প্রাউটই হ’ল মানব মুক্তির একমাত্র পথ

লেখক
নিরপেক্ষ

আজ আমরা যাকে চরম শত্রু হিসাবে মনে করে অত্যাচার করেছি–কাল তাঁর মৃত্যুর পর বর্ত্তমানের প্রেক্ষিতে তাঁকে স্মরণ করি ও তাঁর আত্মত্যাগের বিচার বিশ্লেষণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই৷ আপেক্ষিক জগতে এটাই আপেক্ষিকতার দৃষ্টিতে একটা আপেক্ষিক মূল্যায়ণ৷ প্রসঙ্গত বলি, অতীতে মানুষের কল্যাণে যীশু হতভাগ্যদের সঙ্গে থেকে তাদের সঙ্গ দিয়ে যে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজ করেছিলেন, তার জন্যে তাঁকে দুর্বিনীত হেরড্ রাজার অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে৷ আর দুর্বল বিচারক পাইলেনের হাতে মিথ্যা বিচারের প্রহসনে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করতে হয়৷ আজ সেই আত্মত্যাগী তরুণ মানব দরদী যীশু লক্ষ লক্ষ মানুষের পরম আশ্রয়৷ আর ‘ক্রুশ’ পবিত্র প্রতীক হিসাবে খ্রীষ্টানদের কাছ অতি মূল্যবান৷

এই তো সেদিনের কথা মহান মার্গ গুরুকে হত্যা করার জন্যে মিথ্যা হত্যাকাণ্ডের মামলায় জড়িত করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়৷ তাঁকে চিকিৎসকের দ্বারা চিকিৎসার অজুাতে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় শাসককুল৷ বেসরকারী তদন্ত কমিশন সেটা তদন্ত করে জানতে পারেন৷ মহান অধ্যাত্ম পুরুষ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সেই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে কারাগারে দীর্ঘ ৫ বছর ৪ মাস ২ দিন অনশনে কাল কাটান৷ তিনি ছিলেন মহাসম্ভূতি তাই তাঁর কাছে এটা ছিল এক রহস্যময়ী লীলা বিশেষ৷ মানব কল্যাণে মানুষকে চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষা দানে তিনি এই লীলা করেন৷ তিনি বলতেন –‘‘ন্ন্দ্বব্ধ ব্দব্ভন্দ্রন্দ্রন্দ্বব্জ্ ত্ব্ন্দ্ব ব্ধড়ম্ভ ব্দব্দন্দ্বব্ধ, ব্দব্ভন্দ্রন্দ্রন্দ্বব্জ্ ভ্রন্প্তপ্ত ড়ন্দ্বপ্তহ্ম ম্ভপ্সব্ভ ব্ধপ্স ন্দ্বব্দব্ধ্ত্রত্ব্প্তন্ব্দ্ ত্র্ত্রস্তুলন্হ্মব্জ্ত্র ত্র্ত্রপ্প্ত্রন্দ প্সব্জ ত্ম্ত্রন্দ’’

যারা সেদিন পরমারাধ্য বাবাকে হত্যা করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল আজ তারা নেই৷ মহাকালের নিষ্ঠুর বিধানে তারা ইহলোক ত্যাগ করেছে এমনকি সেই সেদিনের নিষ্ঠুর ভয়ংকর সরকারও শেষ হয়ে যেতে বসেছে৷ অতীতের চরম অত্যাচারী স্বৈরাচারী শাসকরাও গত হয়েছে কিন্তু পৃথিবী হতে আজও সেই দম্ভ, স্বৈরাচারী, মিথ্যাচারিতা বন্ধ হয়নি৷ এই ধরণের নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার পৃথিবীতে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে যদি সৎ নীতিবাদী মানুষের সংখ্যা বাড়ে৷

