এই মুহূর্তে সমগ্র ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে বাঙালি জাতি৷ বাঙালি জাতির ভাগ্যে এই বিপদের সূচনা হয়েছিল দেশভাগের অনেক আগে থেকেই৷ বিশ্ব উপনিবেশবাদী ইংরেজ জাতি ভারতবর্ষের মাটিতে পা রেখেই বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি জাতির শৌর্য-বীর্যের কথা৷ তাই তাঁরা সিপাহী বিদ্রোহ দমনের মধ্য দিয়ে মূলত বাঙালি জাতির দমন শুরু করেছিলেন৷ এবং ক্রমান্বয়ে বাঙলা ও বাঙালির দানা ছাটার কাজ শুরু করে দেন৷ তারই ফলশ্রুতিতে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুবা বাঙ্গালা ভেঙে বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যা বিভক্ত করণ৷ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ করা৷ এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ ভাগ করে বাঙালিকে হীনবল দুর্বল করে দেওয়া৷ এ ইতিহাস আমরা সকলেই জানি৷ আর এই ইতিহাসের পিছনে মনস্তত্ত্ব ছিল, ভারতবর্ষে দীর্ঘ মেয়াদি শাসন-শোষণ কায়েম রাখতে গেলে অমিত ত্যেজ বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা৷ কারণ অমিত তেজ এবং সম্পদ ও সম্ভাবনায় ভরা বাঙালি জাতি সহজে কোনো কিছুর সঙ্গে আপোষ করে না৷ তাই অতীতের এবং বর্তমানের শাসক-শোষকরা বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে ভৌমগত, জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িকগত নানান বিভাজনে বিভক্ত করেছে৷ প্রথমত, বাঙলার সীমানা খর্ব করা৷ দ্বিতীয়ত, বাঙালিকে হিন্দু-মুসলমানে বিভাজিত করা৷ তৃতীয়ত, হিন্দু বাঙালির মধ্যে আবার রাজবংশী, মতুয়া, কুর্মি, মাহাতো, কামতাপুরি ইত্যাদিতে বিভক্ত করা৷ এই বিভাজন প্রক্রিয়া এপারের ভারত-বঙ্গ এবং ওপারের স্বাধীন বাংলাদেশ উভয় বাঙলাতেই সমান ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের পুঁজিবাদী শাসক শোষকেরা৷ উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে সে কৌশল এখন দ্রুত সাধারণ মানুষের মনে ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে৷ আর তাই সম্প্রতি আমরা দেখছি বিশুদ্ধ ইসলামের নামে ওপারের স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানেরা বাঙালি জাতিসত্তা ভুলে গিয়ে বাঙালি হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন করছে৷ আবার এপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম-বঙ্গ, ত্রিপুরা-বঙ্গ সহ বিভিন্ন বঙ্গে অসাম্প্রদায়িক হিন্দু বাঙালির মনে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব ছড়ানো হচ্ছে৷ ফলে বাঙালি এখন শতধা বিভক্ত৷ আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে চিরকালের শাসক-শোষকেরা৷
ভারতের বর্তমানের যাঁরা শাসন ক্ষমতায় আছেন তাঁরা যে চরম পুঁজিবাদীদের মানস-পুষ্ট শাসক তা বিষদে ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই৷ সুতরাং এই শাসকরা হিন্দুত্বের নামে হিন্দু বাঙালিদের চোখে আসলে ঠুলি পরিয়ে দিতে চাইছেন৷ এর প্রমাণ এন. আর. সি. এর নামে অসমে বারো লক্ষ হিন্দু বাঙালিকে নাগরিকত্বহীন করা৷ বাংলাদেশী মুসলমান বিতরণের নামে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাংলায় কথা বলা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদেরকে পুশ ব্যাক করা৷ এমন কী হিন্দু বাঙালিদেরকেও ধরপাকড় করা৷ আবার সি. এ. এ.-এর নামে হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইনটাও আসলে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু বাঙালিদের চিহিণত করণ করে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া৷ নইলে সম্প্রতি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের আগে আসা হিন্দু বাঙালিদেরকে ভারতের বিভিন্ন বঙ্গে কেন ধরপাকড় এবং আইনি হ্যারাজ করা হচ্ছে৷ আসলে এ সবই হচ্ছে অমিত তেজ এবং সম্ভাবনাময় বাঙালি জাতিকে হীনবল দুর্বল করে দেওয়ার কৌশল৷ এই কৌশলের নাম মানস-অর্থনৈতিক শোষণ৷ বর্তমানের পুঁজিবাদী শাসক-শোষকেরা আগের মতো দেশ দখল করে শাসন-শোষণের পরিবর্তে এই মানস-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণের কৌশল অবলম্বন করেছে৷ এই কৌশলে পুঁজিবাদীদের কাছে এক একটি দেশ আসলে এক একটি বাজার৷ সেখানে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করাটাই আসল জয়৷ এই জয়ের লক্ষ্যে ভারতের হিন্দু নামধারী বিজেপি সরকার