শোষিত বাঙলা---বঞ্চিত বাংলা ও বাঙালী (২)

লেখক
তারাপদ বিশ্বাস

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

১৬) কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তর সমূহে, ত্রি-ভাষা সূত্র মেনে প্রতিটি সরকারী কাজে হিন্দি ও ইংরাজীর পাশাপাশি প্রাদেশিক ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়াটাই আইনসিদ্ধ৷ ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ত্রি-ভাষা সূত্র পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, সৈনিক সূকল  এ্যটোমিক এনার্জী স্কুল, রেল ও অন্যান্য দপ্তর পরিচালিত বিদ্যালয়ে মানা হয় না৷

এসমস্ত বিদ্যালয়ে ভর্ত্তির সময়ে, অভিভাবকদের প্রাদেশিক ভাষা অর্র্থৎ  বাংলা ভাষা পড়ার অপসান ফর্ম দেওয়াই হয় না আর অভিভাবকরাও চান না ফলে বাংলার জন্য শিক্ষক নিয়োগই হয় না৷ ছাত্রছাত্রাদেরও জানানো হয় না৷ এমনই একটা ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে যে, এসব বিদ্যালয়ে বাংলা পড়া যায় না৷

(১৭) ‘‘ন্যাশানাল ইনসটিটিউট অফ ওপেন  স্কুলিং(NIOS)’’মুক্ত বা দূরশিক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা  প্রদান করে৷ ইংরেজী , হিন্দি, মারাঠী, তেলগু, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষায়  পাঠ্য পুস্তক  ও  পরীক্ষার প্রশ্ণপত্র ছাপা হয়,  পরীক্ষার উত্তর দেওয়া যায়৷  বাংলা ভাষা উপেক্ষিত৷

(১৮) কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের কোন কেন্দ্রীয় সরকারী কার্র্যলয়, ওয়ার্ক শপ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিতে আন্তর্র্জতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় না৷ ২১শে ফেব্রুয়ারী পালিত হয় না৷৷

(১৯) সারা ভারতবর্ষে ডাক্তারী পড়ার জন্য অভিন্ন জয়েন্ট পরীক্ষা (নীটNEET), মাতৃভাষাকে কোমাচ্ছন্ন করার আর একটি কেন্দ্রীয় চক্রান্ত৷ ০৯-০৫-১৬-তে সুপ্রীম কোর্ট ডাক্তারি-শিক্ষায় রাজ্যস্তরের জয়েন্ট বন্ধ করে সারাদেশে অভিন্ন জয়েন্টের নির্দেশ দিয়েছে৷ জয়েন্টের ভাষা হবে ইংরাজী-হিন্দি ৷ বাংলা মাধ্যমে পড়ার ছেলে-মেয়েদের কাছে সিলেবাসও হবে আলাদা, ভাষা-মাধ্যমও হবে আলাদা৷

(২০) ভাষার উন্নয়ন, প্রসার ও গবেষণার ক্ষেত্রে, বাংলা ভাষার জন্য ভারত সরকারের কয়েক বছরের ব্যয়ের নমুনা নিম্নরূপ (কেন্দ্রীয় সরকারেরই তথ্য অনুসারে)৷

ভাষা

জনসংখ্যার
অনুপাত

বরাদ্ধ কােটিতে
২০০৯-১০
 বরাদ্ধ কােটিতে
২০১১-১২
বরাদ্ধ কােটিতে
২১১২-১৩
হিন্দি         ৪১.০৩ ৬৩.৭৫ ৪৫.৪ ৫৯.১১
বাংলা ৮.১১
মারাঠি ৬.৯৯ 
তামিল  ৫.৫১ ১৫.00 ১৬.00 ১৬.00
উর্দু   ৫.০১ ১৭.১০ ১১.১৫ ২৫.২০
গুজরাটি ৪.৪৮  
ওড়িয়া ৪.১ 
কন্নড়  ৪.১  
মালয়ালাম
পাঞ্জাবি ৩.১
সিন্ধি ০.০৩ ১.৫০ ২.৫০

 

হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের সর্র্বত্মক আক্রমণের লক্ষ্য আজ বাংলা ও  বাঙালী৷ ভারতবর্ষে বাংলা ভাষার রাজধানী পশ্চিমবঙ্গ  সে কারণে রাজধানীকে উত্তর ও পশ্চিম দিকে ভাঙার কৌশলী চেষ্টা চলছে৷ খোদ কলিকাতা বাঙালীর হাতছাড়া  কলিকাতার ৭১ শতাংশের বেশী মাটি (জমি) হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা ইতোমধ্যে কিনে ফেলেছে ৷  অসমের বাঙালী জেলাগুলিকে বারবার ভেঙে টুকরো টুকরো করছে৷ ঐতিহাসিক পরিচয় বহনকারী নাম পরিবত্র্ হচ্ছে৷  বাঙালী জাগরণ ঠেকানোর  অগ্রিম ব্যবস্থা হিসাবে, বাঙালিদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট-রূপী খোয়াড়ে ঢুকিয়ে রাখা, সর্বত্র আক্রমণ ভারতবর্ষের যেখানে যেখানে বাঙালীদের রাখা হয়েছে, সেখানেই বাঙালী আক্রান্ত..... হ্যা, আক্রান্ত

