জীবজগৎ যেমন মুখ্যতঃ দুই বিভাজনে বিভক্ত–যুথবদ্ধ ও এককজীবী, ঠিক তেমনি ঘর–সংসারের ব্যাপারেও জীবজগৎ দুই ভাগে বিভক্ত৷ এক ঃ ঘরকন্না করা সংসারী (যেমন হাতী, সিংহ, পায়রা প্রভৃতি) দুই ৪ স্বৈরী বা স্বীৈরিণী (যেমন বাঘ, কুকুর, ছাগল, বেহাল প্রভৃতি)৷
সৃষ্টির গোড়ার দিকে মানুষ হয়তো বা স্বৈরী–স্বৈরিণী ছিল কিন্তু পরবর্ত্তীকালে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা সংসারী মানসিকতা এসেছিল৷ কিন্তু সেই সংসারী মানসিকতা হাতী–সিংহ–পায়রার সংসারী মানসিকতা থেকে কিছুমাত্র ভিন্ন ছিল না৷ কতকটা সহজাত সংস্কারের প্রেষণাতে পুরুষ–জীব ও স্ত্রী–জীব একটা মোটাটুটি পারিবারিক বোঝাপড়া করে নিয়েছিল৷ কিন্তু তাতে বিবকেগত দায়িত্ববোধ তো ছিলই না, বরং সম্পর্কগত শিথিলতার কারণে একে অন্যকে পরিত্যাগ করে যেমন ইচ্ছে যেখানে সেখানে চলে যেতে পারত৷ স্বৈরী–স্বৈরিণীদের সংখ্যা প্রচুর ছিল৷ এই স্বৈরী–স্বৈরিণীরা তথাকথিত সংসারীদের শান্তি বিঘ্ণিত করত ও বড় বড় কলহের সূত্রপাত ঘটাত৷
স্বৈরীরা সন্তানের কোন রকম দায়িত্ব নিত না, যথেচ্ছ ভাবেই ঘুরে বেড়াত, যার ফলে সন্তানের ভরণ–পোষণের, লালন–পালনের শৈশবকালীন দায়িত্বটা সম্পূর্ণভাবে মাতাকে বহন করতে হ’ত৷ একা মাতার পক্ষে সকল দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করা সম্ভব হ’ত না, যার ফলে অনেক শিশু অল্প বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হ’ত৷ যারা কোন রকমে বেঁচে থাকত তারাও মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবার পর অকূল পাথারে গিয়ে পড়ত৷ তখন তার প্রতি মাতার মমতা থাকত না৷ মাতা তার অপর নবজাত সন্তানের দিকেই নজর দিত৷ এই ছিল প্রাগৈতিহাসিক মানবের যুগ৷ মনে রাখতে হবে, এই প্রাগৈতিকহাসিক মানবের যুগেও বেদের কিছুটা অংশ রচিত হয়েছিল৷ রচনা করেছিল মুখ্যতঃ তথাকথিত সংসারীরা৷ স্বৈরী–স্বৈরিণীদের জীবন সম্পূর্ণতঃ পশুর জীবনের মতই ছিল৷
বিশ্বের সব কিছুই চলমান৷ আলেখ্যের পর আলেখ্য এগিয়ে চলেছে৷ দূরগত চিত্রগুলো ধীরে ধীরে মানসপট থেকে বিলীন হয়ে যায়৷ আজকের মানুষ সেই স্বৈরী–স্বৈরিরীদের যুগ ভুলে গেছে....ভুলে গেছে সেই তথাকথিত বন্ধনবর্জিত সংসারীদের কথাও৷ আর এই ভুলে যাওয়াটার পেছনে যে বিরাট পুরুষের একক অবদান রয়েছে সেই বিরাট পুরুষ হচ্ছেন শিব–ত্রিকালদর্শী শিব–তারকব্রহ্ম শিব৷ শিব দেখলেন বুদ্ধির প্রাখর্য মানুষের রয়েছে–সংরচনাত্মিকা চেতনাও রয়েছে৷ তবু মানুষ কেন এইভাবে পড়ে থাকবে৷ কেন মানুষ তার সুদূরের উত্তরসূরিকে অনন্তকালের জন্যে গ্লানিময় জীবনের আবর্ত্তে ফেলে রাখবে? কেন তাদের জন্যে একটা সৌরকরোজ্জ্বল, চেতনাঝলমল, নৈষ্ঠিকতাপূর্ণ জীবনাদর্শ তুলে ধরবে না৷ শিব বললেন, বিরাট আদর্শকে নিয়ে যদি কোন মানুষ চলতে চায়–যদি কেউ বিরাট আদর্শের এষণা–নিৰন্ধন গুরুতর দায়িত্বের জন্যে তার পক্ষে সংসারীদের বন্ধন সম্ভব না হয় তবেই সে এককজীবী হবে৷ কিন্তু এই এককজীবী স্বৈরী হবে না–হবে ‘যতি’৷ অন্যেরা বন্ধনহীন সংসারী হবে না–তাদের দায়িত্ববন্ধনযুক্ত সুশৃঙ্খল সংসারী হতে হবে৷
শিব বিধান দিলেন–নারী উপার্জনে সক্ষম হোক বা না হোক, নারীর ভরণ–পোষণের দায়িত্ব পুরুষকে নিতেই হবে৷ যেহেতু সে ভরণের দায়িত্ব নিলে তাই ‘ভৃ’ ধাতু, ‘তৃণ’ প্রত্যয় করে ‘ভর্ত্তৃ’ শব্দ তিনি তৈরী করে দিলেন, যার প্রথমার একবচনে ‘ভর্ত্তা’ (গ্রাম–বাঙলায় প্রচলিত ‘ভাতার’ শব্দটি এই ‘ভর্ত্তা’ শব্দের রূপান্তর)৷ এর ফলে শিশুসন্তানকে লালন–পালন করতে নারীর অনেক সুবিধা হয়ে গেল৷ সন্তানের জন্যে অন্ন–বস্ত্রের ব্যবস্থা করবার দায়িত্ব থেকে সে প্রায় অব্যাহতি পেল৷
