শহীদ দীনেশ গুপ্ত

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

অলিন্দ যুদ্ধের শহীদ দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি হয়েছিল ১৯৩১সালের ৭ই জুলাই৷ ৭ই জুলাই  তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফাঁসির দুদিন আগে জেল থেকে বৌদিকে লেখা একটি পত্র ছাপা হল৷

বৌদি, গতকল্য তোমার চিঠিখানা পাইলাম৷ আজ মা ও দাদা আসিয়া ছিলেন৷ দাদার কাছে শুনিলাম আমার ফাঁসির হুকুমই বহাল রহিয়াছে৷

বৌদি, এ জন্মের মত তোমাদের কাছ হইতে বিদায় চাহিতেছি৷ জানি, বিদায় দিতে তোমাদের বুক ভাঙিয়া যাইবে, কিন্তু কি করিব, বিদায় যে লইতেই হইবে৷

অনেক দিনের কথাই মনে পড়িতেছে৷ সেই যেদিন তোমাকে আমার বৌদিরূপে পাইলাম, সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত সমস্ত কথাই আমার চোখের সমুখে যেন ভাসিয়া বেড়াইতেছে৷ তোমাকে আমার দশ বৎসর বয়স হইতে এই কুড়ি বৎসর বয়স পর্যন্ত অনেক যন্ত্রণাই দিয়া আসিয়াছি৷ সমস্তই তুমি স্নেহের অত্যাচার রূপে হাসিমুখে সহ্য করিয়া আসিয়াছ, কখনও বিরক্ত হও নাই, কখনও মুখভার করিয়া থাক নাই৷ চিরকালই অসুখে তোমার হাতের বার্লি, আহারে তোমার হাতের রান্না আমার সবচেয়ে ভাল লাগিয়াছে, তাহা তুমি জান৷ তুমি আমাকে কেন আমাদের সকলকেই তোমার একান্ত আন্তরিক ভালবাসা দ্বারা জয় করিয়া লইয়াছিলে সেদিন পর্যন্ত আমার যদি অনেক টাকা হয় তবে তোমাকে কি কি প্রিয় জিনিস আমি তোমায় উপহার দিব, সেই সম্বন্ধে নানা উদ্ভট কল্পনা মনে মনে করিয়াছি৷ যাক, ভগবান জন্ম-জন্মান্তরে তোমার মতো বৌদিই যেন আমায় পাওয়াইয়া দেন, এই প্রার্থনা৷

কিসে তোমাদের মনে শান্তি আসিতে পারে, তুমি তাহার উপায় আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছ৷ আমিই কি আর তাহা বলিতে পারি! তবে আমার মনে হয় মরণকে আমরা বড়  ভয় করি তাই মরণের কাছে আমরা পরাজিত হই৷ এই ভয় যদি জয় করিতে পারি তবে মরণ আমাদের কাছে  তুচ্ছ হইয়া দাঁড়াইবে৷ মরণকে আমাদের ভয় না করিয়া নির্ভয়ে প্রশান্ত চিত্তে বরণ করিয়া লইতে হইবে৷ মরণকে ভয় করিলে ধর্মের প্রধান সোপানই যে আমরা উত্তীর্ণ হইতে পারিব না৷ আমরা জানি, মরণ আমাদের হয় না হয় এই নশ্বর দেহের৷ আত্মা অবিনশ্বর৷ সেই আত্মাই আমি---আর সেই আত্মাই ভগবান৷ মানুষের যখন উপলব্ধি হয়, তখনই সে বলিতে পারে,‘আমিই সে৷ আগুন আমাকে পোড়াইতে পারে না জল আমাকে পচাইতে পারে না বায়ু আমাকে শুষ্ক করিতে পারে  না অগ্ণিতে দহন করিতে পারে না জলে ভিজাইতে পারে না বায়ুতে শুষ্ক করিতে পারে না৷ আত্মা অচ্ছেদ্য অদাহ্য অক্লেদ্য অশোষ্য নিত্য সর্বব্যাপী৷

তুমি বলিবে এসব কথা তো আমিও জানি, কিন্তু মন তো শান্তি মানিতে চায় না! মন শান্ত করিবার একমাত্র উপায়  ভগবানে আত্মসমর্পণ৷ ইহা ভিন্ন শান্তি পাইবার আর কোন উপায় নাই৷ আমরা যতই জপতপ করি না কেন যতই ফোঁটা তিলক কাটি না কেন কিন্তু তাঁহাকে আমরা ভালবাসিতে পারি কই তাঁহাকে যে ভালোবাসিতে পারে মরণ তো তাহার কাছে একটা ফাঁকা আওয়াজ মাত্র৷ তাঁহাকে তেমন করিয়া ভাল বাসিয়াছিল বাংলার নিমাই প্রেমাবতার যীশুখ্রীষ্ট, আর আমাদের দেশের সেই সকল ছেলেরা যাহারা হাসিমুখে  মরণকে বরণ করিয়া লইতে পারিয়াছিল৷

মনের আবেগে আজ অনেক কথা লিখিয়া ফেলিলাম৷ তোমাদের কষ্টের কারণ আমি হইয়াছি জানিয়া আমি নিজের মনেও কম ব্যথা পাই নাই৷ তোমরা আমাকে ক্ষমা করিও৷ আমার সঙ্গীটি* এখনও বেশ ভালই আছে৷ অসুখ-বিসুখ আর নাই৷ আমিও ভালই আছি৷ ভালবাসা ও প্রণাম জানিবে৷