২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসঙ্গী পাঁশকুড়া ব্লকের অন্তর্গত একটি আনন্দমার্গ স্কুলে বিকেল থেকেই পুরস্কার বিতরণী ও সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে৷ সবশেষে ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি নাটিকা---‘‘ধর্মের জয়’’ একটি ছোট্ট মেয়ে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করছিল৷ তার মিষ্টি-মধুর হাসি, আধো আধো কথা, মিটিমিটি চাহনি, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা ইত্যাদি এতখানি নয়নাভিরাম ছিল যে দর্শকরা অভিভূত হয়ে অনন্যচিত্তে তা উপভোগ করছিলেন৷ কারও কারও মনে হয়েছিল---পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ সত্যসত্যই কিছুক্ষণের জন্য মর্তভূমিতে এসে হাজির হয়েছেন৷ বয়স্কলোকেরা ভক্তি গদ গদ চিত্তে মুহুর্মুহু প্রণাম জানাতে শুরু করেছিলেন৷ একসময় অবিরাম করতালির মধ্য দিয়ে নাটিকা শেষ হল৷ সেদিনের অনুষ্ঠানের সভাপতি কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয়কারী ছোট্ট-মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন ও আলাপ-পরিচয় শুরু করলেন---‘‘কোন শ্রেণীতে পড়, নাম কী, বাড়ী কোথায়, ইত্যাদি ইত্যাদি৷ নাম জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দিল--- ‘আয়েশা খাতুন’ নাম শুণে সভাপতি মশাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন, নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে তিনি মেয়েটিকে পড়াশুনার ব্যাপারে কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় দিলেন৷
এরপর অতিথিদের জলযোগ পর্ব৷ তখন সভাপতি মশাই একান্ত আলাপচারিতায় শুরু করলেন---আনন্দমার্গ একটি ধর্মীয় সংঘটন বলেই জানি৷ এই স্কুলের শিক্ষকরা ও সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, একটি মুসলিম মেয়ে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করছে---এটা কী করে সম্ভব হল, স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ ও মেয়েটির অভিভাবক স্কুল---উভয়পক্ষই রাজী হলেন কিভাবে, ঐ স্থানে উপস্থিত আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী মহারাজ বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন---
আনন্দমার্গ একটি ধর্মীয় সংঘটন, তাঁদের ধর্ম---মানবধর্ম সেখানে হিন্দু মুসলিম, খ্রীষ্টান, জৈন ইত্যাদি সবাই আসতে পারেন৷ আনন্দমার্গীরা কোন মানুষকে হিন্দু-মুসলিম বা অন্য কোন কিছুভাবে দেখেন না, তাঁদের কাছে সবার একটাই পরিচয়---তা হল মানুষ, সেখানে কেউ উঁচু নয় বা কেউ নীচুও নয়৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই একটি মুসলিম মেয়েকে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করাতে আনন্দমার্গ স্কুলের শিক্ষকদের কোন অসুবিধা হয়নি৷ এরপর আরও অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল৷ যেমন---আনন্দমার্গের উদ্দেশ্য কী, সারা পৃথিবীব্যাপী তাদের সংঘটন, সংঘটন চালাবার জন্য অর্থ কিভাবে আসে, বামপন্থীরা আনন্দমার্গকে দেখতে পারেন না, তা সত্ত্বেও আনন্দমার্গ স্কুলগুলি রমরমিয়ে চলছে কিভাবে, আনন্দমার্গ শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরাজীর উপর এত জোর দেওয়া হয় কেন? পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণের প্রকৃত ঘটনা কী ইত্যাদি ইত্যাদি৷ সবকিছু নিয়েই নাতিদীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল৷ তবে বর্তমান প্রবন্ধটি আনন্দমার্গের শিক্ষাসম্পর্কীয় আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে৷
পথে-ঘাটে, ট্রেনে বা বাসে চলতে ফিরতে একটা কথা প্রায়ই শোনা যেত---আনন্দমার্গকে পছন্দ করিনা তবে এদের শিক্ষাপদ্ধতি খুব ভাল৷ আসল রহস্যটি আনন্দমার্গের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে৷ আনন্দমার্গের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল--- ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’ অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষা হল তাই যা আমাদের মুক্তির পথ দেখায়৷ এই মুক্তি ত্রিবিধ---(১) জাগতিক (২) মানসিক (৩) আধ্যাত্মিক৷ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে মানুষের সর্বনিম্ন যে প্রয়োজন অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের