প্রভাতসঙ্গীত ঃ আঁধার থেকে আলোয় উত্তরণের সঙ্গীত

লেখক
আচার্য মন্ত্রেশ্বরানন্দ অবধূত

অনেকে মনে করেন যে প্রভাতসঙ্গীত বুঝি প্রভাতকালীন সঙ্গীত অর্থাৎ এই সঙ্গীত বুঝি শুধু প্রভাতে গাওয়ার জন্যেই৷ আবার অনেকে মনে করেন, শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার এই সঙ্গীত দিয়েছেন বলে এর নাম প্রভাতসঙ্গীত৷ এ সবই আংশিক সত্য৷ প্রভাতসঙ্গীত এই জন্যেই প্রভাতসঙ্গীত যেহেতু গানগুলি আমাদের অসৎ থেকে সৎ–এর দিকে, তমসা থেকে জ্যোতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে চিত্তকে উদ্বোধিত করে৷

মানুষের জীবনের অন্ধকার ত্রি–স্তরীয়৷ জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ প্রভাতসঙ্গীত যেমন ত্রি–স্তরীয় অন্ধকার দূর করার জন্যে গান শুণিয়েছে তেমনি বাস্তব জগতে প্রভাত হচ্ছে, হয়েছে বা হবে এমন গানও শুণিয়েছে৷ মানুষের জীবনে প্রভাত এসেছে এমন গানের সংখ্যাও যেমন প্রভাতসঙ্গীতে প্রচুর তেমনি আবার সমাজের অন্ধকার দূর হয়ে প্রভাত এসেছে এমন গানও কম নেই৷ কিন্তু এখানেই শেষ নয়৷ দীর্ঘকাল ধরে বাংলা গানে ভাবে ও ভাষায় যে একটা দীনতা বা একটা অন্ধকার লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, প্রভাতসঙ্গীত সেই দীনতা ঘুচিয়ে, অন্ধকারকে দূর করে প্রভাতের ঘোষণা করেছে৷ সেদিক থেকেও প্রভাতসঙ্গীত নামকরণ সার্থক৷ সুরের দিক থেকে আমরা বলতে পারি যে প্রভাতসঙ্গীত সুরের জগতেও ভোরের পাখীর মত নোতুন প্রভাতকে আবাহন করে এনেছে৷ ক্লান্তিকর একঘেয়ে সুরের জগতে যে বৈচিত্র্যময় ছন্দময় সুর তিনি দিয়েছেন তার কথা না হয় বাদই দিলুম, ধ্রুপদী সঙ্গীতের চাবিকাঠি দিয়ে তিনি যে নোতুন আলোকময় রাজ্যের দরজা খুলে দিয়েছেন সে সত্যকেও অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই৷

আমরা উল্লিখিত বক্তব্যের সারবত্তা প্রমাণ করার জন্যে নীচে কিছু প্রভাতসঙ্গীতের পঙ্ক্তি তুলে ধরছি৷

১) ‘‘ৰন্ধু হে নিয়ে চলো

                          আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে৷

                                          আঁধারের ব্যথা আর সয়না প্রাণে৷৷’’   

(১–সংখ্যক)

২) ‘‘এ গান আমার আলোর ঝর্ণাধারা

                          উপলে পথে দিনে রাতে বহে যাই–

                                          বহে যাই ৰাধনহারা৷৷’’             

(২–সংখ্যক)

৩)      ‘‘আঁধার শেষে আলোর দেশে অরুণ ভোরের কথা৷

          (ভাই) শোনাবো সবায় ডেকে ডেকে৷৷’’  (৩–সংখ্যক)

৪) ‘‘ৰন্ধু আমার, ৰন্ধু আমার সোণার আলোয় ঢাকা৷

          ভোরের পাখী উঠলো ডাকি’ প্রাণের পরাগে মাখা৷৷’’

          (৬–সংখ্যক)  

৫)      ‘‘আঁধারের সেই হতাশা কেটে গেছে আজ,

                          আলোকের পরশ পেয়ে৷

          কোথায় হারায়ে গেছে মরুর তৃষা

                          মধুরের মোহন ছায়ে৷৷’’                 (৯–সংখ্যক)

৬)  ‘‘কেটে গেছে মেঘ, গেছে উদ্বেগ আলোর যাত্রা পথে

          দূর নীলিমায় কারা ডেকে যায় সোনালী সৌররথে৷’’

                                          (১৭–সংখ্যক)

৭)   ‘‘কে যেন আসিয়া কয়ে গেছে কাণে

                                          নূতন প্রভাত আসিবে৷

          কালো কুয়াশার যবনিকা পরে

                                          সোনালী জীবন হাসিবে৷৷’’            (১৮–সংখ্যক)

৮)  ‘‘নবীন প্রাতে এই অরুণ আলোতে৷

          রূপের ছন্দে এলে  মোর মনেতে৷৷’’       (১৯–সংখ্যক)

৯)      ‘‘নূতনের আলোয় ওগো ছিলে তুমি কোন সুদূরে৷

          জগতের ছন্দ এখন নাচছে তোমায় ঘিরে ঘিরে৷৷’’     

                          (২৩–সংখ্যক)

১০)      ‘‘কোন্ তিমিরের পার হতে ফুটে উঠেছো

                          মোর জীবনের ধ্রুবতারা৷

          কোন্ অমরার লোক হতে বহে

                          এনেছো বসুধার সুধাধারা৷৷’’ (৩১–সংখ্যক)

১১)      ‘‘ডাক দিয়ে যাই যাই যাই,

                          আমি ডাক দিয়ে যাই যাই যাই৷

          আলোকের পথ ধরে যারা যেতে চায়

                          তাহাদের চিনে নিতে চাই৷৷’’

          (৪৯–সংখ্যক)

১২)      ‘‘তমসার পরে আশার আলোক পূবাকাশে রঙ এনেছে

          ‘আর ঘুমায়ো না’ ভূলোক দ্যুলোক

          মানবতা ডেকে চলেছে৷৷’’             (৪৬৯৯–সংখ্যক)

১৩)     ‘‘আলো ঝরে পড়ে ঝলকে ঝলকে

          আলোর দেবতা এসেছে

          ............................................