শুধু তাই নয়, শিশু যখন কিছুটা বড় হ’ল তখন তার লালন–পালনের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব নারীর হাত থেকে (অর্থাৎ শিশুর মাতার হাত থেকে) পুরুষের ওপরে (অর্থাৎ শিশুর পিতার ওপরে) অর্পিত হ’ল৷
স্বৈরী স্বৈরিণীদের জীবনে তো বটেই, তথাকথিত সংসারীদের ক্ষেত্রেও শিশুর পিতৃপরিচয় থাকত না৷ শিশু কেবল মাতাকেই জানত৷ মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবার পর শিশু মাতাকেও ভুলে যেত৷ এরফলে অতি অল্প বয়সে মাতার স্নেহচ্ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে বর্ত্তমান মানুষের মনে যে সুমধুর, সুকুমার বৃত্তিগুলো রয়েছে সেগুলো বিকশিত হবার সুযোগ পেত না৷ মানবাত্মা, মানবমনীষা কুঁড়িতেই শুকিয়ে মরে যেত৷ ফুল হয়ে ফোটবার সুযোগ পেত না৷ অন্তর–মাধুর্যে বিশ্বকে প্রাণোচ্ছল করার সুযোগ সেদিনের মানুষ পেত না৷ পুরুষকে ভর্ত্তা রূপে ঘোষণা করে শিব মানুষ জাতির প্রতি তাঁর কর্ত্তব্যের একটা বিরাট অংশ প্রতিপালন করলেন৷
এখানেই কি শেষ না, এর পরে আরও আছে৷ শিব নারীকে ‘কলত্র’ বলে ঘোষণা করলেন, যার আসল মানেটা হচ্ছে, পুরুষের প্রতি ও সন্তানদের প্রতি সে এমনভাবে দায়িত্ব প্রতিপালন করবে যাতে কারো গায়ে ক্লেশের আঁচড়টুকুও না লাগে৷ এই নূতন ব্যবস্থা যারা মেনে নেবে তারা ‘বিবাহিত’ বলে ঘোষিত হবে৷ অন্যে সেই বিবাহ সংস্কারের সাক্ষী থেকে ওই বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে আশীর্বাদ দেবে ও সহযোগিতার আশ্বাস দেবে৷ বি–বহ ঘঞ্ প্রত্যয় করে ‘বিবাহ’ শব্দ নিষ্পন্ন হচ্ছে যার মানে হ’ল, এই সংস্কারটির পরে উক্ত পুরুষ, উক্ত নারী আর স্বৈরী–স্বৈরিণী থাকতে পারবে না, অথবা তথাকথিত সংসারীও থাকতে পারবে না৷ তাদের ‘ভর্ত্তা’অথবা ‘কলত্র’ হিসেবে পূর্ণ দায়িত্ব প্রতিপালন করতে হবে৷
‘নারী’ শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ৷ কিন্তু শিব ‘কলত্র’ শব্দটি ব্যবহার করলেন ক্লীবলিঙ্গ (Neuter gender) রূপে কারণ স্বামীর কাছে সে স্ত্রী বা স্ত্রীলিঙ্গবাচক হলেও সন্তান–সন্ততি বা অন্যদের কাছে সে পুরুষের সমান মহিমান্বিত৷ তাই বিবাহিতা স্ত্রীকে শিব ‘কলত্র’ হিসেবে অভিহিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ক্লীবলিঙ্গ শব্দ বলেও ঘোষণা করেছিলেন৷ ‘বিবাহ’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বিশেষ এক ধরণের দায়িত্ব নিয়ে নোতুন ভাবে জীবনধারাকে প্রবাহিত করা৷ এটাই হ’ল শৈব বিবাহের অন্তনির্হিত তাৎপর্য৷
শিব এই দায়িত্ব নিয়েই বিবাহ করেছিলেন৷ তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এই বিশ্বের প্রথম বিবাহ শিবই করেছিলেন৷ কলত্র যাতে ভর্ত্তার প্রতি তাঁর কর্তব্য ঠিকভাবে প্রতিপালন করেন অর্থাৎ ক্লেশ দূর করতে সদা সচেষ্ট থাকেন তাই তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল, ‘‘যদ্ ভর্ত্তুরেব হিতমিচ্ছতি তদ্ কলত্রম্’’৷ কলত্রের মনে যদি ভর্ত্তার প্রতি হিতের ভাবনা থাকে তবেই ঘর–সংসার মধুর হবে, তবেই খড়ের ঘরে সোণার সংসার রচিত হবে৷
(‘‘শিবের শিক্ষা’’–১, নমঃ শিবায় শান্তায়)