সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে জেগেছিল শিল্প সৃষ্টির এষণা ও প্রেষণা। এষণাই প্রেষণাকে ডেকে আনে। সভ্যতার প্রথম ধাপে শিল্পমাত্রেই ছিল কুটির শিল্প। নারী-পুরুষ-বালক-বালিকা নির্বিশেষে সবাই শিল্প রচনায় হাত লাগাত। পরে দেখা গেল কিছু শিল্প গ্রামে গ্রামে করা যায় না... করতে হয় কিছু সংখ্যক গ্রাম নিয়ে। তা না হলে তাদের একদিকে যেমন বাজারের ঘাটতি পড়ে, অন্য দিকে তেমনই শিল্পীর সংখ্যাতেও অভাব দেখা দেয়। তখন মানুষ প্রথম শিল্পায়োগ বা কারখানায় (ফার্সি ভাষায় ‘কার’ শব্দের মানে কাজ। যার কার নেই সে বেকার। যে কার জানে সেই ‘কার-ই-গর’। ফার্সি ভাষায় কর্তৃত্বে ‘গর’, ‘বর’ ও ‘দার’ এই তিনটি প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন যে সওদা করে সে ‘সওদাগর’, যে যাদু জানে সে ‘জাদুগর’, যার দোকান আছে সে দোকানদার, শর আছে তো শর্দার, জান আছে তো ‘জানবর’ হিম্মৎ আছে তো ‘হিম্মতবর’।) যেতে শুরু করল। এখানে প্রসঙ্গতঃ একটা কথা বলে রাখি। শিল্প যত বেশী কুটীর-শিল্প হয়, শিল্প যত বিকেন্দ্রীকৃত হয় মানুষের সুবিধা তত বেশী। এতে যে শুধু আর্থিক সামর্থকে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় তাই-ই নয়, ধনের সর্বত্র মোটামুটি রকমের বণ্টন হওয়ায় আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দেয় না। কোথায়ও অভাবের তাড়নায় মৃত্যুর হা-হা ধ্বনি, কোথায়ও প্রাচুর্যের স্ফীতিতে অনাচার, কোনটাই বড় একটা হতে পারে না। শুধু কি তাই, বিকেন্দ্রীকৃত শিল্পে মানুষকে শিল্পায়োগে কাজ করার জন্য ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে হয় না, যার ফলে বাইরে থাকার জন্যে দুটো সংসারের খরচের হাত থেকে বাঁচা যায়। আবার কর্মী সংগ্রহের সুযোগ পাওয়া যায়। একই মানুষ অর্থ-উপার্জন ও গৃহস্থালীর অন্যান্য কাজও করে থাকে। কিন্তু পুঁজিবাদী কাঠামোয় সেটা করা যায় না। পুঁজিবাদে সেটাকে সমর্থনও করা হ্য় না, কারণ পুঁজিবাদে শিল্পায়োগ মুনাফার প্রয়োজনে (production for profiteering) : …. প্রউটের বক্তব্য .... যে বক্তব্য প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষ স্বীকার করবেন – পণ্যের উৎপাদন মানুষের প্রয়জনে (production for consumption)। তাঁরা [পুঁজিবাদীরা] চান, সস্তায় উৎপাদন, ও অধিক মূল্যে বিক্রয়। সস্তায় উৎপাদন করতে গেলে পরিবহন-যোগ্য নৈকট্য চাই, কাঁচা মাল চাই, শক্তি চাই, পানীয় জল চাই।
তাই, পুঁজিবাদ শিল্পে কেন্দ্রীকরণ চাইবেই – তা সে পুঁজিবাদ বৈয়ষ্টিকই হোক, বা গোষ্ঠিগতই হোক। এই ধনতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লী, আমেদাবাদ, কানপুর, মাদ্রাজের কাছাকাছি জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে শত সহস্র শিল্পায়োগ। আর বীরভূমের খরাসোল, পুরুলিয়ার পুঞ্চা, আরামবাগের গোঘাট ও নদের নাকাশিপাড়া অন্ধকারে চামচিকার মত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে রয়েছে। ওই জায়গা গুলির নামও হয়তো শোনেনি, শুনবেই বা কী করে? ওখানকার মানুষেরা ভীষণ গরীব, শীতের দিনে পশমী কোট-প্যাণ্টতো দূরের কথা, ওনেকের আলোয়ানও (র্যাপার) জোটে না। কম্যুনিজম্ হচ্ছে রাষ্ট্রীক