শ্রাবণী পূর্ণিমা– স্থান– কাল–পাত্র নির্বাচনের তাৎপর্য

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সব কাজেরই শুরুর আগে একটা শুরু আছে৷ যাকে বলে আয়োজন৷ কবির কথায় সন্ধ্যাবেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালার আগে সকাল বেলায় শলতে পাকিয়ে রাখতে হয়৷ প্রদীপ জ্বালার আয়োজন তখন থেকেই৷ ১৯৫৫ সালের ৯ই জানুয়ারী বিহারের ছোট্ট শহর জামালপুরে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আনন্দমার্গ নামের যে দীপশিখাটি জ্বালিয়েছিলেন তারও আয়োজন শুরু হয়েছিল আরও ১৬ বছর আগে ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমাতে৷ বস্তুতঃ আনন্দমার্গের যাত্রা শুরু ওই দিন থেকেই৷ সেইসঙ্গে বিশ্বমানবেরও নবযুগের পথে যাত্রার সূচনা হয়৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তখনও স্বমহিমায় প্রকাশিত হন নি৷ তখন তিনি ১৮ বছরের তরুণ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র৷ দিনটি ছিল ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমা৷ প্রাত্যহিক অভ্যাস মত সেদিনও অপরাহ্ণে তরুণ প্রভাতরঞ্জন গঙ্গার তীরে কাশীমিত্র ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ ওই সময় ওই অঞ্চলে ছিল দুর্ধর্ষ এক ডাকাত কালীচরণ–কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সূর্য তখন অস্ত গেছে৷ পূর্ণিমার আকাশে পূর্ণচন্দ্র মেঘের ফাঁকে ফাঁকে খেলে বেড়াচ্ছে৷ তরুণ প্রভাতরঞ্জন বসেছিলেন এক বটবৃক্ষের গোড়ায়৷ এদিকে নিঃশব্দে ডাকাত কালীচরণ এসে দাঁড়ায় তাঁর পশ্চাতে৷ উদ্দেশ্য তরুণের সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া৷ কিন্তু ডাকাত কালীচরণ তখনও বোঝেনি কার পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কোন্ আলোর দেবতা তারই জন্য এখানে এসে অপেক্ষা করছেন৷ পরবর্তীকালে যে সামাজিক সংঘটন ও সুমহান আদর্শ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার যাত্রা শুরুর জন্যে স্থান, কাল, পাত্র নির্বাচন তিনি বহু আগেই করে রেখেছিলেন৷ তাই কালীচরণ না বুঝলেও প্রভাতরঞ্জনের কোন কিছুই অজানা নয়৷ তাই তিনি পিছনে না তাকিয়েই ডাক দিলেন–কালীচরণ, এদিকে এসো৷ নিবিড় স্নেহময় সে ডাকে সম্মোহিত হয়ে গেল কালীচরণ৷ লুটিয়ে পড়ল সেই তরুণ ছাত্রের চরণে৷ রূপান্তর ঘটে গেল কালীচরণের জীবনে৷ তার দস্যু হৃদয়ের সব মলিনতা যেন এক স্নিগ্ধ অগ্ণির স্পর্শে ভস্মীভূত হয়ে গেল৷ দিব্যজীবনের পথে যাত্রা শুরু হ’ল দস্যু কালীচরণের৷

এ জগতের সব কিছুই স্থান, কাল, পাত্রের ওপর আধারিত৷ পরমারাধ্য বাবা (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী)–র মহান কর্মযজ্ঞের শুভ সূচনায় স্থান, কাল, পাত্র নির্বাচন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল৷

১৯৩৯ সাল৷ ইয়ূরোপের আকাশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে গেছে৷ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তখন চরম জটিলতা৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চোখে ধূলো দিয়ে পলাতক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু৷ বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে, সামাজিক জীবনে চরম দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে৷ এমন সময় গঙ্গার তীরে এক দস্যুর জীবনে রূপান্তর ঘটিয়ে বিশ্ববাসীকে শোনালেন অভয়বাণী৷ পূর্ণচন্দ্রের স্নিগ্ধ আলোকে ভাগীরথীর তীর থেকে ধাবিত হ’ল সেই বার্তা–‘মাভৈঃ’ তিনি এসেছেন৷ এই দুর্যোগপূর্ণ দিনে বিশ্ববাসীর ওপর ঝরে পড়লো তাঁর স্নেহাশীর্বাদ৷

