ তাই প্রয়োগগত অর্থে বা ব্যবহারিক অর্থে অসাধারণ-অতুলনীয়-অভাবনীয়---এই বৈশিষ্ট্যের জন্যে এই ভূখণ্ডের নাম রাখা হয়েছিল ‘বরেন্দ্র’৷

(আ) দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে --- প্রাচীন অনার্য বাঙলায় ‘বরিন্দ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কৃষিযোগ্য ভাল জমি৷     ভৌগোলিক দিক থেকে এখানকার জমি তিন ভাগে বিভিক্ত,তাল, বারিন্দ ও দীয়ারা৷৷ ১. জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণের কিছু অংশ, কোচবিহার জেলার অধিকাংশ ও মালদহ জেলার কালিন্দী ও মহানন্দা নদীর নীচু ভূমি  ‘তাল’ নামে পরিচিত৷ এখানে বহু বিল ও জলাভূমি আছে৷ এই অঞ্চলই ‘তাল’ নামে পরিচিত৷ ২. দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পূর্বাংশও মালদহ জেলার পূর্বাংশের ভূমি সামান্য উঁচু-নীচু এবং প্রাচীন পলিতে গঠিত--- এই অংশের নাম ‘বারিন্দ’৷ ৩.বরেন্দ্রভূমির যে অংশ গঙ্গা বা পদ্মার গর্ভ ‘থেকে উত্থিত ও নবীন পলি দ্বারা গঠিত সে অংশের নাম ‘দীয়ারা’ (চর) ৷ --- এই কারণে ভূমি ও মৃত্তিকার চরিত্র বৈশিষ্ট্যে স্মরণাতীত কাল থেকে বরেন্দ্রভূমি সামগ্রিক ভাবে কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল৷ তাই হয়তো বাঙলার উত্তরাংশকে ‘বরেন্দ্র’ বলা হয়৷

(ই) বরেন্দ্রভুমির মধ্যে কোন কোন জায়গায় লালচে মাটি, এঁটেল মাটি বা পাথুরে মাটি রয়েছে৷ সেটা কিন্তু সাগরের বুক থেকে জেগে ওঠেনি৷ আসলে হিমালয় সৃষ্টির আগে,সমতট --- বঙ্গ সৃষ্টির আগে রাঢ়ের পূর্বে, উত্তর -পূর্বে মহাসমুদ্রে কয়েকটি বড় বড় দ্বীপ ছিল৷ এগুলো ছিল গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডেরই বিক্ষিপ্ত অবস্থা৷ পরবর্তীকালে দ্বীপগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়৷ বর্তমান মালদহ ও দিনাজপুরে এর নিদর্শন পাওয়া যায়৷

 এককালে বাঙলার উত্তরাংশে পদ্মার বাম তীরে ---দক্ষিণে মালদহ, রাজসাহী ও পাবনা, উত্তরে--- হিমালয়, ঝাঁপা, শিলিগুড়ি, গোয়ালপাড়া পূর্বে ব্রহ্মপুত্র, আর পশ্চিমে কৌষিকী (কোশী) দ্বারা বেষ্টিত অঞ্চল কে বলা হ’ত বরেন্দ্র৷ রাঢ়ের চেয়ে কিছুটা ছোট হলেও এরও ছিল দুটি ভুক্তি ---

ক) পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি---বরেন্দ্রভুমির দক্ষিণাংশ হল পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি৷ ভারতীয় উপমহাদেশে এর জেলা ভিত্তিক পরিচয় হচ্ছে যথাক্রমে বগুড়া,পাবনা, রাজসাহী, সিরাজগজ্ঞ, নাটোর,নৌওগাঁ, জয়পুর হাট, চাপাই নবাবগঞ্জ, মালদহ ও বারসই ৷

খ) কামতাপুর ভুক্তি---বরেন্দ্রভূমির উত্তরাংশ হ’ল কামতাপুর ভুক্তি৷ এখন ভারতীয় উপমহাদেশে এর জেলা ভিত্তিক পরিচয় যথাক্রমে---কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং জেলার সমতল অংশ, কিষাণগঞ্জ, ঝাঁপা,ধুবড়ি, কোকরাঝড়,গোয়ালপাড়া, রংপুর, দিনাজপুর, ও কামরূপ৷

পরবর্তীকালে কামতাপুর ভেঙে দু’ টুকরো করা হয়৷ পূর্বাংশের নাম দেয়া হয় ‘বিজনী’, আর পশ্চিমাংশের নাম কোচবিহার৷ বলাবাহুল্য,বরেন্দ্রভূমির বেশী অংশটাই বর্তমান বাঙলাদেশের অন্তর্ভুক্ত৷ (চলবে)