রবীন্দ্রনাথ, ঊনিশে মে ও বাংলাভাষা

লেখক
সুকুমার সরকার

বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছিল৷ তাই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সকল বাঙালীকে একত্রিত করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলন করেছিলেন ‘রাখি বন্ধন’ উৎসবের৷ যা আজও পালিত হয়ে থাকে৷ তবে কালক্রমে বঙ্গভঙ্গ কিন্তু হয়েই গেছে৷ সেই ভাঙ্গা বাংলার গানও লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷

                ‘‘মমতাবিহীন কালস্রোতে

                বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে

                নির্বাসিতা তুমি

                সুন্দরী শ্রীভূমি–’’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার শ্রীভূমি বা শ্রীহট্ট বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট জেলা৷ বৃহত্তর এই শ্রীহট্ট যা সিলেট জেলার হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, শিলচর, যা মূলতঃ বাঙালী অধ্যুষিত ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল, তা চলে গেল অসম নামক বিমাতার কোলে৷ শুরু হ’ল বৈমাতৃসুলভ আচরণ৷ বাঙালী অধ্যুষিত অসমের এই বরাক উপত্যকায় চাপানোর চেষ্টা হ’ল অসমিয়া ভাষা৷ প্রতিবাদে গর্জে উঠলো বরাকের বাঙালীরা৷ যেমনটি গর্জে উঠেছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায়৷ ঢাকাতেও রক্ত ঝরেছিল, বরাকেও রক্ত ঝরলো৷ প্রেক্ষাপট একটাই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা৷ সে দিনের ঘটনা ১৯৬১ সালের ১৯শে মে৷ স্থান অসমের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জে রেল স্টেশনের কাছে৷ বিদ্রোহী বাঙালীরা সমবেত হয়েছিলেন অসম সরকারের দমনমূলক ভাষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে৷ সমবেত সেই প্রতিবাদ মিছিলের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল অসম পুলিশ৷ মুহূর্ত্তেই ঢলে পড়েছিল মিষ্টি তাজা তরুণ প্রাণ৷ যাঁদের পুরোভাগে ছিলেন কমলা ভট্টাচার্য নামের এক তরুণীও৷ সে দিনের সেই ঘটনায় কমলা ভট্টাচার্য সহ আরও যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন–

১৷ কমলা ভট্টাচার্য, ২৷ কানাই নিয়োগী, ৩৷ সুনীল সরকার, ৪৷ সুকোমল পুরকায়স্থ, ৫৷ কুমুদ দাস, ৬৷ চন্ডীচরণ সূত্রধর, ৭৷ তরণী দেবনাথ, ৮৷ হীতেশ বিশ্বাস, ৯৷ বীরেন্দ্র সূত্রধর, ১০৷ সত্যেন দেব, ১১৷ শচীন্দ্র পাল৷

দ্বিতীয় বার বাংলা ভাষার জন্যে শহীদ হলেন বাঙালীরা৷ সেদিনের ঘটনাও একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই বেদনাবিধুর৷ অথচ যে সাগ্রহে বাঙালীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পালিত হয়, সেই আগ্রহে ‘ঊনিশে মে’ পালিত হয় না৷ সে কি কেবল বরাক উপত্যকা বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিত বলে? –এ প্রশ্ণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সমস্ত বাঙালী জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে অনেক কাল, যতদিন পর্যন্ত না বাঙালী জাতি তার হূত রাষ্ট্রসীমা পুনোরুদ্ধার করে অখন্ড ‘বাঙালীস্তান’ গড়তে পারবে৷ উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে বিন্ধ্য পর্বতের শাখা রামগড় পাহাড় থেকে পূর্ব আরাকান–ইয়োমা আর মধ্যাংশে বহমান গঙ্গা–পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, সুবর্ণরেখা সহ হাজারো নদী মেখলা সহ বিস্তীর্ণ এই ভূমিখন্ডই প্রকৃতি সৃষ্ট ‘বাঙালীস্তান’৷ এই বাঙালীস্তানের যারা বাসিন্দা তারা সবাই বাঙালী৷ এই বাঙালী জাতি তার আত্মপরিচয় ভুলে গেছে৷ ভুলে গেছে তার ভাষা–সাহিত্য–সংসৃক্ত্ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা৷ আর এই আত্মবিস্মৃতির সুযোগ নিয়ে বাঙালীর ভাষা–সাহিত্য–সংসৃক্ত্ আবারও অনুপ্রবেশ ঘটেছে অসংসৃক্তির৷ বাঙালীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাঙালীর ‘ঊনিশে মে’ সেই অসংসৃক্তির বাতাবরণ থেকে বাঙালী জাতির ঐতিহ্য তুলে আনতে পারে৷

ঊনিশে মে’র এগারজন বাঙালীর রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বরাকসহ সমগ্র অসমের বাংলা ও বাঙালীর অধিকার৷ আজ বাংলা ভাষা অসমের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা৷ বাংলা ভাষার সাহিত্য–সংসৃক্তির ইতিহাসে অসমের বাঙালীদের যে অবদান তার মর্মমূলে আছে ‘ঊনিশে মে’র এই ভাষা শহীদেরা৷

বাংলা ভাষা আজ বিশ্ব মানের ভাষা৷ বিশ্বভাষা৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা৷ মাতৃসমা এই বাংলাভাষার ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘ঊনিশে মে’র প্রেক্ষাপট–একই৷ পার্থক্য শুধু স্থান–কাল ও পাত্রের৷ এই স্থান–কাল ও পাত্রের পার্থক্যের কারণে দু’টি ঘটনা আজ দু’রকমের মর্যাদা পায়৷ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাষা–সংসৃক্তি–র্থনী ও স্বাধিকার বোধের পরিচায়ক৷ একটি রাষ্ট্র ক্ষমতা বহন করে চলেছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র মর্যাদার ইতিহাস৷ আর তাই ‘একুশে ফেব্রুয়ারির বর্ণার্ঘ এত পুষ্ট৷ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা মর্যাদা পাবার পেছনেও রয়েছে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা৷ একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে সমগ্র বাঙালীস্তানের বাঙালীর ভাষা–সেন্টিমেন্ট জড়িত থাকলেও, ১৯৫২ সালের পর থেকে যে বিপুল উদ্দীপনায় পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়, তার অতি ক্ষুদ্র ভগ্ণাংশ মাত্র উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের মধ্যে৷ যেন একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল পূর্ববঙ্গের  বাঙালীদের ভাষাস্মৃতি৷ এতে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত রাষ্ট্রের যেন তেমন দায় নেই৷ অবশ্য একথা সত্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো দায়তো নেইই৷ বরং রাষ্ট্র যন্ত্র চায় বাংলা ও বাঙালী যত তার ভাষা–সংসৃক্তি ভুলে থাকবে, তত হিন্দী বলয়ের পুঁজিপতিদের লাভ৷ অন্য দিকে ‘ঊনিশে মে’র ঘটনাতো বাংলার রাজ্যসীমা রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিত ও বিচ্ছিন্ন অংশের ঘটনা৷ যা আজ অসম নামক বিধাতার কোলে৷ তার সরকার তো চাইবেই, বাংলা ভাষা ভুলে গিয়ে অসম রাজ্যের সকল মানুষই অসমীয়া হোক– কী ভাষায়, কী নাগরিকত্বে৷ যতই বাঙালীস্তানের অংশ বলা হোক বরাক উপত্যকা এখন অসম রাজ্যের অন্তর্গত৷ সুতরাং অসম সরকার এর ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে পৃষ্ঠপোষকতা করবেন কেন? – যে টুকু করতে হবে, তা বাঙালীদেরকেই করতে হবে৷ হোক সে বাঙালী পশ্চিমবঙ্গের, ওড়িশার, ঝাড়খন্ডের, বিহারের, অসমের, মেঘালয়ের, ত্রিপুরার, মণিপুরের, নেপালের কিংবা বাংলাদেশ–মায়ানমারে৷ কেননা