সমবায় সম্পর্কে অনেকের মনে প্রশ্ণ জাগতে পারে৷ কারণ আজ বেশীর ভাগ দেশেই সমবায় অসফল হয়েছে৷ এই উদাহরণের ওপর ভিত্তি করে’ সমবায়কে দোষারোপ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে না৷ কারণ সমবায়ের সাফল্যের যে অপরিহার্য তত্ত্ব তা বেশীর ভাগ দেশ সৃষ্টি করতে পারেনি৷ সমবায়ের সাফল্য নির্ভর করে মূলতঃ তিনটি তত্ত্বের ওপর–নীতিবাদ, কড়া তত্ত্বাবধান (Supervision) ও জনগণের হদয় দিয়ে সমবায়কে গ্রহণ৷ এ তিন তত্ত্বের মধ্যে যেখানে যতটুকু রয়েছে সেখানে সমবায় ততটুকুই সাফল্য অর্জন করেছে৷ যেমন, ইজরায়েল চতুর্দিকে শত্রু বেষ্টিত হবার জন্যে ওখানকার জনগণের মধ্যে এক স্বয়ং–নির্ভরশীলতা চেতনা গড়ে’ উঠেছে–কারণ জনগণ মন–প্রাণ দিয়ে তাদের অর্থনীতিকে মজবুত করতে চায়, তাই সেখানে তারা সমবায়ের দ্বারা শুষ্ক মরুভূমিকে শস্য–শ্যামলা করে’ তুলেছে৷ ঠিক সেই মনোভাব ভারতে গড়ে’ তোলা হয়নি বলে’ সমবায় অসাফল্যের নমুনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ভারতের সমবায় অর্থনীতির উন্নতির জন্যে তৈরী হয় নি– তৈরী হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে৷ তাই এখানে সমবায় সফল হওয়াটাই আশ্চর্যজনক হ’ত৷
সমবায় প্রতিষ্ঠান সাধারণতঃ গড়ে’ ওঠে সেই জনমণ্ডলীর মিলিত শ্রমে ও বুদ্ধিতে, যে জনমণ্ডলী একই অর্থনৈতিক কাঠামোয়, একই প্রয়োজনের তাগিদ নিয়ে বাস করছে, ও সামবায়িক ভিত্তিতে উৎপন্ন বস্তুর বাজারও হাতের কাছে পাচ্ছে৷ উল্লিখিত তিনটি তত্ত্বের একত্র সমাবেশ না হলে সমবায়ের বিকাশ হতে পারে না৷ ঠিক ভাবে পরিচালিত হলে সমবায়–ব্যবস্থা ব্যষ্টিগত মালিকানার সমস্ত ত্রুটি থেকে মুক্ত হবে, ও বিজ্ঞান–সম্মত পদ্ধতির দ্বারা এতে উৎপাদনের পরিমাণবৃদ্ধিও সম্ভব হবে৷
সমবায় প্রথার অন্তর্নিহিত ভাবটি হ’ল বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার ভাব৷ কেবল এই মানবিক ভাবের ভিত্তিতেই মানব সমাজের সুষ্ঠু ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রগতি ঘটানো সম্ভব৷ মানবজাতির মধ্যে পূর্ণ ও চিরস্থায়ী ঐক্যস্থাপনের পক্ষে সমবায়–র্থনৈতিক ব্যবস্থাই আদর্শপন্থা৷ পৃথিবীর সকল দেশে সকল মানুষেরই উচিত ব্যাপকভাবে এই সমবায় প্রথার প্রচলন করা৷
শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য সবকিছুই যতদূর সম্ভব সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই পরিচালিত হওয়া দরকার৷ এই জন্যেই প্রয়োজনবোধে সমবায় সংস্থাগুলিকে বিশেষ ধরণের সুবিধা দিতে হবে, রক্ষাকবচের* ব্যবস্থা করতে হবে, ও ধীরে ধীরে বিশেষ বিশেষ ধরণের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্র থেকে ব্যষ্টিগত মালিকানা বা ব্যষ্টিগত পরিচালনা ব্যবস্থা রহিত করতে হবে৷
অতিরিক্ত ক্ষুদ্রত্ব বা ক্ষুদ্রত্ব ও তৎসহ জটিলতার জন্যে যে সকল সংস্থা সামবায়িক ভিত্তিতে পরিচালনা করা অসুবিধাজনক কেবলমাত্র সেগুলিই ব্যষ্টিগত পরিচালনায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে৷
অতিরিক্ত বৃহৎ, অথবা বৃহত্ব ও তৎসহ জটিলতার জন্যে যে সকল সংস্থা সামবায়িক ভিত্তিতে পরিচালনা করা অসুবিধাজনক, সেগুলির ভার (যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সেখানে) স্থানীয় রাজ্য সরকার, অথবা (যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নয়, সেখানে) স্থানীয় লোকসংস্থা নিতে পারে৷
কেন্দ্রীয় সরকার বা (বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে) বিশ্বরাষ্ট্রীয় সরকারের পরিচালনায় শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য সংস্থাগুলি না থাকাই বাঞ্ছনীয়৷ কারণ, সেক্ষেত্রে উক্ত সংস্থাগুলির পরিচালনার ব্যাপারে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ সুযোগ তো থাকেই না, পরোক্ষ সুযোগও বড় একটা থাকে না, আর তাই পুঁজিবাদী, সুবিধাবাদী মতলববাজ রাজনীতিকেরা সহজেই এগুলিকে হাতিয়ে নিতে পারে, ও জনসাধারণের অর্থের অপচয় ঘটতে পারে৷
জনসাধারণকে সমবায় সম্পর্কে উৎসাহিত করতে সমবায় শুরু করার আগে মানসিক প্রস্তুতি চালিয়ে পরিবেশকে অনুকুল করে’ নিতে হবে, আদর্শ সমবায় গড়তে হবে, ও সমবায় ব্যবস্থার উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করে’ তুলতে হবে৷ সমবায়ের উৎপাদন ও বণ্টন উভয় ক্ষেত্রেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে৷ যথাযথ আধুনিকীকরণ উৎপাদনের বৃদ্ধি ঘটাবে৷৯
সমবায়ের জন্যে মানুষকে উৎসাহিত করতে হলে প্রথমে কয়েকটি সার্থক নমুনা তৈরী করা চাই, তার জন্যে পাইলট প্রোজেক্ট (Pilot Project),, মেসিন ষ্টেশন (Mechine Station), জলসেচের উপযুক্ত ব্যবস্থা, ভাল বীজ, শস্য–বিনষ্টকারী পতঙ্গ থেকে শস্য উদ্ধারের পদ্ধতি প্রভৃতি নানাপ্রকার ব্যবস্থা করা উচিত৷
প্রতিটি সমবায়ের সদস্যরা মিলে নিজের নিজের সমবায়ের জন্যে একটি করে’ পরিচালক মণ্ডলী (বোর্ড অব ডাইরেক্টরস্) গড়ে’ তুলবেন৷ এই বোর্ডই স্থির করবে কোন বছর সংশ্লিষ্ট সমবায়ের সদস্যদের মধ্যে লভ্যাংশের কতটা বণ্টন করা হবে, কতটা ডিবিডেণ্ট রূপে দেওয়া হবে, ইত্যাদি৷