স্বাধীনতার পর ৭৩ বছর কেটে গেল৷ একটা দেশের পক্ষে সাবালোক হওয়ার জন্য ৭৩টা বছর অনেক বেশী৷ কিন্তু ভারত সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সবদিকেই এখনও নাবালোক--- হামাগুড়ি দিচ্ছে, সামাজিক ভেদ-বিদ্বেষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক সংঘাত দেশকে অধঃপতনের শেষ সীমায় নিয়ে যাচ্ছে ৷ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকারই সামাজিক শান্তি ও একতা রক্ষা করতে ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে কোন বলিষ্ঠ নীতি গ্রহণ করতে পারে নি৷ আসলে পুঁজিপতিদের অর্থেপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো যে যখন ক্ষমতায় এসেছে সে তখন পুঁজিপতিদের তুষ্ট করেছে আর নিজের মতো করে তুঘলকি শাসন চালিয়ে গেছে৷ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ধর্ম-সাহিত্য- সংসৃকতি-ভাষানীতি কোন বিষয়েই কোন সরকারই কোন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারে নি৷ এক কথায় সরকারের খাম খেয়ালীপনার খেসারত দিচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণ৷
কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষে গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নত না হলে দেশের সার্বিক আর্থিক বিকাশ কখনই সম্ভব নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি কর্ষককূল৷ অথচ সেই কর্ষকরাই আজ সবথেকে বেশী অবহেলিত৷ কোন সরকারই কর্ষকদের দুঃখ-দুর্দশা দুর করার চেষ্টা করেনি৷ শিল্পায়ণের দোহাই দিয়ে পুঁজিপতিদের তোষণ করে গেছে৷
সম্প্রতি সরকারের নূতন কৃষি আইনের প্রতিবাদে দেশ উত্তাল৷ তবে আইনের পক্ষে বিপক্ষে যতই আন্দোলন হোক, নূতন পুরনো কোন আইনেই কৃষি সমস্যা সমাধানের কোন বলিষ্ঠ পথ নির্দেশনা নেই৷ কৃষিসমস্যা সমাধানে কোন সরকারেই বিশেষ নজর নেই৷ সরকারের লক্ষ্য আমলা ও ধনকুবেরদের সন্তুষ্ট রেখে গদি বাঁচান৷ এই ব্যাপারে ডান-বাম-রাম সব পক্ষই একই পথের পথিক৷ দেশের মানুষকে যারা ক্ষুধার অন্ন যোগায়, পরণের বস্ত্র যোগায়, সেই কর্ষককুল সবথেকে বেশী কলুষিত রাজনীতির শিকার হয়েছে৷
বাঙলা তথা ভারতে কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ আছে৷ কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কোন বলিষ্ঠ পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি৷ সরকারের নীতিহীনতা ও দুর্বলতার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে মহাজন ও পুঁজিপতিরা৷ রাজনৈতিক দলগুলো কর্ষকদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে৷ ফলে মহাজনী শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বাঙলার কর্ষককুল দারিদ্র্যের অভিশাপ বহে বেড়াচ্ছে৷
একথা স্মরণে রাখা দরকার, গ্রামীন অর্থনীতি উন্নত না হলে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত হবে না৷ গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর৷ কৃষিকে অবহেলা করলে বা পুঁজিপতিদের স্বার্থে কৃষিকে ব্যবহার করলে শুধু কর্ষকরাই নয়, দেশের অর্থনীতির ভিতও দুর্বল হবে৷ প্রাণীন ও অপ্রাণীন সকল সত্তার সার্বিক কল্যাণের কথা ভেবে প্রাউট প্রবক্তা কৃষি শিল্পের সমন্বয়ে এক বাস্তবমুখী বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পথনির্দেশনা দিয়েছেন৷ সেই পথেই সম্ভব কৃষি সমস্যার সার্বিক সমাধান৷
প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব অনুসারে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে বাঙলার কর্ষককুলকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই কেন্দ্রীত অর্থনীতির মূলচ্ছেদ করে বিকেন্দ্রিত পথে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পের সমন্বয়ে গ্রামীন অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে৷ কৃষিকাজ ও কৃষিব্যবস্থায় শিল্পগুলিতে সমবায় প্রথা গড়ে তুলতে হবে৷ কৃষিকে শিল্পের সমান মর্যাদা দিয়ে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প, কৃষি সহায়ক শিল্প সমবায় প্রথার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে৷ এই সমবায় প্রথায় পরিযায়ী তথা অস্থায়ী বাসিন্দাদের স্থান হবে না৷ হয় তাদের সেই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে নতুবা নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে হবে৷ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্যরেখে আর্থিকভাবে লাভজনক জোত economic holding) গঠন করতে হবে জমির উর্বরতা, জলবায়ু প্রভৃতি বিচার করে৷ এইভাবে প্রগতিশীল তত্বের প্রয়োগ করে বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামীন অর্থনীতিকে উন্নত করতে হবে৷ পুঁজিবাদ নির্ভর কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় নূতন পুরনো কোন আইনেই কর্ষকের দারিদ্র্য ঘুচবে না৷ তবে কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হবে না মানুষের শুভ চেতনা না জাগলে৷ প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের প্রবক্তার কথায় ‘‘মানুষের উন্নত শুভবুদ্ধিই সকল মানবীয় সমস্যার একমাত্র সমাধান৷’’ দেশ ও দশের স্বার্থে সরকার, আন্দোলনরত কর্ষক ও রাজনৈতিক নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক৷
- Log in to post comments