গত ১১ই মার্চ বিজ্ঞপ্তি জারি করে সিএএ (সিটিজেনশিপ এমেণ্ডমেন্ট এ্যাকট বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) কার্যকর করার কথা জানাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক৷ সিএএ কার্যকর হয় ২০১৯-২০ সালের ১০ই জানুয়ারী৷ তবে প্রয়োজনীয় বিধি তৈরী না হওয়ায় এতদিন সবপক্ষই নীরব ছিল৷ কিন্তু চারবছর পর দেশবাসী যখন লোকসভা নির্বাচনের সময়সূচী ঘোষনা শোণার জন্যে অপেক্ষা করছেন সেই সময় অকস্মাৎ সিএএ বিধি বলবৎ করার বিজ্ঞপ্তি জারি হলো৷ এখন যে কেউ চাইলেই নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করতে পারে৷
কিন্তু প্রশ্ণ আবেদন করলেই কি নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে? কেউ কেউ অবশ্য ক্যা বলবৎ হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সতর্ক করে বলেছেন কেউ যেন নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আবেদন না করেন৷ আবেদনের প্রথম শর্তই হলো নিজেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে স্বীকার করে নেওয়া৷ এরপর জটিল প্রক্রিয়া পেরিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়া বড়ই কঠিন৷
সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সংঙ্ঘাধিপতি সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর বলেছেন---যারা অত্যাচারের কারণে অন্যদেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা কোন নথি সঙ্গে এনেছে যে জমা দেবে৷ তাদের অনেকের কাছেই ভোটার কার্ড আধার কার্ড রয়েছে, যারা ভোট দিয়ে সাংসদ বিধায়ক নির্বাচন করেন তারা তো এমনিতে নাগরিক৷ তাহলে আবার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্যে আবেদন করার কি দরকার৷ তিনি আরও বলেন---আমরা প্রথম থেকেই নিঃশর্ত নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবী করে আসছি ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে যারা ভারতে এসেছে তাদের জন্যে৷ কিন্তু আইনে এমন সব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে যেন সব ঘর গুছিয়ে ভারতে থাকার জন্যে দেশ ছেড়ে এসেছে৷ সরকারের নাগরিকত্ব দেওয়ার সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ণ এখানেই৷
যে সব হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে এসেছেন এবং ইতিমধ্যে ভারতের নাগরিকত্ব পাননি, তাঁদের আবেদন করতে হলে আজকের প্রকাশিত রুলের তফশিল ১-এ-তে উল্লেখিত যে কোনও একটি কাগজ দাখিল করতে হবে৷ সেইগুলো হল আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের পাসপোর্ট, বার্থ সার্টিফিকেট, স্কুল সার্টিফিকেট, জায়গার দলিল বা ভাড়াটে থাকার দলিল বা যে কোনও ধরনের পরিচয়ের প্রমাণপত্র বা মা- বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুমার ওই সব দেশের বাসিন্দা থাকার প্রমাণপত্র বা ভারতের বিদেশি হিসেবে নথিভুক্ত থাকার প্রমাণপত্র৷ এ ছাড়াও মা-বাবার জন্মের তারিখের প্রমাণ, যেমন মা-বাবার বার্থ সার্টিফিকেট বা পাসপোর্ট৷ আর এগুলো না থাকলে আবেদনকারীর বার্থ সার্টিফিকেটে মা-বাবার ওইসব দেশের নাগরিকত্বের স্পষ্ট উল্লেখ থাকতেই হবে৷ এ সব কাগজপত্র ক’জনের আছে? সম্ভবত কারোরই নেই, তাহলে আবেদন করতেই পারবেন না৷ আশায় গুড়েবালি!
এছাড়াও, অনলাইনে আবেদন করলে সেই আবেদন প্রথমেই যাবে জেলা প্রশাসনের কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য৷ আবেদনকারীকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে শপথনামায় স্বাক্ষর করতে হবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে৷ তারপর জেলা পর্যায়ের কমিটি সেই শপথনামা অনলাইনে আপলোড করে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট সহ পাঠাবে এম্পাওয়ার্ড কমিটিতে৷ এম্পাওয়ার্ড কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে৷ প্রক্রিয়াটি মোটেই সহজ নয়৷ নিজেকে বিদেশি বলে ঘোষণা করতে হবে৷ ভারতে থাকার প্রমাণ দিতে হবে৷ ভোটার তালিকায় নাম থাকা ভারতে থাকার প্রমাণ হিসেবে দেওয়া যাবে না, যদিও রেশন কার্ড, সেন্সাস স্লিপ ইত্যাদি দেওয়া যাবে৷ এটা স্পষ্ট, এই নিয়মে আবেদন করে নাগরিকত্ব পাওয়া দূরাশা মাত্র৷ তাই নাগরিকত্ব আইনের ফাঁদে ফেলে বাঙালীকে বিদেশী বানাবার চক্রান্ত চলছে৷
নিশর্ত নাগরিকত্বের দাবী ঃ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ এর ধারাগুলো গতকাল কেন্দ্র সরকার কর্তৃক বলবৎ করাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে এবং বিশেষ করে আসামে যে বিভাজনের রাজনীতি আবারও শুরু হয়েছে তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সি আর পি সি সি, আসাম৷ সংগঠনের পক্ষ থেকে এক প্রেস বার্তায় বলা হয় যে দেশভাগের বলি অবিভক্ত ভারতের নাগরিকদের নিঃশর্তে নাগরিকত্ব প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি জাতীয় নেতারা ১৯৫০ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে দিয়েছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের রুলস তৈরি করা হয়েছে৷ শরণার্থীদের নিশর্থে নাগরিকত্ব প্রদানে আইনি সমাধান সুত্র বের করা না হলে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না৷ কেন্দ্র সরকার আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দেশজুড়ে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পূর্বে ধারাগুলো বলবৎ করেছে৷ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক পূর্বে একই উদ্দেশ্যে দেশের নাগরিকদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন গৃহীত হয়েছিল৷ বিতর্কিত এই আইনের বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সুপ্রিম কোর্টে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে যা আজও চলছে৷ ফলে এই আইনের ভবিষ্যত নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷ সি আর পি সি সি, আসাম এর পক্ষ থেকে দেশভাগের বলি নাগরিকদের নিশর্থে নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি জানায়৷
মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরও দাবী করেন কোন আবেদন নয়, আমাদের দাবী নিশর্ত নাগরিকত্ব প্রদান৷