গতরাতে আমি মানুষ জীবনের বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন দিশায় যে চলে সে সম্বন্ধে কিছু ৰলেছিলুম৷ এখন, জীবনের সফলতা লাভের প্রসঙ্গে এক চিরন্তন প্রশ্ণ আছে৷ কিছু মানুষ অনেক কিছু করেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়, আবার কিছু মানুষ অল্প সময়ের জন্যে কিছু করে আর সাফল্যের শিরোপায় ভূষিত হয়৷ এর পিছনে রহস্যটি কী? কেন একজন সফল হয়, আর একজন তা হয় না?
তোমরা জান যে যোগসাধনার প্রথম প্রবর্তক ভগবান সদশিব...আমি যোগদর্শন ৰলৰ না, ৰলৰ যোগসাধনা৷ ভগবান সদাশিব ৰলতেন যে, কোন মানুষ যেন মনে কোন জটিলতা বা মলিনতার বোঝা নিয়ে কাজ না করে, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সাধককে সমস্ত মলিনতা তথা মনের সমস্ত ভার থেকে মুক্ত হতে হৰে মানুষের না থাকৰে কোন মহাম্মন্যতা(superiority complex), না থাকৰে হীনম্মন্যতা(inferiority complex) বা ভীতম্মন্যতা(fear complex), না থাকৰে কোন পরাজিত সুলভ মনোভাব(deafeatist complex)৷ অর্থাৎ মন থাকৰে সম্পূর্ণ সন্তুলিত অবস্থায়৷
আসলে পার্বতী এই প্রশ্ণ করেছিলেন ভগবান সদাশিবকে৷ পার্বতী ছিলেন শিবের স্ত্রী৷ পার্বতীর প্রশ্ণ ছিল, ‘‘জীবনের সফলতা লাভের রহস্য কী?’’ শিব উত্তরে ৰললেন, ‘‘সফলতা লাভের সাতটি উপায় আছে৷’’ তিনি ৰললেন, ‘‘প্রথম উপায়টি হচ্ছে, ‘ফলিষ্যতি ইতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধেঃ প্রথম লক্ষ্যণম্’’৷ অর্থাৎ, ‘‘আমি আমার ব্রতে সফলীভূত হৰোই হৰো’---এই দৃঢ় প্রত্যয় সাধকের মধ্যে থাকতেই হৰে৷ এটাই হচ্ছে সফলতা লাভের প্রথম তত্ত্ব৷ একজন মানুষ কিছু একটা করছে, কিন্তু তার মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস নেই---বরং তার মনে প্রশ্ণ, ‘আমি কী সফল হৰো?, যদি আমি সফল না হই’---এই সব৷ তাহলে সে কখনই সফল হৰে না৷ তাই ‘আমি সফল হৰই’ এটি হচ্ছে প্রথম প্রয়োজনীয় তত্ত্ব৷ তোমরা ৰুঝলে? আমার মনে হয় যারা ইংরেজি অত ৰোঝো না, তারাও কিছুটা ৰুঝতে পারছ৷[হাসি]৷
দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে, ‘‘দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধায়া যুক্তং’’৷ নিজের লক্ষ্যের প্রতি, আদর্শের প্রতি বিশ্বাস থাকতেই হৰে৷
তৃতীয় হচ্ছে, ‘‘তৃতীয়ং গুরু পূজনম্’’---গুরুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা থাকতে হৰে৷ এই ব্যাপারটি আমার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, কেননা আমার বিষয় হচ্ছে মনেক ভারমুক্ত রাখা৷
‘‘পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ’’---পঞ্চম হচ্ছে আত্মসংযম থাকতে হৰে৷ অনেক খেলুম, ঘুমোলুম, পান করলুম, এইসব দুর্বলতা সাধককে মোটেই সাহায্য করে না৷ জীবনে অবশ্যই একটা সন্তুলন থাকতে হৰে, আত্মসংযম থাকতে হৰে৷
আর, ‘‘ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহারো’’---অর্থাৎ একজনকে সন্তুলিত আহার করতে হৰে---খুব বেশীও নয়, খুব কমও নয়৷ তা যথেষ্ট হতে হৰে, সাত্ত্বিক হতে হৰে, অথবা গৃহীদের ক্ষেত্রে রাজসিক হতে হৰে৷ অবশ্যই তামসিক নয়, কেননা তুমি যা খাও তা তোমার দেহের কোষ-কে(cells) তৈরী করে৷ আর তোমার মন, দেহের সমস্ত কোষের মনের সমাহারে তৈরী এক সামবায়িক মন৷ তাই তুমি যদি তামসিক খাবার খাও, তোমার মনও তামসিক হয়ে যাৰে৷ তোমার মন অধোগামী হয়ে পড়ৰে, পতিত হয়ে যাৰে৷ শিবের এই ছিল উপদেশ৷ তাহলে তাঁর উপদেশাবলীর মধ্যে একটি ছিল---‘‘চতুর্থসমতাভাবো’’---অর্থাৎ তোমার মন অবশ্যই সমতাসম্পন্ন হৰে৷ এখন সমতাপূর্ণ মন(balanced mind) কাকে ৰলৰ? মানুষের মনের দু’টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ আছে---একটি হচ্ছে চিন্তা করা, আর একটি স্মরণ করা, স্মরণে রাখা৷ উপযুক্ত মনন আর উপযুক্ত স্মরণ কাকে ৰলৰ? যদি চিন্তা উপযুক্ত হয়, স্মরণশক্তিও উপযুক্ত হয়, তাহলে আমি ৰলৰ যে মানুষটি সমস্ত মলিনতা থেকে মুক্ত৷