          অশনি গরজে ঝড় বহিতেছে রুদ্র পুরুষ কহিয়া চলেছে৷

          ‘ওরে ভয় নাই ভয় নাই তোর’

          সকল কুয়াশা কেটেছে৷৷’’                (৪৮–সংখ্যক)

১৪)      ‘‘আলোর সাগরে ঢেউ জাগায়েছো,

          তুমি অলকার সুধা ঝরায়েছো৷

          ............................................

          ত্রিতাপ দগ্ধ মানব হূদয়ে

          অসীমের তৃষ্ণা দিয়েছো ভরিয়ে

          মূক অচেতন মানব মানসে মুক্তির বাণী শোণায়েছো৷৷’’

(৮৬৫ – সংখ্যক)

১৫)      ‘‘আলোক আজি এল, এল আমার ঘরে, এল সবার ঘরে৷

          মানব দিশা পেল নিকষ অন্ধকারে৷৷

          ....................................................

          যে হতাশা ছেয়েছিল আজিকে তার অন্ত হল ৷

          মনের প্রান্তে আশা এল বিষাদ চিরে৷৷

          আজকে ঘরে কেঁদোনা কেউ,

          প্রীতির বানে জেগেছে ঢেউ৷

          দূরে আকাশে পাতালেতেও পরাগ ঝরে’’

(৪৮৯০–সংখ্যক)

১৬)     ‘‘আলো ঝরা ভোরে ধরা দিলে মোরে

          বলিনি তোমারে আমি তোমার৷

          তুমি বলেছিলে প্রীতি উছলে

          শাশ্বত কালে ছিলে আমার৷৷’’      (১৭৩০–সংখ্যক)

১৭)      ‘‘আলো ঝরা কোন সুদূর প্রভাতে

          দেখা হয়েছিল তব সাথে৷

          জেনেও সেদিন জানিতে পারিনি,

          বুঝিতে পারিনি কোন মতে৷৷

          অহংকারেতে ছিলাম উদ্ধত,

          জ্ঞানের চাপেতে ক্ষুদ্ধিতে ক্ষত

          নতজানু হয়ে জানিতে বুঝিতে

          পারিনিকো লাজ–ভয়েতে৷৷’’          (৫৩৮–সংখ্যক )

১৮)     ‘‘আলোকোজ্জ্বল তুমি ভরে আছো মনভূমি৷

          নিত্য সত্য তুমি আলোকের পানে ধাও৷

          .....................................................

          কাছে টেনে নিইনিকো যদিও কাছে পেয়েছি৷

          করণীয় নাহি করে’ মনে ব্যথা দিয়েছি৷

          নিজেরই কুম্ভীপাকে জড়ায়েছি পাকে পাকে৷

          এ মোহ বিপাকে মোর কৃপা–বারি বরষাও৷৷’’

(১৬০৩–সংখ্যক)

১৯)      ‘‘আলো ঝরিয়ে মধু ক্ষরিয়ে

          আঁধার সরিয়ে তুমি এসেছো৷

          ফুল ফুটিয়ে খুশি লুটিয়ে

          আশ মিটিয়ে তুমি হেসেছো৷৷’’

          ..........................................

          এলে ব্যথা বুঝিলে, প্রীতির পসরা ঢেলে দিয়েছো

          যে সরিতা হারালো ধারা যে গান হয়েছে সারা

          ঢেউ তার সুর তার সাথে এনেছো৷৷’’    

(১২৩৩–সংখ্যক)

২০)      ‘‘আলোক–তীর্থে তুমি কে গো এলে

          সবার মনে প্রাণে দোলা দিলে৷৷

          ...................................................

          সবারে তুলে নিলে সবারে ভালোবাসিলে

          সবার মর্মকথা বুঝে নিলে

          তুমি কারো দূর নও, তুমি কারো পর নও

          ...................................................

          বৈদুর্য্যমণি, হূদয়ে জাগাও ধবনি,

          জীবনের যত গ্লানি ধুয়ে ফেলে৷৷’’

(২৪৩২–সংখ্যক)

উল্লিখিত উদাহরণগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে যে প্রত্যেকটি গানেরই ‘সেন্ড্রাল আইডিয়া’ বা মর্মবাণী হচ্ছে তমসা থেকে আলোয় উত্তরণ, যদিও উল্লিখিত কোন একটি গানই ‘আলো’ এই শব্দ দিয়ে রচয়িতা শুরু করেন নি, করার প্রয়োজনও নেই৷ কিন্তু শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকার তাঁর প্রভাতসঙ্গীতে পঞ্চাশটিরও বেশী গান রচনা করেছেন যে গানগুলি রচয়িতা শুরুই করেছেন ‘আলো’ শব্দটি দিয়ে৷  যেমন ‘আলো ঝরে পড়ে ঝলকে ঝলকে’, ‘আলোর সাগরে ঢেউ জাগায়েছো’, ‘আলোক আজি এল, এল আমার ঘরে’ প্রভৃতি৷ এই সব গানগুলিরও মর্মবাণী হচ্ছে আলোর সাগরে অবগাহন করানো৷