(ক) বাঙালীর জাতিসত্তা আক্রান্ত (খ) বাঙালীর মাতৃভাষা -সংসৃকতি-সভ্যতা আক্রান্ত৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীকে বিদেশী চিহ্ণিত করার উদ্দেশ্যে যখন পার্র্লমেন্টে কংগ্রেস বিল পাস করে, তখন বি.জে.পি ও তার সহোযোগীরা নীরবে সমর্থন করে আবার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়ে বিজেপি যখন বাঙালী বিরোধী নাগরিকত্ব বিল পাশ করে তখন কংগ্রেস ও পর্রামেণ্টে তাদের সহযোগীরা নীরব সমর্থন জানায়৷ পার্র্লমেন্টে বিভিন্ন দলের বাঙালী এম পি রা তো নির্লজ্জ ভূমিকা গ্রহণ করে যার যার দলীয় হুইপ মেনে মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে  বোবা সেজে থাকে৷ ১৯৮৬ ও ২০০৩ সালে সি.পি.এম দল ও আজকের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও বাঙালী স্বার্থ-বিরোধী নাগরিকত্ব (সং) বিল সমর্থন করেছেন৷ তাহ’লে বাঙালী অধ্যুষিত পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে হিন্দি সমাম্রাজ্যবাদীদের রক্ষক কারা?  বি.জে.পি, কংগ্রেস, সি.পি.এম, টি.এম.সি., জে.জে এম.এম, কে.পি.পি, আসু, অ.গ.প, ইত্যাদি  রাজনৈতিক দল৷ বাঙলার বরেন্দ্র ডবাক অঞ্চলের রাজবংশী,কোচ,মেচ,বোড়ো, চাকমা, কাছাড়ীরা আদি বাঙালী৷ কামতাপুরী কোন স্বতন্ত্র ভাষা নয় বাংলা ভাষার রংপুরী উপভাষার অন্তর্গত বুলিই কামতাপুরী --- যাকে পশ্চিমবঙ্গে সরকার স্বতন্ত্র ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ভোটমুখী এই হঠকারী সিদ্ধান্তে  ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলা ও বাঙালী৷ বাঙালী জাতিসত্তা ও বাংলা ভাষা-সংসৃকতি, বিভিন্নভাবে, বিভিন্নরূপে ও বিভিন্ন দিক থেকে আক্রান্ত হচ্ছে ও ভবিষ্যতে তার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে৷

ভারতবর্ষের  বিভিন্ন রাজ্যে বহুধা বিভক্ত বাঙালীর নাগরিকত্ব প্রাপ্তি বা মাতৃভাষা রক্ষাকেন্দ্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা-বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া ও তাদের অর্র্থশ্রিত রাজনৈতিক দলগুলি বাংলা ও বাঙালী ধবংসে একতাবদ্ধ তাদের লক্ষ্য ও কর্মপন্থা অভিন্ন৷ কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যের বঞ্চিত বাঙালীদের একাধিক সামাজিক সংঘটন--- নির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন, পরিকল্পনাহীন৷ তা’ছাড়া শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, সুুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ্য ও প্রশিক্ষিত নীতিবাদী কর্মীদল না থাকলে জয়লাভ করা সম্ভব হতে পারে না৷ সে দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও সন্নিহিত বাঙালী-অধ্যুষিত এলাকায় ‘বাংলা ও বাঙালী’র সার্বিক স্বার্থে সংগ্রামরত৷ একমাত্র  সামাজিক -অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংঘটন ‘‘আমরা-বাঙালীএর পতাকাতলে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক লড়াই বাঙালীরা লড়তে পারেনকারণ---

আমরা বাঙালী-র লক্ষ্য ঃ ভারতবর্ষের অন্তর্গত নিম্নে উল্লিখিত অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে বাঙালীস্তান ঘটন৷

(১) সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ (২) সমগ্র ত্রিপুরা

(৩) ঝাড়খন্ড রাজ্যের ---

(ক) সমগ্র পূর্ব সিংভূম জেলা (খ) সমগ্র পশ্চিম সিংভূম জেলা

(গ) সমগ্র সরাইকেলা- (ঘ) সমগ্র ধানবাদ জেলা খরসোঁয়া জেলা৷

(চ) রাঁচি জেলার সিল্লি ব্লক / সোনা হাতু ব্লক /তামার-১ব্লক/ আঙ্গারা ব্লকের ১৩ টি পঞ্চায়েত৷৷

(ছ) খুন্তি জেলার আরকি ব্লক৷

(জ) হাজারিবাগ জেলার গোলা ব্লক / পেটারওয়ার্ড ব্লক/কাসমার ব্লক/জেরিডি/ দামোদরের দক্ষিণাংশ৷