এখন, এই যে দু’টি বৈশিষ্ট্য---চিন্তা করা আর মনে রাখা---এই দু’টি পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত৷ আমরা বাইরের বস্তুতান্ত্রিক জগতে যা দেখি তা আমাদের মনে প্রতিফলিত হয়৷ এই প্রতিফলন প্রথমে আসে স্নায়ুতন্তু থেকে, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা পৌঁছায় স্নায়ুকোষে তখন আমাদের মনের পটে এক প্রতিফলনের(reflection) সৃষ্টি হয়, আর যখন তা হয় তখন সেই বস্তুটির অস্তিত্ব আমরা উপলব্ধি করি৷ ‘অনুভব করা’ মানে যা আমরা দেখি, শুণি, আস্বাদ নিই৷ এটি হচ্ছে চিন্তন৷ আর চিন্তার দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে এই রকম যখন মনের ওই তরঙ্গ আমাদের মানসপটে প্রতিসরিত(refracted) হয়৷ এগুলি হচ্ছে মানসপটে সঞ্চিত চিন্তা, একেই আমরা ৰলি স্মৃতি৷
যখন তুমি মহাম্মন্যতা দ্বারা গ্রস্থ হয়ে রয়েছ, তখন তুমি মনে কর যে তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ আর অন্যে সবচেয়ে খারাপ এর ফলে তুমি বাহ্যিক তরঙ্গকে ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পার না৷ সুতরাং তোমার চিন্তা দূষিত হয়ে যায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ এর ফলে স্মৃতিও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে৷
তাই তোমার মনে অবশ্যই কোন মহাম্মন্যতার ভাবনা থাকা উচিত নয়৷ তোমার মনে রাখা উচিত যে তুমি অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ নও৷ সকলে একই পরমপিতার সন্তান, সকলে পরম সৃষ্টিকর্তার সন্তান৷ কেউ কারোর থেকে শ্রেষ্ঠ নয়৷
মনের দ্বিতীয় মলিনতা হচ্ছে এই রকম কখনও কখনও তুমি এরকমও মনে ভাবতে পার, ‘‘আমি অতি সাধারণ, আর উনি তো অনেক ৰড়, অনেক জ্ঞানী, কত ৰড় পণ্ডিত, কত ধনী, আর আমি কত গরীব’’৷ যদি তুমি এরকম ভাব তাহলে কী হৰে? তোমার মনের উপযুক্ত অভিব্যক্তি হৰে না, তোমার চিন্তাতরঙ্গ ঠিকমত উৎসাহিত হৰে না৷ এরপরে তোমার চিন্তা চঞ্চল হয়ে পড়ৰে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ৰে, অর্থাৎ স্মৃতির অংশ ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যাৰে৷
ঠিক তেমনই ভীতম্মন্যতা৷ কখনও কখনও মানুষ ভীতম্মন্যতা দ্বারা গ্রস্থ হয়৷ ভীতম্মন্যতার মনস্তাত্বিক দিকটি হচ্ছে এইরকম অধিক শক্তিশালী কোন অস্তিত্বের কারণে যা নিজের মনের কল্পনা প্রসূত কোন শক্তিশালী অস্তিত্বের জন্যে, যা বাস্তব নয়, কী হয়? মনের প্রবাহ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে৷ তারা অভিব্যক্তির উপযুক্ত পথ পায় না যার ফলে চিন্তা দূষিত হয়ে পড়ে৷ সেই অবস্থায় স্বাধীনভাবে চিন্তা করা সম্ভবপর হয় না৷ তাই যে ভীতম্মন্যতা গ্রস্ত সে ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না৷ আর চিন্তা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, স্মৃতিও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যাৰে৷ তাই অবশ্যই তুমি কোন সময় কোন প্রকার ভীতম্মন্যতা দ্বারা গ্রস্ত হৰে না৷
