প্রাউটের দৃষ্টিকোন থেকে বাঙলায় শোষণের স্বরূপসাম্রাজ্যবাদী শোষণ

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

এরপরে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ৷ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ক্ষেত্রে শোষকরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক শোষণের কাজে লাগায়৷ প্রকৃতপক্ষে ৰাঙলার ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যুগ শুরু হয়েছে মুঘল সম্রাট আকবরের যুগ থেকে৷ ‘আইন–ই আকবরী’তে উল্লেখ আছে ৰাঙলাকে মুঘল বাহিনীতে ২৩,৩০১ সংখ্যক অশ্বারোহী, ৮,০১,১৫৯ সংখ্যক পদাতিক, ৪৪০০ সংখ্যক নৌকা, ৪২৬০টি কামান ও ১০৮টি হাতি জোগান দিতে হত৷ যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হত তা ৰাঙলাকে পূরণ করতে হত৷ বিশাল মুঘল বাহিনীকে রসদ যোগাত ৰাঙলা৷ যুদ্ধের ব্যয়–ভারের একটা বিপুল অংশ ৰাঙলার ঘাড়ে চাপানো থাকত৷ দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের মারাঠা দমনের জন্যে বিপুল যুদ্ধোপকরণের সমস্ত রসদ ও ব্যয় জুগিয়ে ছিল ৰাঙলা৷ ওই জোগান দিতে গিয়ে ৰাঙলার ঘরে ঘরে হাহাকার উঠেছিল৷ মুঘল সম্রাটের শোষণের ফলে ৰাঙলায় বহুবার দুর্ভিক্ষ ও হাহাকার দেখা দিয়েছিল ও মুঘল সম্রাটরা স্থানীয় সামন্ত রাজগণের সাহায্যে ওইসব বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করে এসেছে৷

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ

মুঘলযুগের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, সেই শোষণের প্রথম যুগটা ছিল খোলাখুলি লুঠতরাজের যুগ৷ ক্লাইভ নিজে মীরজাফরের কাছ থেকে বাৎসরিক ৩ লক্ষ টাকার জায়গীর ছাড়াও ২৩ লক্ষ টাকা নগদ নিয়েছিলেন৷ কোম্পানী ও কর্মচারীরা নিয়েছিল ৩ কোটি টাকা৷ এ ছাড়াও দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রাসাদ–সম্পদ লুণ্ঠন করে ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণ টাকা লুঠ করেছিল৷ ক্লাইভ যখন ভারত ত্যাগ করল তখন এক বিপুল পরিমাণ অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল৷

সাম্রাজ্যবাদী শোষণের পরিপূরক হ’ল রাজনৈতিক শোষণ৷ ব্রিটিশদের রাজনৈতিক শোষণ শুরু হয় ৰাঙলার ৰৃহত্তম সীমাকে টুকরো বিচ্ছিন্ন করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে ৰাঙালী জনগোষ্ঠীর মূল সংখ্যাকে কমিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে৷ যে অঞ্চলগুলি বিচ্ছিন্ন করে সংলগ্ণ রাজ্যগুলির সঙ্গে যুক্ত করা হ’ল,  সেইসব অঞ্চলের জাতীয় সম্পদগুলির অধিকার থেকেও ৰাঙলার জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা হ’ল৷ ওইসব অঞ্চলের ৰাঙালীরা কয়েক পুরুষ পরেই অৰাঙালী বলে ৰাঙলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল৷ ভারত ভূখণ্ডের অন্য কোথাও ব্রিটিশরা ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ এই নীতি প্রয়োগ করেনি৷ ৰাঙলায় অর্থনৈতিক শোষণকে চিরস্থায়ী করতে ব্রিটিশরা রাজনৈতিক অত্যাচারের পন্থা নিয়েছিল৷ ৰাঙলার মানুষ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ব্যষ্টিদের স্বেচ্ছাচারিতায় অভ্যস্থ ছিল, কিন্তু এমন ধরনের কোনো ব্যবস্থাই তারা প্রত্যক্ষ করেনি যা কিনা তাদের ব্যবসায়, বাণিজ্য রুজিরোজগার ও জীবনধারাকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল৷

এ সবেরই নীট ফল হ’ল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর–যাতে কয়েকদিনের মধ্যেই ৰাঙলার শিল্পী–কারিগর ও কর্ষক মিলে প্রায় এক কোটি লোক ধ্বংস হয়ে গেল৷ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মাত্র ২০ বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার রাজনৈতিক–র্থনৈতি শক্তি প্রয়োগ করে ৰাঙলার তুলা, রেশম, বস্ত্রবয়ন, চীনী, লবণ, লোহা, যন্ত্রপাতি, রঙ, জাহাজ শিল্প সবকিছুকে ধ্বংস করল৷ চিরকালের বিখ্যাত বস্ত্রশিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ও দুই লক্ষ মানুষের সমৃদ্ধশালী শহর ঢ়াকার জৌলুস নষ্ঠ হয়ে গেল৷ ঢ়াকার জনসংখ্যা দাঁড়াল ৪০ হাজার৷ শিল্প থেকে উৎখাত হয়ে বেকায় কারিগররা ঢ়াকা ছেড়ে জীবনধারণের প্রয়োজনে গ্রামগঞ্জে গিয়ে কৃষিকার্যকে আঁকড়ে ধরল৷ এরা জমিহীন ক্ষেতমজুর হিসেবে কৃষিতে গিয়ে ভিড় করল৷ এইভাবেই শিল্পনগরী মুর্শিদাবাদ, পাণ্ডুয়া ও অন্যান্য শহরগুলির সমৃদ্ধি ম্লান হয়ে গেল৷ শিল্পপ্রধান ৰাঙলার গ্রামগঞ্জে অসংখ্য বেকার সৃষ্টি হ’ল৷ তারা সকলেই গিয়ে ভিড় করল কৃষিক্ষেত্রে৷

ৰাঙলার শিল্পগুলিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ৰাঙলার কৃষিক্ষেত্রেও প্রবেশ করল৷ ১৭৭৯ সাল থেকে ব্রিটিশ শোষকরা জোর করে ৰাঙলার চাষীদের দিয়ে ধানী জমিতে নীলচাষ শুরু করালো৷ ইউরোপে তখন রঙের বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল৷ কিন্তু নীলচাষ করা জমিতে পরের ২/৩ বছর ধানচাষ করা যায় না৷ চাষীরা এই ক্ষতি–স্বীকার করে নীলচাষ করতে অস্বীকার করল৷ ফলে তাদের ওপর নেমে এলো ভয়াবহ অত্যাচার, পীড়ন ও হত্যা৷ প্রায় আশি বছর ধরে একটানা অত্যাচার–শোষণ ও ৰাঙলার চাষী বিদ্রোহের পটভূমিতে নীলচাষ পরিত্যক্ত হ’ল৷ নীলচাষের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশদের লক্ষ্য পড়ল ৰাঙলার পাট ও চায়ের ওপর৷ ৰাঙলা থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রধান উপায় হিসেবে তারা এই দু’টি কৃষিজ পণ্যকে প্রধান অবলম্বন করল৷