নদীবাহিত সভ্যতার শুরু নদীর পার্বত্য স্তরে৷ সেই সভ্যতা বিকাশ লাভ করতে করতে সমভূমি অতিক্রম করে চরম বিকাশ লাভ করে নদীর ব–দ্বীপিয় স্তরে৷ ভারতীয় সভ্যতার মূল ধারা গাঙ্গেয় সভ্যতার পার্বত্য স্তরে আমরা পেয়েছি মহাসম্ভূতি পরমপুরুষ সদাশিবকে, দ্বিতীয় স্তরে সে সভ্যতা বিকাশ লাভ করতে করতে গাঙ্গেয় সভ্যতা সমভূমির স্তরে এসে পৌাঁছায়, সেখানে আমরা পেলাম আর এক মহাসম্ভূতি শ্রীকৃষ্ণকে৷ গাঙ্গেয় সভ্যতা চরম বিকাশ লাভ করে বদ্বীপিয় স্তরে এসে বিশ্বের বৃহত্তম এই ব–দ্বীপ–সুন্দরবন, কলিকাতা ও এই সুন্দরবন বদ্বীপিয় স্তরে অবস্থিত৷ তাই পরমারাধ্য বাবা তাঁর মহান কর্মযজ্ঞের সূচনার স্থান হিসেবে বেছে নিলেন ভাগীরথীর তীরে কলকাতার কাশীমিত্র ঘাটকে৷ বিশ্বের বৃহত্তম ব–দ্বীপ অঞ্চল সুন্দরবন৷ কলকাতা এই ব–দ্বীপ স্তরে অবস্থিত৷ তাছাড়া বাঙলার সভ্যতা বিশ্বের বৃহত্তম তিনটি ব–দ্বীপিয় সভ্যতার মিশ্রণ৷ ব্রহ্মপুত্র বয়ে এনেছে ইন্দো–তিব্বতীয় সভ্যতা৷ গাঙ্গেয় সভ্যতার ব–দ্বীপিয় স্তর ও রাঢ় সভ্যতার ব–দ্বীপিয় স্তর––এই তিনের বিমিশ্ররূপ বাঙলার সভ্যতা৷ তাই সভ্যতার চরম বিকাশ লাভ এখানেই সম্ভব৷ তাই স্বাভাবিক ভাবেই পরমারাধ্য বাবা তাঁর সুমহান কর্মযজ্ঞের সূচনা করলেন ভাগীরথীর তীরে বসে৷

এরপর প্রশ্ণ তিনি পাত্র হিসাবে কেন এক দস্যুকে বেছে নিলেন৷ আসলে কালীচরণ এখানে এক প্রতীক মাত্র৷ প্রতিটি মানুষের অন্তরেই লুকিয়ে আছে এক–একজন কালীচরণ৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–বহুভাগ্য সেই, জন্মিয়াছি এমন বিশ্বে৷ নির্দোষ সে নয় মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব কে না জানে চিরকাল আছে৷ সৃষ্টির বক্ষ মাঝে৷ মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব চিরকাল চলেছে এ বিশ্ব চরাচরে৷ মানুষের অন্তরের প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে শুভ–শুভের সংঘাত৷ এই সংঘাতে যেখানে শুভ শক্তির জয় হয় সেখানে৷ মানুষ দেবত্বে উত্তীর্ণ হয়, যেখানে অশুভ শক্তির জয় হয় মানুষ সেখানে পশুর চেয়ে হীন হয়ে যায়৷

দস্যু কালীচরণের অন্ধকারের যাত্রী হলেও তাঁর অন্তরে ছিল আলোককে পাবার তৃষ্ণা৷ তাই আনন্দের দূত হয়ে তার সামনে উপস্থিত হলেন পরমারাধ্য বাবা৷ তাঁর দিব্য স্পর্শে কালীচরণের  জীবনের অবসান হ’ল অন্ধকার জীবনের৷ শুরু হ’ল নোতুন যুগের নোতুন পথে চলা৷ কিন্তু শুধু কালীচরণ তো নয়৷ অন্ধকারময় রুদ্ধ বাতাবরণে বন্দী প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন জ্যোতির্ময় বাণী–ওঠো, জাগো৷ এক দস্যুর অন্তরে মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে তিনি জগৎকে বিশ্বমানবের দৃষ্টির সম্মুখে খুলে দিলেন দিব্যজীবনের দ্বার৷ বিশ্বমানবের যাত্রা শুরু হ’ল সত্যের পথে, আলোকের পথে, অমৃতের পথে৷