প্রাউটের দৃষ্টিকোন থেকে তিন প্রকারের জীবিকা

সংবাদদাতা
পত্রিকা প্রতিনিধি
সময়
মানুষের রয়েছে তিন ধরনের জীবিকা –– শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবিকা৷ কিন্তু পশুদের জীবিকা হ’ল কেবল একটি –– শারীরিক জীবিকা৷ তাই পশুদের যদি খাবার জুটে গেল তো তারা দিব্যি খুশীতে দিন কাটিয়ে দেয়৷ কিন্তু মানুষের তেমনটি হয় না, মানুষ কেবল দু’মুঠো খাবার পেলে অর্থাৎ তার দৈহিক জীবিকার পূর্ত্তি ঘটলেই সে তৃপ্ত হতে পারে না৷ মানুষ চায় তার মনের জীবিকা পূরণ করতে, আধ্যাত্মিক ক্ষুধার আত্যন্তিকী নিবৃত্তি বা আত্মিক জীবিকারও পূর্ত্তি ঘটাতে৷ মানসিক জীবিকা বলতে এখানে কি ৰোঝান হচ্ছে? মানসিক জীবিকা হ’ল সেই সব মানসিক কর্ম যা মানুষের মনকে বিষয়ভাবে নিযুক্ত করে চলেছে৷ আর আধ্যাত্মিক বা ধার্মিক জীবিকা বলব তাকেই যা মানব মনকে ধর্মের অধিক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছে৷ আজ থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বৎসর পূর্বে এই পৃথিবী নামক গ্রহে প্রথম মানব শিশুর আবির্ভাব ঘটেছিল –– ঘটেছিল পূর্ব ভারতে পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূমিখণ্ড রাঢ়ের মাটিতে৷ যেদিন যে মানুষ পৃথিবীতে এসেছিল তারা অবশ্য পশুদের তুলনায় খুব বেশী একটা উন্নত জীব ছিল না৷ সেই নবাগত প্রায়–পশুস্বভাবের মানুষদেরও সেদিন ছিল একটিই মাত্র জীবিকা –– অর্থাৎ তাদের দৈহিক জীবিকা৷ তাদের প্রতি মুহূর্ত্তে বেঁচে থাকতে হত ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে৷ সেদিনের অনগ্রসর মানুষ তখনও কৃষি আবিষ্কার করতে পারেনি৷ তাই খাদ্যের জন্যে তাদের উদয়াস্ত শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হত বনে জঙ্গলে৷ তাদের তখন রাত্রি–দিন শুধু একটাই চিন্তা থাকত যে কীভাবে তাদের দিনের প্রয়োজনীয় খাবারটুকু তারা সংগ্রহ করবে৷ খাদ্যের খোঁজে শিকারের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ সেদিন অস্ত্রের প্রয়োজনও অনুভব করেছিল৷ মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে হাড়ের সহায়তায় অস্ত্র নির্মাণ করতে শুরু করল৷ এমনিভাবে আদিম মানুষ তাদের চলার পথে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন এক সন্ধিক্ষণে সূচনা করল অস্থি যুগের (Bone age)৷ মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রথম চরণ রূপে চিহ্ণিত হয়ে আসছে মানুষের সেই সুপ্রাচীন কালের অস্থি–যুগটি৷ কিন্তু জীবন সংগ্রামের জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরবর্ত্তীকালে মানুষের সব প্রয়োজন অস্থি–নির্মিত অস্ত্রের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না৷ তাই মানব জাতির অগ্রগতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে এল প্রস্তর যুগ৷ এই যুগে প্রস্তর নির্মিত নানা জাতীয় অস্ত্র–শস্ত্রই প্রাধান্য পেল৷ অস্থির তুলনায় প্রস্তরখণ্ড অধিকতর শক্ত, সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় মানুষ অস্ত্র নির্মাণে প্রস্তরকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করল৷ আজও রাঢ় অঞ্চলের অনেক পাহাড়ের পাদদেশে যেখানে অতি সুপ্রাচীন কালে বয়ে যেত জানা–জানা বিভিন্ন নদীর সলিল ধারা, তাদের অধুনালুপ্ত নদীবক্ষের দু’ধারে যদি খনন কাজ চালানো যায় তবে মৃত্তিকা গর্ভ থেকে উঠে আসবে প্রস্তর যুগের মানুষদের ব্যবহূত অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণের প্রত্ন–নিদর্শন৷ তারপর মানুষের অগ্রগতির তৃতীয় ধাপে এল তাম্র যুগ (Bronze Age)৷ এই যুগে ঘটল মানুষের প্রথম ধাতু নির্মিত শৈল্পিক অভিব্যক্তি, ভাস্কর্য বিদ্যার স্থূল অভিপ্রকাশ৷ তামার ধাতুতে মানুষ গড়ে তুলতে চেষ্টা করল নানা দেবদেবীর মূর্ত্তি৷ আজও রাঢ়ের ওই সব পরিত্যক্ত অখ্যাত অঞ্চলের বুজে যাওয়া নদীগুলির দু’ধারে খুঁজলে পাওয়া যাবে তাম্র নির্মিত নানা মূর্ত্তি ও ব্যবহার সামগ্রী৷ তাম্র যুগ মানুষের চলার পথকে এগিয়ে নিয়ে গেল আর এক গুরুত্বপূর্ণ যুগের সিংহদ্বারে৷ মানব সভ্যতায় সূচনা ঘটল তৃতীয় যুগের৷ এল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই লৌহ যুগ (Iron age)৷ এই যুগ মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে এনে দিল দ্রুতি ও ব্যপ্তি৷ সংগ্রামরত অগ্রসরমান মানব জাতির পূর্বপুরুষেরা এই যুগেই ঘটাল যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার –– অর্থাৎ চাকা (wheel)৷ মানুষ এই পৃথিবী নামক গ্রহে আবির্ভূত হয়েছিল আজ থেকে ১০ লক্ষ বৎসর পূর্বে, কিন্তু ৯ লক্ষ বৎসরের দীর্ঘ সময়কাল অতিক্রম করতে হয়েছিল সেদিন মানুষকে অস্থি যুগ থেকে প্রস্তর যুগ, তারপর তাম্রযুগ অতিক্রম করে লৌহ যুগে পৌঁছুতে৷ আজ থেকে ১ লক্ষ বৎসর পূর্বে মানব–জীবনে সূচনা হয়েছিল ঘটনাবহুল এই লৌহযুগের৷ এখানে তোমাদের একটা কথা বলে রাখি৷ লৌহ যুগ শুরু হবার পূর্ব সময় অবধি মানুষ কিন্তু বসবাস করত পাহাড়ের গুহায় অথবা বৃক্ষ শাখায়৷ এই সব অনুন্নত আদিম মানুষদের জীবিকাও তখন ছিল মাত্র একটি –– তাদের শারীরিক জীবিকা৷ যদিও তারা তখন অল্প–স্বল্প ভাবনা–চিন্তায় নিজেদের বৈয়ষ্টিক শক্তিকে নিয়োজিত করতে শুরু করেছিল, তবু মুখ্যতঃ তাদের কর্ম ও ভাব–ভাবনাগুলি ছিল দেহ–কেন্দ্রিক৷ তাই তারা ছিল একটি মাত্র জীবিকা–নির্ভর৷ তাদের জীবন অতিবাহিত হয়ে যেত খাদ্য সংগ্রহ করতে, খাবার তৈরী করতে ও উদরের পূর্ত্তি ঘটাতে৷ মানসিক জীবিকা বলতে তাদের তখন যতটুকু অভিব্যক্তি ঘটত সেগুলি কেবলমাত্র লোক–নৃত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ আজকের মানুষের শুণতে হয়ত কেমন লাগবে তবু তোমাদের জানিয়ে রাখি যে সেই অনগ্রসর আদিম সমাজে মানুষের যতগুলি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটেছিল তাদের মধ্যে মই–য়ের (Ladder) ব্যবহারও ছিল একটি৷ বৃক্ষশাখায় বাঁধা কুটীরে মানুষকে দিনে রাতে নানা প্রয়োজনে ঘন ঘন উঠতে নামতে হত৷ সেই প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ সেদিন মই আবিষ্কার