(ঝ) সাঁওতাল পরগণার--- জামতারা জেলা/ দুমকা জেলা/ গোড্ডা জেলা/ দেওঘর জেলা/পাকুর / রাজমহল (সাহেবগঞ্জ টাউন বাদে)৷

(৪) বিহার রাজ্যের --- (ক) কিষেণগঞ্জ জেলার  আড়ারিয়া মহকুমার পলাশী ব্লক (খ) কাটিহার জেলার বারসই ব্লক / বলরামপুর ব্লক/ পরাণপুর ব্লকের হোনা পঞ্চায়েত / আজমনগর  ব্লকের মুর্কুরিয়া পঞ্চায়েত/ আমেদপুর ও দুধনিয়া রেল স্টেশান (গ) বঙ্ক জেলার অমরপুর ব্লক/ পূর্ণিয়া জেলার বৈসি  ব্লক৷

(৫) সমগ্র আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ

(৬) উড়িষ্যা রাজ্যের--- (ক) সুন্দরগড় জেলার (পূর্ব সুন্দরগড়) লোহানি পাড়া/ কয়রা/ বাঁকি ও রোনাই মহকুমার গুড়নরিয়া ব্লকের চন্ডীপোশ পঞ্চায়েত, রাউরকেল্লা শহর ও পানপোশ মহকুমার  বিরসা ব্লকের লাঠিকাটা ও জলদা পঞ্চায়েত৷

(খ) কেওনঝড় জেলার (উত্তর কেওনঝড়) চামপুয়া মহকুমার চামপুয়া/ জোড়া/ ঝুমপুরা ব্লক ও বালেশ্বর মহকুমা কঁকিসা ভোগরাই/ চন্দনেশ্বর ও জলেশ্বর ব্লকের অর্র্ধংশ৷

(গ) ময়ূরভঞ্জ জেলার (উত্তর পূর্ব ময়ূরভঞ্জ) বামুনঘাটার মহকুমার রাইরং পুর/বিজাতলা/ জামাদা/ বহালদা/ তিড়িং/ বিসই ও কুসুমি ব্লক৷ বারিপদা মহকুমার রাজগোবিন্দপুর / বেতনটি ও সুলিপদা ব্লক৷ পাঁচপীর মহকুমার ঠাকুর মুন্ডা/ সুকরুলি/ করঞ্জিয়া/ যোশিপুর ও ররুয়া ব্লক

(ঘ) বালেশ্বর জেলার ভোগরাই ব্লক/ জলেশ্বর ব্লকের অর্ধাংশ / কাঁকসা/ চন্দনেশ্বর

(৭)মেঘালয় রাজ্যের গারো, খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমতল অংশ৷

(৮) অসম রাজ্যের ---

(ক) সমগ্র বড়পেটা জেলা

(খ) সমগ্র বাকসা জেলা

(গ) সমগ্র কাঁছাড় জেলা 

(ঘ) সমগ্র উত্তর কাঁছাড় জেলা

(ঙ) সমগ্র করিমগঞ্জ জেলা

(চ) সমগ্র হাইলাকান্দি জেলা

(ছ) হোজাই/ লঙ্কা /লামডিং

(জ) মিকির পাহোড়ের সমতল অংশ

(ঝ) সমগ্র গোয়ালপাড়া জেলা

(ঞ)সমগ্র ধুবুড়ি জেলা

(ট) সমগ্র কোকড়াঝাড় জেলা

(ঠ) সমগ্র বঙ্গাইগাও জেলা

(ড) সমগ্র চিরাং জেলা

(ঢ) সমগ্র দক্ষিণ সালমারা-মানকাচর  জেলা৷

আমরা বাঙালী গ্রহণ করেছে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের যুগান্তকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন প্রাউট (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব--- PROUT (Progressive Utilisation Theory) প্রাউটের বিকেন্দ্রিত, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (ব্লক ভিত্তিক বাস্তবায়নের কর্মসূচী) প্রতিটি মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্যারান্টী দিতে সক্ষম৷

(গ) আমরা বাঙালী-র রয়েছে,দৈনন্দিন জীবনে নীতিশক্তি ও সংযম সাধনা অনুশীলনরত নেতৃত্ব, কর্মীদল ও সংঘটন৷

আমার বিশ্বাস বিশ্বের প্রতিটি বাঙালী মাতৃভাষা বাঙলার অস্তিত্ব ও সম্মান পুন:রুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ হবেন৷ বাংলা-বাঙালীর আজকের  ঘোর দুর্দিনে মনে পড়ে মহান দার্শনিক, সর্বজ্ঞানের অধিকারী শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারকে, যিনি বিশ্বপ্রেমিক হয়েও একজন বাঙালী প্রেমিক যিনি বলেছেন---‘‘.......আমি আশা করি--- শুধু আশাই করি না--- দৃঢ়তার  সঙ্গে বিশ্বাস করি , এই অবরোহের পরে অত্যন্ত নিকট ভবিষ্যতে সেই উহ আসছে ৷ একেবারে চারিদিকে সবাই মনিদ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়ে এগিয়ে চলবে, গোটা পৃথিবীকে সাহায্য করবে এই বাঙলার মানুষ৷’