আজ থেকে প্রায় ৪৬০০ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা এই অদ্ভুত লিপির প্রচলন করেন যা মূলত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সিলমোহর ও ট্যাবলেটের উপরে উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়৷ প্রায় ১০০ বছর ধরে অসংখ্য পণ্ডিত ও উৎসাহী মানুষ সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছেন৷ তাঁদের বেশির ভাগই বলেন সিন্ধু লিপির সিলমোহরগুলিতে বিভিন্ন রাজা, ব্যবসায়ী, বা দেবদেবীর নাম সংস্কৃত, তামিল ইত্যাদি প্রাচীন ভাষায় বানান করে লেখা৷ কিন্তু এঁদের কারও পাঠোদ্ধারই সর্বজনস্বীকৃত নয়৷
বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়ে সঠিক পাঠোদ্ধারের পথ খুঁজে বের করেছেন৷ তাঁর মতে, সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহরগুলি আসলে খাজনা আদায় সংক্রান্ত সিলমোহর৷ আর সিন্ধুলিপিওয়ালা ছোট ট্যাবলেটগুলো ছিল খাজনা আদায়ে সংক্রান্ত কারিগরি শিল্প ও ব্যবসা করার লাইসেন্স৷ সিন্ধু নগরীগুলিতে বিভিন্ন পণ্য মাপজোক করে, তাদের উপরে নির্ধারিত বিভিন্ন রকমের খাজনা আদায় করা হত৷ খাজনা আদায়ের পরে সেই পণ্যবাহী বস্তা,পাত্র ও বাক্সদের গায়ে সীলমোহরের ছাপ দেওয়া নরম মাটির ট্যাগ এঁটে দেওয়া হত, যাতে কোন পণ্যে কর আদায় হয়েছে, কোন পণ্যে কর বকেয়া-তা বোঝা যায়৷
২০১৯ সালে ‘নেচার ডট.কম’- এ প্রকাশিত বহতার আর এক বহুসমাদৃত প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, সিন্ধুলিপির চিহ্ণগুলি আসলে এক একটি শব্দ বা অর্থ বোঝায়, কোনও বর্ণ বা অক্ষর বোঝায় না৷
সিন্ধুলিপির ছোট ছোট ট্যাবলেট, যেগুলি বাণিজ্যিক বা খাজনা আদায়ের ছাড়পত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত, তাদের সামনের দিকে ছাড়পত্র সংক্রান্ত পণ্য, বাণিজ্য, কারিগরিশিল্প ও খাজনার নাম লেখা থাকত৷ আর পিছনে এক ধরনের পরিমাপ ও সংখ্যা সংক্রান্ত লিপিচিহ্ণ থাকত, যেখানে মূলত দুই, তিন, ও চারটি দাঁড়ি দিয়ে লেখা সংখ্যার ব্যবহার হত৷ বহতার মতে ট্যাবলেটেগুলির পিছন দিকের লিপিচিহ্ণগুলি একই পণ্য বা শিল্প অথবা বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত ছাড়পত্রে কয়েকটি বিশেষ লাইসেন্স স্ল্যাবের পরিমাণ বোঝাত৷ বর্তমানেও ভারতে একই ধরনের শিল্পের জন্য পৃথক লাইসেন্স স্ল্যাব ব্যবহার হয়৷ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও অনুরূপ বাণিজ্যিক সিলমোহরের উল্লেখ রয়েছে৷ সিলমোহরগুলিতে একশৃঙ্গ (ইউনিকর্ন), ষাঁড়, হাতি, বাঘ, ইত্যাদি প্রাণীর ও কিছু দেবদেবীর ছবিও থাকত, যেগুলি সম্ভবত বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থা (ট্রেড গিল্ড) অথবা শাসকবর্গের পরিচায়ক চিহ্ণ হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ বহতার এই প্রতিপাদ্য অন্তত ৯৫ শতাংশ পুরনো পাঠোদ্ধারের ভিত নাড়িয়ে দেয়৷ সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার শেষ পর্যন্ত করা যাবে কি না এই প্রশ্ণে বহতা জানান--- ‘‘বর্তমানে উপস্থিত তথ্যের ভিত্তিতে অনেক চিহ্ণের প্রকৃত অর্থ বোঝা না গেলেও, কিছু চিহ্ণের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে৷’’