পুঁজিবাদ। তাই পুঁজিবাদের দোষগুলি থেকে কম্যুনিজম্ও মোটেই মুক্ত নয়। বৈয়ষ্টিক ও গোষ্ঠীগত পুঁজিবাদের মতই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রিক সত্তার দ্বারা পরিচালিত শিল্পায়োগ, অর্থাৎ রাষ্ট্রিক পুঁজিবাদে যেমন শিল্পায়োগ কেন্দ্রীভূত হয়, রাষ্ট্রিক পুঁজিবাদের পরিপোষক কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রেও তেমনই কেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদকে সমর্থন করা হয়। তাই তত্ত্বগত বিচারে বৈয়ষ্টিক মুক্তির প্রশ্নে কম্যুনিজমের সঙ্গে ধনতান্ত্রিকতা বা পুঁজিবাদে কিছটা লোক দেখানো বা খোসা খোলার পার্থক্য থাকলেও, ভেতরে আঁটিটি দুয়ের’ই এক। দুই-ই একই পুঁজিবাদের পোঁ-ধরা। মানুষকে যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মুক্তির আশ্বাস দিতে হয়, তা হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ করতেই হবে।
গ্রাম-ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়তে যদি সাময়িক অসুবিধা থেকেও যায়, তবু উপভূক্তি-ভিত্তিক (Block level) অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করার এমন কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়। যে শিল্পায়োগ স্থাপনায়, পরিচালনায় তথা ভোগ্যবণ্টনে উপভিত্তিক ভিত্তিতে গড়তে একান্তভাবে অসুবিধা জনক – কেবল সেগুলিই বৃহত্তর পরিভূতে করা যেতে পারে। যেমন ইস্পাতের কারখানা গ্রামে গ্রামে, ব্লকে ব্লকে, জেলায়, জেলায় না করে একটা বৃহত্তর পরিভূতে করলে সুবিধাজনক। এমন কিছু কিছু প্রগ্রহ শিল্প (Key Industry) আছে, যার পরিচালনা ক্ষুদ্র পরিভূতে বা সমবায়ের দ্বারা হওয়া একটু অসুবিধা জনক। সেগুলিকে রাষ্ট্রিক পরিচালনাতেই করতে হবে। একটু বৃহত্তর পরিভূতেই করতে হবে। তবে এই বৃহত্তর পরিভূতে পরিচালিত প্রগ্রহ শিল্পকে ধনতান্ত্রিকের হাতে ছাড়া সম্ভব নয়, কারণ তাতে জনগনের প্রয়োজন পূর্ণভাবে নাহোক, আংশিকভাবে অস্বীকৃত থেকেই যাবে। ধনতান্ত্রিকের হাতে ছেড়ে দিলে যেমন অসুবিধা তেমনই সেই সকল ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পকারখানায় ছোট বড় নানান রকম ঝামেলা থাকায় সমবায়ের দ্বারা সেগুলির পরিচালনায় অসুবিধা দেখা যেতে পারে। কেবল সেই অতি বৃহৎ শিল্পগুলি রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় থাকবে। তাকে বিকেন্দ্রীকরণ না করে কেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। তবে যাকে আজ বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভবপর নয় বলে’ মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকেও হয়তো বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব হবে। তখন তাকে তাই-ই করতে হবে। কেন্দ্রীকৃত শিল্পে আরও অনেক অসুবিধা রয়েছে। যেমন- কেন্দ্রীকৃত শিল্পে মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, তাজা ফলমূল, শাকসব্জী, দুধের অভাব, নৈতিক অনাচার, চোর-ডাকাত-সমাজবিরোধীদের লুকিয়ে থাকার আস্তানা, নেশা-গ্রস্তদের ভীড়-ভাড়াক্কা, পাপাচারীদের কৃষ্ণ গহ্বর, ওজনের অভাব, বায়ু বিদূষণ, জল বিদূষণ ... আর কত বলি।
৬ই নভেম্বর ১৯৮৮, কলিকাতা
(শব্দ চয়নিকা ঊনবিংশ খণ্ড – প্রবচন ১৪৮)