বর্ত্তমানে সমাজ চরম ভোগ লালসা, উচ্ছৃঙ্খলতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে৷ এর পশ্চাতে কাজ করে যাচ্ছে অর্থলোভী বৈশ্য সমাজ অর্থাৎ ব্যবসাদার ধনী ব্যষ্টিরা কারণ তারাই আজ সমাজকে তাদের অর্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে৷ আজকের গণতন্ত্র সেইসব ধনী ব্যষ্টিদের অঙ্গুলীহেলনে উঠছে আর বসছে৷ তাই গণতন্ত্র মূলতঃ ধনী বৈশ্যশ্রেণীর ‘পাপেট’ ছাড়া কিছু নয়৷ গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করে রেখেছে ধনীরা৷ তাই গণতন্ত্র মানুষের সার্বিক কল্যাণে ব্যর্থ৷ গণতন্ত্র তখনই মানুষের কল্যাণ করতে সক্ষম হবে যখন সমাজের অধিকাংশ মানুষ সৎ নীতিবাদ, সুশিক্ষিত হয়ে উঠবে৷ যারা ব্যষ্টি স্বার্থের কথা চিন্তা না করে, দলের স্বার্থকে বড় করে না দেখে দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা ভাববে৷ সেটা হচ্ছে না বলে তো গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সমালোচনা, বিচার বিশ্লেষণকে, সত্যকে ভয় পায়৷ তাই তারা প্রচার যন্ত্র, শিক্ষা, শাসনব্যবস্থাকে এমনকি বিচার ব্যবস্থাকেও পঙ্গু করে নিজেদের কুক্ষিগত করতে শাসন ক্ষমতাকে অপপ্রয়োগ করে থাকে৷ তাই দেখা যায় দীর্ঘ বছর যে দল গণতন্ত্রের শাসনে থাকে তারা চরম অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে৷ আজ শিক্ষাক্ষেত্র সম্পূর্ণ রাজনীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সেখানে ক্যাডার তৈরীর আঁতুরঘরে রূপান্তরিত করেছে শিক্ষাক্ষেত্রকে৷ তাই তো এদেশের গণতন্ত্রে ছাত্রছাত্রারা শিক্ষকের গায়ে হাত দেয়৷ উপযুক্ত শিক্ষাবিদরা স্থান পান না শিক্ষাক্ষেত্রে৷ দলীয় শাসকগণ দলের স্বার্থে  দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ করে শিক্ষাক্ষেত্রে৷ তাই শিক্ষাকে রক্ষার স্বার্থে যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার দাবী তোলা হয় সেটাকে তারা সহ্য করতে পারে না৷ এটা স্বৈরাচারিতার এক ভয়ংকর অকল্যাণকর নজির৷ সব কিছু যা ভালো সেটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই অবস্থায়৷

আলোচনা প্রসঙ্গত চলে আসে এই পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রণ্টের  শাসন ব্যবস্থা৷ এখানকার জনগণ অনেক আশা করে বামফ্রণ্টকে শাসনে নিয়ে আসে৷ কিন্তু দেখা গেল তারা গণতন্ত্রের মইয়ে চেপে শাসনে এলো কিন্তু ধীরে ধীরে নিজ রূপ ধারণ করল, চরম রাজনৈতিক অত্যাচার ও স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে৷ বামফ্রণ্টের প্রতি প্রথম দিকে গরীব মানুষদের সমর্থন ছিল, তারা আশা করে ছিল এবার হয়তো তারা বাঁচার সুযোগ পাবে কিন্তু দেখা গেল কিছু বছরের পর বলদর্পী, অহংকারী শাসককুল ব্যষ্টি দলগত স্বার্থকে এমনই বড়ো করে দেখতে লাগলো আর প্রচার, শিক্ষা দফতর, পুলিশ প্রশাসনকে অকেজো করে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাতে লাগল যা কহতব্য নয়৷ জ্যোতি বসুর আত্মম্ভরীতা, কুৎসিত ভাষা, অসংলগ্ণ কথা মানুষকে মর্মাহত করলো৷ বামফ্রণ্টও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ও তাঁর সংঘটন আনন্দমার্গের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালাতে থাকে৷ কলকাতার উন্মুক্ত রাস্তায় মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ১৭ জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের নির্মম ভাবে হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সরকার৷ কারণ একটাই তা হলো ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের জাগরণ ঘটায় আনন্দমার্গ৷ এরা প্রকৃত  সৎ   নীতিবাদী মানুষদের ভয় পায় কারণ জড়বাদই হ’ল তাদের ধ্যানজ্ঞান৷ প্রবল জনরোষে পড়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়৷ এই কাজে অবশ্যই স্মরণীয় বর্ত্তমান তৃণমূল সরকারের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা৷ পরিবর্তন এলো কিন্তু পরিবর্ত্তনকে ধরে রাখতে যে নিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য্য, সংযম দরকার সেটার অভাবে আজ পশ্চিমবঙ্গ যেন ছন্নছাড়া একা কোন কিছু থেমে থাকে না৷ মহাকাল–এর কালচক্র এগিয়ে চলে৷

শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারত তথা সারা পৃথিবীতে এক ভয়ংকর পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে সমগ্র মানব সমাজ৷ আর যারা পৃথিবীতে যেটার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সেটা হলো সৎ নীতিবাদী মানুষের যে মানুষ৷ এর চিন্তা ভাবনা হবে মানবতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ মানুষ মানুষকে ভালবাসবে অন্তরের সঙ্গে৷ জাতপাতের ঊর্দ্ধে উঠে সবাইকে সেই মহান স্রষ্টার সন্তান হিসাবে মান্যতা দেবে৷ নারী জাতিকে উপযুক্ত মর্যাদা দেবে৷ সকল কুসংস্কারের ঊর্দ্ধে উঠে মনে প্রাণে মেনে নেবে – সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই৷ আজ দলাদলি, সাম্প্রদায়িকতা নয়, পৃথিবী এগিয়ে চলেছে তাই বিশ্বৈকতাবাদকে সর্বাগ্রে যেমন প্রাধান্য দিতে হবে বৃহতের কল্যাণে, ঠিক তেমনই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে মেনেই আঞ্চলিকতাকে মান্যতা দিয়ে সার্বিক উন্নতির চিন্তাভাবনা করতে হবে জাতপাতের ঊর্দ্ধে উঠে৷ তাই মানুষের সমাজের আদর্শ হোক বাঁচ আর অপরকে বাঁচতে দাও৷ এরই জন্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে৷ শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার আদর্শকে মনে প্রাণে মেনে নিয়েই প্রাউট (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বকে) অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে৷ প্রাউট হ’ল এই বর্ত্তমান যুগের আলোকবর্ত্তিকা৷ মানুষ আজ আর কেউ ছোট বড়ো নয়৷ সবাই তাঁরই সন্তান৷ এর সাথে সাথে পৃথিবীর সকল জীবজন্তু গাছপালাকে রক্ষার দায় নিতে হবে মানুষকে৷ উৎপাদন ও বণ্টনে ধীরে ধীরে সমবায়কে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে কারণ এটাই মহাকালের নির্দেশ৷ আজ শোষণের ওপর সমৃদ্ধির শ্লোগান অচল৷ শ্রমিক ও কর্ষকদের যেমন অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, তাদের সুযোগ দিতে হবে সমৃদ্ধির সার্থকতার ঠিক তেমনই এর বাইরে যারা আছে সেই সব মানুষকে নিজ নিজ সামর্থ্যকে মান্যতা দিয়ে তাদের সার্বিক কল্যাণের কথা মানতে হবে৷ তবেই সার্থক সমাজ গড়ে উঠবে৷ তাই সার্বিক শোষণমুক্তির আন্দোলনই হ’ল বর্ত্তমান সমাজের চলে চলার পথ৷

মনে রাখতে হবে মানুষ অমৃতের সন্তান৷ নারী ও পুরুষ সবাই ঈশ্বরের অতিপ্রিয়৷ কোনটাই হেয় নয়৷ পৃথিবীতে প্রকৃত সার্বিক কল্যাণের জন্যে সমাজ আন্দোলন জরুরী৷ মানুষের পরিচয় যখন মানুষ তাই মা, মাটি, মানুষ সত্যই সার্থক হয়ে উঠুক সার্বিক কল্যাণের মধ্য দিয়ে৷ এই মহান কথাগুলি যেন নিছক দলীয় স্বার্থে কলুষিত না হয়৷ মানুষ যদি নিজেকে না জানতে পারে, সে পথের সন্ধান না করে, তাহলে সেই অন্তর ও বাইরেই যে দেশ তাকে বুঝবে কেমন করে আর চিনবে কেমন করে৷ শুধু বুজরুকীতে তো সার্বিক সমস্যার সমাধান হবে না৷ এ কথা সকলকে বিশেষ করে আজকের নেতা ও নেত্রীদের মনে প্রাণে বুঝতে হবে৷