বিকেন্দ্রিত সামাজিক–অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অতি সহজেই কৃষি ও শিল্পের আধুনিকীকরণ করা যায় ও তার উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারও সহজে পাওয়া যায়৷ এইভাবে যদি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি আপন আপন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায় তাহলে বিভিন্ন অঞ্চলের মাথা পিছু আয়–বৈষম্য হ্রাস পাবে ও অনুন্নত অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে তাকে উন্নত অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমপর্যায়ে আনা যাবে৷ প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ ভোগ করবে৷ যখন প্রত্যেকটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আসবে তখন সমস্ত দেশই অতি দ্রুত অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করবে৷
প্রাউটের পরিকল্পনার নিয়ামক নীতি (guiding principle) হ’ল এই বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা এর অনন্য বৈশিষ্ট্য৷
প্রাউটের মতে ফলপ্রসূ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভিত্তি হবে চারটি তত্ত্ব–উৎপাদন–সম্ভাব্যতা, উৎপাদন ব্যয়, ক্রয়ক্ষমতা ও সামূহিক প্রয়োজনীয়তা৷ অন্যান্য তত্ত্ব হ’ল প্রাকৃতিক সম্পদ, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু, নদীধারা, পরিবহন ব্যবস্থা, শিল্প–সম্ভাবনা, সাংসৃক্তিক ঐতিহ্য ও সামাজিক অবস্থা৷
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সুস্পষ্ট নীতি ও নানান সংকীর্ণ সেন্টিমেন্টের প্রাধান্যের ফলে ভারতীয় অর্থনীতি আজ পঙ্গু ও গতিহীন হয়ে পড়েছে৷ মথুরা ও বারাউনীর মত জায়গায় বিশাল তৈল শোধনাগার গড়ে তোলা হয়েছে বা অন্যান্য অনেক স্থানে ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে৷ অথচ এই সব স্থানের কাছাকাছি হাজার মাইলের মধ্যে এই সব শিল্পের কাঁচা মাল নেই৷ ওই সমস্ত স্থানে সস্তা বিদ্যুৎও নেই৷ এ জাতীয় কর্ম–পন্থা শুধু দেশের সম্পদ ও কর্মক্ষমতার অপব্যবহারই নয় এতে ভারতীয় পরিকল্পনাকারীদের অজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টির অভাবই সূচিত করছে৷ এই অবস্থা মনে করিয়ে দেয় সেই ব্রিটিশ রাজত্বের কথা যখন বাংলার পাট পাঠানো হত গ্রেট ব্রিটেনের ডাণ্ডির চটশিল্পের উন্নয়নের জন্যে৷ বাংলা থেকে পাট সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাণ্ডির চটশিল্পও বন্ধ হয়ে গেল৷ যদি ডাণ্ডির চটশিল্পজাত পণ্য বাংলায় বিক্রি না হত তাহলে ডাণ্ডির চট–শিল্প দাঁড়াতে পারত না৷ বর্তমান বাংলার মৃতপ্রায় চটকলগুলিরও ওই একই অবস্থা৷ আজকাল রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া হয়, ‘‘বন্ধ চটকল জাতীয়করণ করতে হবে’’–‘‘চটকলে লক্–আউট বন্ধ করতে হবে’’৷ এদিকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা দু’হাতে টাকা লুটছে আর হাজার হাজার বেকার শ্রমিক বঞ্চনা, অনাহার ও অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে৷ বাংলায় যা চটকল আছে সেই চটকলগুলি চালানোর জন্যে যতটা কাঁচা পাটের প্রয়োজন বাংলায় ততটা উৎপন্ন হয় না৷ ফলে ওই চটকলগুলি চালু রাখার জন্যে অন্য অঞ্চল থেকে কাঁচা পাট আমদানি করতে হয়৷ যদি বাংলায় মানুষ এই পাট–শিল্পগুলি বাঁচাতে চায়, তবে পরিষ্কার ভাবে কয়েকটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে৷ প্রথমেই এই অঞ্চলে কাঁচা পাট উৎপাদনের ভিত্তিতে পাট কলগুলির সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে৷ বাকী মিলগুলিকে হয় বন্ধ করে দিতে হবে না হয় অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের কাজে লাগাতে হবে৷ যে মিলগুলি চালু থাকবে সেগুলিতে পাট জাতীয় অন্যান্য দ্রব্যাদি উৎপাদন না করে প্রধানতঃ পাট–সূতা উৎপাদন করতে হবে৷ এই পাট–সূতা, সমবায়ের মাধ্যমে কর্ষক ও তন্তুবায়দের মধ্যে বন্টন করতে হবে৷ যদি এ পন্থা অবলম্বন করা হয় তবে বাংলার সূতার বিপুল চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত সূতা অন্য অঞ্চলে রপ্তানি করা যেতে পারবে৷ যদি এই শিল্পকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় তবে এই সূতা শিল্প থেকে যে সম্পদ সৃষ্টি হবে তাতে স্থানীয় মানুষের জীবন ধারণের মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ধনী পাট ব্যবসায়ীদের ব্যাপক শোষণের অবসান হবে৷
তাই উপরিউক্ত তত্ত্বগুলির ভিত্তিতে প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের উচিত অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্যে আপন আপন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা রচনা করে তার বাস্তাবায়নে সচেষ্ট হওয়া৷ স্থানীয় অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতি পূর্ণ বিরাট বিরাট পরিকল্পনা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না৷ ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর সমস্ত দেশের কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে৷ প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নীতি অনুসারে ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে একটি সুসংগ্রথিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (co-ordinated plan) রচনা করার প্রয়োজন৷ আবার বাংলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক৷ বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া সহ সমগ্র পশ্চিম রাঢ়ের জন্যে একটি উপ–পরিকল্পনা (sub-plan) রচনা করা উচিত আবার জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, গোয়ালপাড়া ইত্যাদি অঞ্চলের জন্যেও আর একটা উপ–পরিকল্পনা রচনা করা উচিত৷ এছাড়া সমগ্র সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যেও সুষ্ঠু ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনা রচনা করতে হবে৷ এভাবেই অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে৷
ব্যবসা–বাণিজ্য ঃ
ব্যবসা বাণিজ্য, কর ব্যবস্থা ও ব্যাঙ্কিং–এর ক্ষেত্রেও প্রাউটের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বন্টন করতে হবে উপভোক্তা–সমবায়ের মাধ্যমে সরকার, ব্যবসায়ী বা বিভিন্ন স্তরের দালালদের মাধ্যমে নয়৷ এটা করা হলে মুনাফা–বাজরা কোন রকম কারসাজি করার সুযোগই পাবে না৷ প্রাউটের মতে বিভিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য যতদূর সম্ভব পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে করতে হবে৷ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীকে কর মুক্ত করতে হবে৷ আয়কর থাকবে না৷ পরিবর্তে উৎপাদনের প্রারম্ভ–বিন্দুতেই কর ধার্য করতে হবে৷ ব্যাঙ্ক–ব্যবস্থা সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে৷ কেন্দ্রীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যঙ্ক অব্যবহিত সরকার বা স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে৷ প্রাউটের উৎপাদনক্ষম অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হ’ল, সর্বোপরি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা৷ এই ব্যবস্থার সমবায় পদ্ধতি ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সহজেই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে৷