বারটি উপভাষা নিয়ে বৃহত্তর যে বাংলাভাষা, সেই বাংলাভাষার পরিভূর মধ্যে যে বাঙালীস্তান তার অনেক অংশ আজ ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন হয়ে উল্লিখিত রাজ্য ও রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অবগুন্ঠনের আড়ালে ধুঁকে ধুঁকে মরছে৷ বিচ্ছিন্ন এই ‘বাঙালীস্তান’কে একত্রিত করে বাঙালীর ভাষা–সংসৃক্তি–ইতিহাস্ ও অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে গেলে বাঙালীর ‘ঊনিশে মে’, বাঙালীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’কেই হাতিয়ার করতে হবে৷ ভাষা হচ্ছে মানুষের সাংবেদনিক উত্তরাধিকার (সেন্টিমেন্টাল লিগ্যাসি)৷ সমাজের সর্বস্তরে মানুষ অর্থনৈতিক শোষণ’কে জিইয়ে রাখতে পুঁজিবাদীরা চিরকাল মানুষের সাংসৃক্তিক ঐতিহ্য ধ্বংস করতে চেয়েছে৷ আজ বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংসৃক্তি ক্ষয়িষ্ণুতার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে৷ বাংলা ভাষা–সংসৃক্তির পীঠস্থান বলে কথিত কলকাতা মহানগরী দ্রুত গতিতে হারাতে বসেছে বাংলা ভাষা–সংসৃক্তির মর্যাদাবোধ৷ কলকাতার পথে ঘাটে, ষ্টেশনে, ট্রামে–বাসে, দোকানে, ট্যাক্সিতে সবার মুখে ‘হিউ ভাষা’ (হিন্দী আর উর্দ্দু) ভাষা৷ স্কুল কলেজে বা পাড়ার সাংসৃক্তিক অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা থেকে অনুষ্ঠানের নাচ–গান সবেতেই হিউ ভাষার দাপাদাপি৷ যেন বাংলায় কথা বলাটা একটা গ্রাম্য ব্যাপার৷ জনপ্রিয় টি. ভি চ্যানেলগুলির সঞ্চালনাতেও অসংসৃক্তির মাতামাতি৷ তাহলে বাংলা ভাষা–সংসৃক্তির দিক থেকে কলকাতা মহানগরীর ভবিষ্যৎ কী? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি যে ভাষায় জন্মগ্রহণ করে, যে ভাষায় সাহিত্য–সংসৃক্তির চর্চা করে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন, সে ভাষার এই পরিণতি বড়ই পীড়াদায়ক৷ বিশ্বের অপরাপর দেশের মানুষ যখন বাংলা ও বাঙালীর গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলকাতা আসেন, তখন তারা হতাশ হয়েই ফিরে যান বাংলা ও বাঙালীর দুরাবস্থা দেখে৷ যে ভাষার অন্তর প্রবাহ সমৃদ্ধশালী, সে ভাষা অমিত সম্পদ ও সম্ভাবনার উত্তরাষিকারী সেই ভাষাকে এই পরিণতির হাত থেকে বাঁচাতে, বাঙালীর সাংবেদনিক উত্তরাধিকার বাঙালীর ভাষা–সেন্টিমেন্টকে অবশ্যই তুলে ধরতে হবে৷ বাংলাভাষা ও বাংলা সংসৃক্তির উপর যে ভাবে শাসক ও শোষকের ভাষা ও অসংসৃক্তি চাপানোর চেষ্টা চলছে, তার হাত থেকে বাংলা ও বাঙালীকে বাঁচাতে বাঙালীর ভাষা–সংসৃক্তির স্মারক স্মৃতি স্তম্ভ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘ঊনিশে মে’কেই মাইল ফলক হিসেবে তুলে ধরতে হবে৷ আর এ দু’টি আবেগের সাথেই জড়িত আছে, বাঙালীর গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম৷