করেছিল৷ পরবর্ত্তী কালে এই মইয়েরই পরিবর্ত্তিত সংস্করণ রূপে কর্ষকরা কৃষিক্ষেত্রে শক্ত মাটির ঢ়েলা গুড়ো করতে বা জমিকে সমান করে গড়ে তুলতে মই–য়ের ব্যবহার শুরু করেছিল৷ আজও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কর্ষকরা জমিতে হলকর্ষণের সময় মইয়ের ব্যবহার করে থাকেন৷ আরও পরবর্ত্তীকালে মানুষ আবিষ্কার করল তাদের সমাজ ও সভ্যতা গড়ে ওঠার পথে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটিকে অর্থাৎ কৃষি পদ্ধতিকে৷ কৃষির মাধ্যমে মানুষ খড় উৎপাদন করল ও তার ব্যবহারও শুরু করল৷ মাটির বুকে খড় দিয়ে তারা বাসা বাঁধতে শুরু করল৷ ধীরে ধীরে মানব মনীষা আয়ত্ত করল বাস্তু–বিজ্ঞান, তারা শুরু করল গৃহ–নির্মাণ৷ কৃষির আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরাও নিজেদের পছন্দ অনুসারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করল৷ সেই সঙ্গে তাঁদের জীবনে এল কিছুটা স্থিতি ও নিরাপত্তা৷ জীবনে তাঁদের এই যে স্থিতি ও নিরাপত্তার স্বস্তিৰোধ জাগল তারই অবকাশে মানুষ দৈহিক ও মানসিক জগতের অধিক্ষেত্রকে অতিক্রম করে আরও সূক্ষ্মতর ও ঊর্দ্ধতর লোকের কথা ভাবতে শুরু করল৷ এমনি ভাবে মানুষ তার মনোজগতে ভাবতে ও অনুভব করতে শুরু করল আধ্যাত্মিক প্রয়োজন পূর্ত্তির বিষয়টি৷ আজ থেকে অনুমানিক ১৬,০০০ বছর পূর্বে মানুষের চেতনার পরিভূতে নেমে এল দূত্যিময় এক অধ্যাত্মৰোধ৷ সেই থেকে মানুষের জীবনে তৃতীয় মাত্রাটিও যুক্ত হ’ল যার নাম আত্মিক জীবিকা৷ মানুষ পরমতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা–ভাবনা শুরু করল৷ এল দর্শনের কিছু কিছু তাত্ত্বিক ধারণা৷ এভাবে ক্রমে লিখিত হ’ল বেদের আরণ্যক ও উপনিষদের অংশগুলি৷ প্রায় একই সময়ে নানামুখী কর্মৈষণার ধারা বেয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমূলক কাজেও দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করল৷ শারীরিক শক্তিতে যাঁরা ছিলেন যথেষ্ট বলবান তাঁরা দায়িত্ব নিলেন, গ্রাম বা জনগোষ্ঠীর ধনপ্রাণ ও নিরাপত্তা রক্ষার৷ আর যাঁরা সূক্ষ্মতর শৈল্পিক দক্ষতার কিছুটা পরিচয় দিতে সক্ষম হলেন তাঁরা মৃৎপাত্র নির্মাণ, হস্তশিল্প, বস্ত্রবয়ন বা ওই ধরনের ভিন্ন ভিন্ন কাজে দক্ষ হয়ে উঠলেন৷ এভাবে বৃত্তি–নির্ভর শ্রম–বিভাজন ঘটলেও তখনও এই বিভাজনের ভিত্তিতে সমাজে কিন্তু জাতিবাদের (casteism) উদ্ভব ঘটেনি৷ লৌহ যুগে মানুষেরা অধিকতর বৈজ্ঞানিক প্রণালী প্রয়োগ করে এগিয়ে চললেন কৃষি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে৷ তারা নানা ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নির্মাণ করতে শুরু করলেন৷ মানুষের চাকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে গো–শকটের ব্যবহারও সমাজে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না৷ সেই অনগ্রসর সমাজের প্রায়ান্ধকার যুগে যে সব মহান ব্যষ্টি তাঁদের চিন্তাশক্তি, বৈদূর্য ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভাবলে চাকা বা গো–শকট জাতীয় এক একটি জিনিস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সমাজের সাধারণ মানুষ তাঁদের গভীর শ্রদ্ধায় ‘মহাত্মন’ নামে অভিহিত করতে শুরু করলেন৷ আজ যাঁরা পুরুলিয়া বা রাঢ় অঞ্চলে ‘মাহাতো’ উপাধি ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা আসলে অতীতের সেই উন্নত–ধী মানুষেরই ভবিষ্যৎ বংশধর৷ প্রাচীনকালের সেই ‘মহাত্মন’ শব্দ থেকেই আজকের ‘মাহাতো’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে৷ অনেকে ভাবেন যে মাহাতোরা হয়তো বা স্বতন্ত্র কোন জাত (caste)€ তাঁদের এ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল মাহাতোরা কোন ‘জাত’ নয়, মাহাতোরা তাঁদের অতীতের প্রতিভাধর জ্ঞানোদীপ্ত পূর্বপুরুষ মহাত্মনদেরই বর্তমান বংশধর৷ এভাবে জাত–পাতের ভাবধারা মনে ঢুকিয়ে সমাজের মানুষদের খণ্ড–বিখণ্ড করে রাখার বিভেদমূলক প্রথাটাই সম্পূর্ণতঃ যুক্তি বিবর্জিত ও মানবতাবিরোধী৷ যাইহোক, বর্তমান যুগের মানুষেরা অধিক থেকে অধিকতর হারে মানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবিকাতেই নিজেদের আত্মনিয়োগ করে চলেছেন৷ ভবিষ্যতে তাঁদের এই মানসিক জীবিকা ও আত্মিক জীবিকার প্রতি ঝোঁকটা আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে৷ ভবিষ্যতে আনন্দমার্গ কিন্তু কখনও কাউকে জোর জবরদস্তি করে মার্গের দর্শন ও আদর্শের পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে না৷ আমাদের সংঘ সব মানুষকে নিঃস্বার্থ সেবা, ত্যাগ, সাধনা, নৈতিক আচরণ ও সর্বাত্মক জ্ঞান অর্জনের জন্যে নিরলসভাবে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে৷ আনন্দমার্গ এক সর্বকৌণিক ও সুসংহত জীবনধারা৷ মার্গের প্রদত্ত আধ্যাত্মিক অনুশীলন পদ্ধতি যে জপ–ধ্যান বা ধারণা ইত্যাদি শিক্ষা দেয় সেগুলিই হ’ল আত্মিক বা ধার্মিক জীবিকা৷ এমনিভাবে চলার পথে মানুষ তাদের জীবনকে শত বাধা–বিপত্তি অতিক্রম করে চরম চরিতার্থতার শীর্ষ বিন্দুতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷ তার অস্তির জন্যে দৈহিক বা ভৌতিক স্তরে তাকে নানাভাবে আপন শক্তিকে নিয়োজিত করতে হচ্ছে৷ ভৌতিক স্তরে মানুষের টিঁকে থাকার এই যে প্রয়াস একেই বলছি শারীরিক জীবিকা৷ মানস ভূমিতে নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর যে জিজ্ঞাসা, মনন বা চিন্তন ঘটে চলেছে সেগুলি হ’ল তার মানস–জীবিকা আর ধ্যানে–জপে, ধারণায় অথবা প্রত্যাহার যোগে মানুষের যে চরম আধ্যাত্মিক অধিক্ষেত্রে পৌঁছুবার অন্তর্মুখী একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা সেগুলি হ’ল তাঁর আত্মিক–জীবিকা৷ এই তিন ধরনের জীবিকার সাহায্যেই মানুষ বেঁচে আছে, তার বিস্তার ঘটাচ্ছে ও পরিণামে চরম সম্প্রাপ্তিতে নিজেকে মনুষ্যত্বের গৌরবোজ্জ্বল স্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছে৷ সব মানুষেরই উচিত তাদের বৈয়ষ্টিক সামূহিক জীবনে এই জীবিকা–ত্রয়ের যথাযথ ও সুসন্তুলিত সম্প্রয়োগ ঘটানো৷