কেন তুমি কোন ভীতম্মন্যতা বা হীনম্মন্যতায় ভুগবে যখন স্বয়ং পরমপিতা তোমার পিতা, যখন তোমরা সকলে একই পিতার সন্তান, যখন পরমপিতা তোমার সঙ্গে আছেন? তুমি দূর্বল নও, বরং তুমি অতি শক্তিশালী, কেননা সর্বশক্তিমান পিতা তোমার সাহায্যের জন্যে তোমার সঙ্গে আছেন৷ সুতরাং তুমি কোন অবস্থাতেই দূর্বলতাকে, তোমার ভীতম্মন্যতা বা মহাম্মন্যতাকে প্রশ্রয় দেৰে না৷ তোমরা কখনই একা নও৷
কখনও কখনও মনে পরাজিত সুলভ মনোভাব আসে৷ ‘‘আমি তো এই জগতে জীবনযুদ্ধে হেরে গেছি৷’’ এই ধরণের ভাবনা বা মানসিকতা মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়৷ তুমি অবশ্যই এই মনোভাবকে সমর্থন করৰে না৷ যখন তোমার পিতা পরমপিতা, তিনি সমগ্র মহাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী সত্তা, তাহলে তুমি কেন ভাববে যে জীবন যুদ্ধে তুমি হেরে গেছ! না, এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে৷ তোমার ভবিষ্যৎ গৌরব পূর্ণ, তোমার ভবিষ্যৎ অতি উজ্জ্বল, আলোকদ্ভাসে পরিপূর্ণ৷
সুতরাং তুমি অসহায়তা বা আশাহীনতা বা বিষণ্ণতাকে কখনই প্রশ্রয় দেৰে না৷ এই ধরণের পরাজিত সুলভ মনোভাব পাপী মনোভাবে পরিণত হতে পারে৷ একজন মানুষ সর্বদা ভাবতে পারে, ‘‘আমি পাপী, আমি পাপী’’৷ যদি সে সর্বদা এইরকম চিন্তা করে, তাহলে একদিন সে সত্যি সত্যি পাপীই হয়ে যাৰে৷ বাস্তবে সে পাপী নয়, কিন্তু যদি সে ওই রকম ভাবতে থাকে, তাহলে কী হৰে? একদিন সে পাপীতেই পরিণত হৰে৷ তাই এই ধরণের মনস্তত্ব মূলতঃ ত্রুটিপূর্ণ৷ তুমি কোন দিনই ভাববে না যে তুমি পাপী৷ তুমি ভাববে, ‘‘অতীতে হয়তো আমি একদিন পাপী ছিলুম, কিন্তু এই মূহূর্তে আমি পরম শক্তিশালী পিতার কোলে বসে আছি৷ আমি পাপী নই, পাপী হতে পারি না’’৷ ভগবান কৃষ্ণ বলেছেন,
‘‘অপিচেৎ সুদূরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্৷
সোপি পাপাবিনির্মুক্ত মুচ্যতে ভবৰন্ধনাৎ৷৷’’
এমনকি এমন ধরণের পাপীও যদি থাকে, যাকে অন্য পাপীরাও ভাবে সে খারাপ লোক, সেই ধরণের পাপী অর্থাৎ সবচেছে অধম পাপীরও ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়৷ এইক্ষেত্রে তারাও ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল, যদি সে পরমপিতার কোলে আশ্রয় নেয়৷ ধর, তুমি রাস্ত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ তোমার কাপড়-চোপড় ধুলোয় বা কাদায় মলিন হয়ে গেছে৷ সেই অবস্থাতে কী তুমি ভাববে যে চিরকালের জন্যে তুমি নোংরা বা এমনই বিশ্রী থাকৰে? যদি তুমি তোমার পিতার কাছে নোংরা পোষাক নিয়ে উপস্থিত হও, তোমার পিতা কী করৰেন? তিনি তোমার পোষাকে ধূলো পরিস্কার করে নিয়ে তোমাকে কোলে তুলে নেবেন৷ ‘‘হে আমার সন্তান, তোমার পোষাকে কাদা লেগে গেছে, কিন্তু তুমি তো আমারই সন্তান৷ এখানে এসো, এখানে এসো, আমার কোলে বসো৷ আমি তো তোমার পিতা, তুমি আমার সন্তান৷’’ তুমি কখনই পাপী সুলভ মনোভাবকে(sinners’ psychology) প্রশ্রয় দেৰে না৷
তাই অতীতে তুমি পাপকর্মে লিপ্ত থাকলেও, ভুলে যাও যে তুমি পাপী৷ ভাব এই মুহূর্ত থেকে তুমি ধোপদুরস্ত, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, তুমি বিশ্বপিতার সন্তান৷ তাই সাধকের ক্ষেত্রে কোন ধরণেরই ত্রুটিপূর্ণ মনোভাব বা মনের মলিনতা থাকা উচিত নয়৷ সমস্ত দিক থেকে ভারমুক্ত হও, আর সমতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে, মানসিক ভারসাম্য নিয়ে সৎপথে এগিয়ে চলো৷ তোমার জন্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে৷
২৬ সেপ্ঢেম্বর ১৯৭৯, প্রাতঃকালীন দর্শন, কারাকাস (ভেনেজুয়েলা)