বাংলাদেশে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে হিন্দুদের নির্যাতন থামাতে না গেলেও পণ্য রপ্তানি যাতে বন্ধ না হয় তারজন্য কিন্তু দরবার করতে গিয়েছিলেন৷ একটা কথা মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদীদের কিন্তু কোনো দেশ নেই, জাতি নেই, ধর্ম নেই৷ তাদের একটাই রূপ, তাঁরা শাসক ও শোষক৷ তাঁদের মুখে হিন্দু-মুসলিম বুলি আসলে বোকা বানাবার কৌশল৷ এটা বুঝতে না পারলে বাঙালিরা কোনোদিন নিজেদের বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারবেন না৷ সুতরাং আজ সময় এসেছে হিন্দু বাঙালি, মুসলমান বাঙালি, মতুয়া বাঙালি, রাজবংশী বাঙালি, কামতাপুরি বাঙালি, কুর্মি বাঙালি, বাংলাদেশী বাঙালি, ভারতীয় বাঙালি ভুলে গিয়ে সকল বাঙালি একসঙ্গে আওয়াজ তুলুন ‘আমরা বাঙালি’৷ সেই সঙ্গে এই আওয়াজও তুলুন সকল বাঙালির জন্য প্রকৃতিসৃষ্ট নিজস্ব আবাসস্থল ‘বাঙালিস্থান’ চাই৷ হ্যাঁ, ‘বাঙালিস্থান’৷ পশ্চিমে রামগড় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পূর্বে আরাকান ইয়োমা, উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বঙ্গপোসাগর পর্যন্ত প্রকৃতিসৃষ্ট বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগই হলো ভৌম বাঙালিস্থান৷ এটি কোনো মনুষ্যসৃষ্ট বিভাজন নয় এটি প্রকৃতিসৃষ্ট বিভাজন৷ সমগ্র পৃথিবী এই রকম বহু প্রাকৃতিক বিভাজনের বহু বৈচিত্রে্যর সমৃদ্ধ গ্রহ৷ এর প্রতিটি ভৌম-অঞ্চল এবং তার ভৌম-জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক ও ভাষা-সাংস্কৃতিক সকল বিষয়ের সঠিক উপযোগ গ্রহণ করে এবং যুক্তিসঙ্গত বন্টন করে সমৃদ্ধ বিশ্ব পরিবার গড়ে তুলতে হবে৷ কোনো ভৌম-জাতিকে শোষিত বঞ্চিত করে তা সম্ভব নয়৷
ক্ষুদ্র স্বার্থের বশবর্তী হয়ে আজ যারা বাঙলা ও বাঙালির প্রভূত ক্ষতি করছে অবিলম্বে সকল বাঙালিকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে৷ নইলে এই বাঙালি নিধন যজ্ঞ বন্ধ করা যাবে না৷ মনে রাখতে হবে, বাঙালি বাঙালিই৷ হোক সে বাঙালি আরাকানের, অসমের, ঝাড়খণ্ডের, উড়িষ্যার, বিহারের, নেপালের, মণিপুরের, আন্দামানের, বাংলাদেশের, পশ্চিমবঙ্গের, দণ্ডকারণ্যের৷ পৃথিবীর প্রতিটি ভৌম জাতিসত্তার মানুষের নিজস্ব আবাসস্থল আছে৷ যেমন ইংরেজদের ইংল্যান্ড, ওলন্দাজদের হল্যান্ড, খসদের খসমীর বা কশ্মীর, রুশদের রাশিয়া, আফগানদের আফগানিস্থান, রাজপুতদের রাজস্থান তেমনই বাঙালিদের বাঙালিস্থান৷ এর মধ্যে সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা নেই৷ আছে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত৷
অতীত থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষ সহ সমগ্র বিশ্বের অপরাপর জনগোষ্ঠী বদ্বীপ বাঙলার উন্নত মেধা ও মগজকে ঈর্ষা করে চলেছে৷ যখনই বাঙলা ও বাঙালি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে তখনই সকলে মিলে বাঙলা ও বাঙালিকে অবদমিত করেছে৷ কখনোই বাঙালিকে মাথাচাড়া দিতে দেয়নি৷ অতীতে এর বহু উদাহরণ আছে৷ বাঙলা ও বাঙালিকে শুধু অবদমনই করেনি, বদ্বীপ বাঙলার সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে চিরদিন শোষণ করেছে৷ সেই শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করতে অবাঙালি শাসক ও শোষকরা আবারও উঠে পড়ে লেগেছে বাঙালি নিধনে, বাঙালি বিতাড়ণে৷
সুতরাং আর মুহূর্তের জন্যও কালবিলম্ব নয়! অবিলম্বে সমগ্র ভৌম বাঙলার সকল বাঙালিকে ‘আমরা বাঙালি’ পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে৷ এবং সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘বাঙালিস্থান’ নামক ভৌম-বাঙলাকে পুনঃরুদ্ধার করতে হবে৷ নইলে বাঙালি বাংলাদেশে মার খাবে৷ আরকানে মার খাবে৷ অসম-মণিপুরে মার খাবে৷ মহারাষ্ট্র-গুজরাটে মার খাবে৷ দিল্লি-উড়িষ্যায় মার খাবে৷ সর্বত্রই মার খাবে আর হীনবল দুর্বল হয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন ভুলে যাবে৷ আর এতেই চিরকালের শাসক-শোষকের লাভ ও লক্ষ্য৷ সুতরাং আবারও বলছি, আমরা বাঙালিরা যদি বাঙালিত্ব নিয়ে বাঁচতে চাই সকল বিভেদ ভুলে, সকল হিংসা-দ্বেষ ভুলে বাঙালি জাতিসত্তার ‘আমরা বাঙালি’ পরিচয় এবং বাঙালি জাতির নিজস্ব আবাসস্থল ‘বাঙালিস্থান’ গঠনের জন্য তীব্র প্রতিবাদ এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷ নইলে বাঙালি জাতির এই অধপতন কেউ ঠেকাতে পারবে না৷
- Log in to post comments