প্রাচীন ৰাঙলা পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল– রাঢ়, সমতট, ৰঙ্গ, ৰরেন্দ্র ও মিথিলা৷ মিথিলা বর্তমানে বিহারের অঙ্গীভূত৷ বঙ্গোপসাগরের বিশাল উপকূল এলাকা যাতে কোনো পাহাড়–পর্বত নেই কিন্তু যা পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর বালুযুক্ত দোয়াঁশ মাটি দিয়ে তৈরী, ও যার মধ্যে অজস্র জলাশয়, যা খাল–বিল আর শাখানদীতে সমৃদ্ধ, সংস্কৃতে সেই অঞ্চলকে বলে ‘সমতট’, কথ্য ৰাংলায় বলে ‘বাগড়ী’৷ এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদ আর সমৃদ্ধ কৃষিসম্পদে পূর্ণ৷ এইজন্যে সমতটকে বলা হত ‘‘সোণার ৰাঙলা’’, যে কারণে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন– ‘‘সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং মাতরম্’’৷
স্বাস্থ্য, সম্পদ, বাচনিকতা আর সরলতায় পূর্ণ এই সমতটের অধিবাসীরা ‘সোণার মায়ের’ ‘সোণার সন্তান’৷ কিন্তু এই কারণেই আবার এই সোণার সন্তানেরা সর্বদা অপরাজেয় জাতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে৷ গত ৫০০০ বছর ধরে সমতটের ৰাঙালীরা দুর্ধর্ষ ও অসম সাহসিক নৌবিদ্যায় পারদর্শী বলে কথিত হত৷ সমতটের মানুষরা এই আখ্যায় আখ্যায়িত হবার সম্পূর্ণ যোগ্য৷ মুঘল সম্রাট আকবর বাধ্য হয়ে এদের যুদ্ধ ক্ষমতাকে সম্মান করতেন, এমনকি ব্রিটিশ সরকার এদের যুদ্ধ নিপুণতাকে ভয় করত৷ তাই ‘সাম্প্রদায়িক রোঁয়েদাদ্’ প্রয়োগ করে ৰাঙলাকে দু’টুকরো করা হ’ল, আর এইভাবে পূর্বৰঙ্গ ও পশ্চিমৰঙ্গের মধ্যে একটা বিভেদ রেখা তৈরী হয়ে গেল৷
ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত পুঁজিপতিরা ৰাঙলার বুকে নিরন্তর অপশাসন ও শোষণ চালিয়ে এসেছে৷ সমতটের প্রচুর কৃষিজ সম্পদ, বন সম্পদ আর জল সম্পদ এই নব্য ঔপনিবেশবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে শোষিত হয়ে এসেছে৷ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ৩% এই সমতটের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকেই আসে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এর এক শতাংশও স্থানীয় এলাকার উন্নয়নের জন্যে ব্যয়িত হয় না৷ সমতটের গ্রামীণ অর্থনীতি বহিরাগতদের দ্বারা চরমভাবে শোষিত৷ সমতটের জনসংখ্যার ৬% অত্যন্ত দরিদ্র, তারা অশিক্ষিত, অপুষ্টি ও বেকারীর শিকার৷ এই অঞ্চলের ৭% কেবলমাত্র কৃষির সঙ্গে যুক্ত, আর যেহেতু এই বিপুলসংখ্যক মানুষ অনুন্নত কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাই তারা দ্রুত আর্থিক বিনষ্টির দিকে চলেছে৷ মার্ক্সবাদীরা সমতটের এই আর্থিক দুর্দশা আর অসহায়তাকেই তাদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে৷
ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরে সমতটের জাতীয় সম্পদ আর শ্রম সম্পদ স্থানীয় জনসংখ্যার কল্যাণের জন্যে কাজে লাগানো হয়নি৷ বরং তা বহিরাগতদের নিহিত স্বার্থপূর্তির জন্যে ব্যবহূত হয়ে চলেছে৷ সমতটের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে কোনো সরকারই কোনো আর্থিক পরিকল্পনা তৈরী করে নি৷ আর গরিবদের তথাকথিত ‘বন্ধুরা’ পুঁজিপতি আর সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করতে চায় না৷ তাই এক সময়ের অপরাজেয় শক্তি এই সমতট, বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও, পুঁজিপতি আর কম্যুনিষ্ট শোষণের কবলে পড়ে দ্রূত আর্থিক ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে৷
প্রতি বছর যথেষ্ট কৃষি উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মানুষ দু’বেলা অন্নের জন্যে মাথা চাপড়ায়৷ দীর্ঘ সময় যাবৎ তাদের এই দারিদ্র্যের কারণে জনসংখ্যার এক ৰৃহৎ অংশকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে হয়৷ নিজেদের দলগত স্বার্থ শক্ত করতে রাজনীতিবিদরা গ্রামের মানুষদের জন্যে ‘অন্নের জন্যে কাজ’ প্রকল্প চালু করেছে৷ ছাত্র ও যুবকদেরও এই প্রকল্পে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে৷ প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যার এক নির্দিষ্ট অংশকে ও দরিদ্র জনসাধারণকে বেকারী ভাতার নামে ‘ইজম্’–এর নামে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে৷ তারা মানুষকে শারীরিক ও আর্থিক কাজে নিয়োজিত রাখছে, আর এইভাবে এতদিন পর্যন্ত সমাজে বিপ্লবের মানসিকতাকে আটকে রেখেছে৷
সমতটকে এই রকমের অসামাজিক আর অমানবিক শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে দেওয়া উচিত নয় আর এই অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি চলতে দেওয়াও উচিত নয়৷ সমতটের মানুষকে এইসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ মহাপ্রভু চৈতন্য, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, বাঘাযতীন, আর সুভাষচন্দ্রের সমতটকে আর তার গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে এই অবলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া যায় না৷ ৰাঙলার কোনো মানুষই এটা হতে দিতে চাইবে না৷ তাই সমতটের মানুষকে আজ জেগে উঠতে হবে ও বাস্তব সত্যকে ৰুঝতে হবে, আর আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্যে তাদের নিজে থেকে এগিয়ে আসতে হবে৷ তাদের মিলিতভাবে দাবী করতে হবে ঃ ‘‘আমরা সমতটের চৌদ্দ কোটি ৰাঙালী একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলব৷ আমরা মিলিতভাবে আমাদের আশা–আকাঙক্ষার পূর্তি করব৷ আমরা এক শোষণমুক্ত ৰাঙলা চাই৷ আমরা চাই এক স্বনির্ভর সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল যার নাম ‘ৰাঙালীস্তান’৷’’
(কণিকায় প্রাউট উনবিংশ খণ্ড)