সুব্যবস্থা শিক্ষার মাধ্যমেই হবে৷ মানুষ শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকে না৷ তার আছে মন, আছে বুদ্ধি ও বিবেক৷ তার বুদ্ধি যাতে সঠিকপথে পরিচালিত হয়,মন যাতে সর্বপ্রকার কুসংস্কারমুক্ত হয়, সংকীর্ণতামুক্ত হয়------ পাঠ্যপুস্তকগুলি সেভাবেই রচিত হবে, এছাড়াও আমি কে কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাব ইত্যাদি অধ্যাত্ম বিষয়ক যে ক্ষুধা তারও নিরসন ঘটবে শিক্ষার মাধ্যমে, মহান দার্শনিক, ঋষি, শিক্ষাবিদ, শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের (যাঁকে তাঁর ভক্তরা ‘আনন্দমূর্ত্তি’ অভিধায় ভূষিত করেন) কথায় শিক্ষা হবে নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক৷ সবার মাথার রয়েছে ঈশ্বর৷ তাঁকে কেউ ডাকেন ‘কৃষ্ণ’ বলে৷ কেউ বলেন ‘আল্লা’ কেউ বলেন ‘খ্রীষ্ট’ ইত্যাদি ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি সবার পিতা অর্থাৎ পরমপিতা, আমরা সবাই তাঁর সৃষ্ট সন্তান৷ সে অর্থে আমরা পরস্পর ভাই-ভাই, শুধু মানুষকে ভালবাসা ‘মানবতাবাদ’৷ কিন্তু এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও রয়েছে পশুজগত ও উদ্ভিদজগত পশুপাখী, কীটপতঙ্গ গাছপালা সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি৷ এরাও আমাদের ভাই-বোন, কেননা সবার পিতা একজনই৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় এদের সবাইকে ভালবাসার কথা বলেছেন৷ এরই নাম দিয়েছেন---‘নব্যমানবতাবাদ’৷ একটি শিশু শৈশব থেকেই পঠন পাঠনের মাধ্যমে সবাইকে ভালবাসতে শিখবে৷ সে জানবে মানুষ যেমন তার আত্মীয়, পশু-পাখী, কীটপতঙ্গও তার আত্মীয় ঠিক সেরকমভাবে গাছপালা ও তার আত্মীয়, এই কথাটিই কবি দার্শনিক তাঁর গানের কলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন---
‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে
সব কিছু করে যায়৷
একথাও যেন মনে রাখে
পশুপাখি তারপর নয়---
তরুও বাঁচিতে চায়৷’’
আনন্দমার্গের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরাজীর উপর সমধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ বর্তমানে ইংরাজী বিশ্বভাষা৷ সারা পৃথিবীতে ইংরাজীর মাধ্যমেই সর্বপ্রকার যোগাযোগ রক্ষিত হয়৷ আনন্দমার্গের চারপ্রকার স্কুলের মধ্যে একটি হল ইংরাজী মাধ্যম স্কুল, তবে ইংলিশ মিডিয়াম হলেও এখানে মাতৃভাষার উপরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ উদাহরণ স্বরূপ---সারা ভারতবর্ষে আনন্দমার্গের একই সিলেবাস কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাংলা,আসামে অসমীয়া, গুজরাটে গুজরাটী, উড়িস্যার ওড়িয়া ইত্যাদি নিজ নিজ মাতৃভাষার উপরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ফলে আনন্দমার্গ স্কুল থেকে পাশ করে পরবর্তীকালে ভারতের বা বহির্ভারতের কোন স্থানে খাপ খাইয়ে নিতে ছাত্রছাত্রাদের কোন অসুবিধা হয় না৷ একটি ভাষা চিরকাল তার একই মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকে না৷ অদূর ভবিষ্যতে ইংরাজীর ভাষার গুরুত্ব যদি হ্রাস পায় এবং অন্য কোন ভাষা যদি তার স্থান দখল করে, তবে আনন্দমার্গ তখন সেই ভাষাকেই বিশ্বভাষা হিসাবে মেনে নেবে৷
আনন্দমার্গের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শ্রেণীতে ছাত্রসংখ্যা খুবই সীমিত রাখা হয় যাতে শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রার প্রতি ব্যক্তিগত নজর দিতে পারেন৷ একটি শ্রেণীতে ৮০ বা ১০০ ছাত্র থাকলে কোন শিক্ষকের পক্ষেই ব্যষ্টিগতভাবে প্রতি ছাত্রকে লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়৷ এখানেই আনন্দমার্গ স্কুলগুলির বাড়তি সুবিধা,
সর্র্বেপরি সমাজের সর্বস্তরের ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষার সুযোগ পায়, সেজন্য আনন্দমার্গ স্কুলগুলিতে বেতনের পরিমান খুবই কম র াখা হয়৷ ফলে খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলেমেয়েরাও এখানে পড়াশুনার সুযোগ পায় যা আর কোন প্রাইভেট স্কুলে পায় কিনা সন্দেহ৷
এভাবেই আনন্দমার্গ স্কুলগুলি সারা বিশ্বে শিক্ষাবিস্তার কার্যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে এবং সরকারী শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূরকরূপে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে৷