পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা ও তার সমাধান

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থার একটা মস্তবড় ত্রুটি এতদিন পরে সবার চোখে পড়ছে৷ কি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা, কি বুদ্ধিজীবীরা এতদিন এই সমস্যাটাকে দেখেও দেখছিলেন না৷ ভাবছিলেন এ তো বেশ চলছে! সমস্যা কোথায়! এখন সমস্যাটাকে কারোর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হচ্ছে না৷ সব পত্র-পত্রিকাতেই লেখা হচ্ছে৷মোবাইলে,দূরদর্শনে এটাই এখন অন্যতম প্রধান খবর৷ করোনা বাইরাসের সংক্রমণ রুখতে দেশ জুড়ে লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্যাটি এখন দেশের জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷  

  এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়ে বেড়ানো পরিযায়ী পাখিদের মতোই জীবিকার সন্ধানে যে সমস্ত মানুষ বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন সেই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশার কথা এখন সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে৷

  বর্তমানে লকডাউনের ফলে প্রায় সমস্ত কাজ বন্ধ ৷ তাই বেতন বা মজুরি মিলছে না৷ কিছুদিন লকডাউনে থাকার পর হাতের পয়সা ফুরিয়ে গেছে৷ বাড়ি ফিরে যেতে চায়৷ অথচ বাস নেই৷ ট্রেনও নেই৷ শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে রেল লাইন ধরে ধরে দিনের পর দিন  পায়ে হেঁটে চলেছে দলে দলে৷ কোথাও মাল গাড়ি চাপা পড়ে, কোথাও পথ দুর্ঘটনায় নানা ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল চলছে৷খাদ্যাভাবে দিনের পর দিন হাঁটতে হাঁটতে আর চলতে না পেরেও মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে অনেকে৷ কোথাও এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপরও লাঠিচার্য হয়েছে৷ গত তিন মাসে ১১৪ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে৷

  এখন, এই পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যার উৎস কী? নিঃসন্দেহে পুঁজিবাদী অর্থনীতি  ব্যবস্থা৷ পুঁজিপতিরা যতবেশি সম্ভব মুনাফা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে শিল্প গড়ে, বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরী করে৷ দেশের সমস্ত এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশ তাদের লক্ষ্য নয়৷ সমস্ত অঞ্চলের বেকারদের কর্মসংস্থান করা তাদের লক্ষ্য নয়৷ দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় যেখানে তাদের বেশি থেকে বেশি মুনাফা লোটার সুযোগ রয়েছে, আমদানী-রপ্তানির জন্যে যোগাযোগের খুব ভালো ব্যবস্থা রয়েছে, সেই সব কয়েকটি স্থানকে তারা বেছে নেয়৷ আর দেশের বিভিন্ন রাজ্যে স্থানীয় ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে মৌমাছির ঝাঁকের মত দলে দলে মানুষ ছুটে আসে ওই বিশেষ স্থানে কাজের সন্ধানে৷

  তার ফলে কোন সময় বিপর্যয় দেখা দিলে, যেমন বর্তমানে করোনা বাইরাস জনিত অতিমারী পরিস্থিতিতে, মাটির টানে ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা সব ছেড়ে ছুড়ে ঘরে ফিরতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে৷ কেননা সেখানে তাদের আত্মীয় স্বজন রয়েছে৷

  এছাড়া আরো সমস্যা রয়েছে৷ এই বেকার সমস্যার যুগে মাঝে মধ্যে স্থানীয় মানুষ জন আন্দোলন করবেই৷ স্থানীয় কলকারখানা ও ব্যবসা কেন্দ্রে বা সরকারী- বেসরকারী দপ্তরে স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের  অগ্রাধিকারের দাবি উঠবে৷ এই নিয়ে স্থানীয় ও বহিরাগতদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধবে৷ আবার অসুখ-বিসুখের ক্ষেত্রেও বাড়ী ফেরার তাগিদ আসেই৷

  তাই নিজ নিজ অঞ্চলে (অর্থনৈতিক জোনে) কর্মসংস্থানটাই যুক্তিযুক্ত৷ এটা হলে এখন যেমন পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশা দেখা দিয়েছে, তা হতো না৷

  এটাই মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রবর্ত্তিত প্রউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের গোড়ার কথা৷ প্রাউট বলছে, সরকারকে সুপরিকল্পিতভাবে দেশের প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি জেলার প্রতিটি ব্লকেই ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উপযুক্ত সমীক্ষা করে ওই এলাকার আপন আপন বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিজ্ঞান সম্মতভাবে কৃষির বিকাশ ঘটাতে হবে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-নির্ভর শিল্প (কৃষিপণ্যের ভিত্তিতে), কৃষিসহায়ক শিল্প (কৃষি-বিকাশের প্রয়োজনীয় সামগ্রিক তৈরীর জন্যে) ও স্থানীয় কাঁচামাল ভিত্তিক অকৃষি শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷ এর মাধ্যমে প্রতিটি এলাকার ১০০ শতাংশ মানুষের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷বলা বাহুল্য এগুলির মলিকানা বহিরাগত পুঁজিপতিদের হাতে রাখা চলবে না, রাখতে হবে স্থানীয় মানুষদের সমবায়ের হাতে৷ সরকারকেই  সমস্ত রকমের গাইডেন্স দিয়ে ও প্রয়োজনমত সাহায্য দিয়ে এই গুলোকে পরিচালিত করতে হবে৷ অতি ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যষ্টি মালিকানা চলবে৷ আর স্থানীয় প্রশাসনের হাতে থাকবে মূল শিল্প, যে শিল্পগুলির তৈরী কাঁচা মালের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে অন্যান্য শিল্প৷ উদাহরণ স্বরূপ সুতাকল, যার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে তাঁত সমবায়গুলি ও ছোট ছোট তাঁত শিল্পগুলি৷

  প্রাউট বলছে,  কৃষি ও শিল্পের মধ্যে একটা সন্তুলন (Balance) থাকা চাই৷ উল্লিখিত বিভিন্ন বিভাগে লোক সংখ্যা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাউটের নীতি হলো, কৃষিতে ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ, কৃষিনির্ভর শিল্পে ২০ শতাংশ, কৃষিসহায়ক শিল্পে ২০ শতাংশ, বুদ্ধিজীবীদের চাকুরীতে ১০ শতাংশ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ১০ শতাংশ৷ স্থানীয় কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা অকৃষি শিল্পে ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষকে নিয়োগ করার পরিকল্পনা নিতে হবে৷ এই অকৃষি শিল্পে নিযুক্ত কর্মি সংখ্যার শতকরা হার পূরণ করতে  হবে কৃষি, কৃষি নির্ভর শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্পে জন্যে বরাদ্দ কর্মী সংখ্যার হার কিছুটা কমিয়ে৷

  এই ভাবে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের নীতিতে সুপরিকল্পিতরূপে দেশের সমস্ত এলাকার, সমস্ত জেলার তথা সমস্ত ব্লকে কৃষি-শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে ও স্থানীয় ১০০ শতাংশ মানুষের সুষ্ঠুভাবে কর্মসংস্থানের এর ব্যবস্থা করতে হবে৷ তখন আর পরিযায়ী শ্রমিকের  সমস্যাটাই থাকবে না৷ স্থানীয় মানুষকে কাজের জন্যে হন্যে  হয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হবে না৷ বরং নিজের এলাকাতে সহজেই কাজ পেয়ে যাবে৷