প্রাউটের দৃষ্টিকোন থেকে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

ভারত সরকারের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর উদাহরণ হিসেবে ৰাঙলার দৃষ্টান্তটা নাও৷ সেই সময়ে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনে ৰাঙলার বিধানসভায় সৃষ্ট হয়েছিল ২৫০টি আসন৷ এই ২৫০টি আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ১২০টি আসন, অ–মুসলমানদের জন্য ৮০টি আসন, ২৫টি আসন ছিল ব্রিটিশ বণিকদের জন্যে (কলকাতার ব্রিটিশ বণিকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা জন্যে), কিছু আসন ছিল জমিদারদের জন্যে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্যে আর কিছু ছিল শ্রমিক নেতাদের জন্যে৷ সব মিলে ২৫০টি আসন৷ সেই সময়ে ৰাঙলার ৪৫% অধিবাসী ছিল মুসলমান আর বাকী ৫৫% ছিল অ–মুসলমান৷ অর্থাৎ কিনা ৰাঙলার শুধু দেশটারই বিভাজন হ’ল না৷ মানসিক বিভাজনও হ’ল যার পরিণামস্বরূপ সাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে ৰাঙলা বিভক্ত হয়ে গেল৷

সাম্প্রদায়িকতা অস্বাভাবিক৷ আজ মুর্খ নেতারা, রাজনৈতিক নেতারা, এই সেন্টিমেন্টটাকেই আবার উস্কে দিচ্ছে৷ আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে যদি এটাকে ঠিক সময়ে (এটাই সঠিক সময়) সংযত না করা হয় তবে দেশটা আরও খণ্ডিত হয়ে যাবে৷

ভারত সরকারের সেই সময়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত বাস্তবপক্ষে তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল৷ ৰাঙলা দুইভাগে বিভক্ত হ’ল৷ পঞ্জাব দুই ভাগে বিভক্ত হ’ল৷ অসম দুইভাগে বিভক্ত হ’ল৷ সিন্ধু ও উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ভারতের বাইরে চলে গেল৷ সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার ফল হ’ল এটাই৷ মুর্খ নেতারা, নির্ৰোধ নেতারা এই সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারাকে সমর্থন করেছিলেন৷ ইতিহাস থেকে তাঁরা শিক্ষাও নেয় নি৷

(ব্রিটিশ) পলিসি ছিল ‘বিভেদ সৃষ্টি কর ও শাসন কর’ স্তুন্লন্স্তুন্দ্ব স্তু ব্জব্ভপ্তন্দ্বগ্গ৷ একটা দল বলত ‘‘জয় হিন্দ’’, তো আরেকটি দল বলত ‘‘তাকাশি মে হিন্দ’’৷ একদল বলত ভারতের জয় আর অন্য দলটি বলত ‘ভারত ভাগ কর’৷ তখনকার দিনে এটাই ছিল শ্লোগান৷ কোনো সুস্থ পরিবেশ ছিল না৷ এই সেন্টিমেন্টটা ভৌম সেন্টিমেন্টও ছিল না৷ এর মূলে ছিল নিছক একটা ভাবাবেগ ও হীন স্বার্থপরতা৷ এর পর থেকে ভারতবর্ষ থেকে সুস্থ রাজনীতি লোপ পেয়ে গেল৷ নেহেরু দেশ ভাগকে সমর্থন করেছিলেন কারণ তাঁর স্বপ্ণ ছিল দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া–তা সে অবিভক্ত ভারতের হোক বা বিভক্ত ভারতের হোক৷ মন্টেগু চেমসফোর্ড দেখলেন যে দলগুলি দলাদলিতে বিভক্ত৷ তিনি স্থির করতে পারলেন না কাদের হাতে তিনি ক্ষমতা অর্পণ করবেন৷ সেই সময় (সম্প্রদায়গুলির মধ্যে) পারস্পরিক বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ পারস্পরিক কোনো বোঝাপড়া ছিল না৷ সেই জন্যই তো দেশটা ভাগ হয়ে গেল৷ নতুবা ব্রিটিশরা দেশটাকে ভাগ করতে পারত না৷ উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে ভৌতিক সংহতি ও মানসিক (মানস–সামাজিক) সংহতি দু’টোই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ সংখ্যালঘুদের অধিকাংশই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি৷ আর সেইজন্য ভীত হয়ে তারা দেশকে ভাগ করতে চাইল৷ ৰাঙলা ও পঞ্জাবে হিন্দু সংখ্যালঘুরা মুসলমান সংখ্যাগুরুদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি৷ তাই তারাও এই দুই প্রদেশকে ভাগ করতে চাইল৷ এই মনস্তত্ব আজও রয়েছে৷ সেই সময়ে দেশে কিছুমাত্র রাজনৈতিক শিক্ষা বা রাজনৈতিক চেতনা ছিল না৷

প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন অনুসারে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের বলা হত প্রধানমন্ত্রী৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলে কেউ ছিল না৷ লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস থেকে মোটামুটি ভাবে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করা হত৷

ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলি ১৯৩৫–এর এই রোয়েদাদের বাইরে ছিল৷ সেই কারণের দেশীয় রাজ্যগুলির সাম্প্রদায়িক স্থিতি ভারতের বাকী অংশের চাইতে অনেক ভাল ছিল৷ কশ্মীরে সাম্প্রদায়িকতা কিছুমাত্র ছিল না যদিও সেখানে মুসলমান প্রজারা হিন্দু রাজার অধীনে বাস করত৷ অনুরূপভাবে হায়দরাবাদে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মুসলমান শাসক থাকলেও সেখানে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িকতা ছিল না৷ এর কারণ ছিল এই যে দেশীয় রাজ্যগুলি সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার বাইরে ছিল৷ ব্রিটিশের সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা সেখানে প্রযুক্ত হয় নি৷

নাগিনীরা এখন চারিদিকে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে৷ (সংগ্রাম করার) এটাই সঠিক মুহূর্ত্ত৷ এটাই উপযুক্ত মুহূর্ত্ত৷ এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ৷

                ‘‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,

                শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস৷

                বিদায় নেবার বেলা তাই ডাক দিয়ে যাই

                দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

                প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে৷’’

নাগিনীরা চারিদিকে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে৷ এই সংকটময় মুহূর্ত্তে আমরা কি শুধু শান্তির বাণী প্রচার করে যাব? না, না, না, না৷ তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে আমি এই দানবদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছি৷ তোমরা কি ৰুঝতে পারছ? ৬০ বৎসর আগে রবীন্দ্রনাথ যা বলে গিয়েছেন তা আজ এই বিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও সমান সত্য৷