সর্বাত্মক কল্যাণের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রাউটের আবির্ভাব

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার তাঁর নোতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্বের নামকরণ করেছেন ‘Progressive Utilization Theory’’ ( এরই সংক্ষিপ্ত রূপ PROUT) প্রাউট৷ এর  বাংলা হল প্রগতিশীল  উপযোগ তত্ত্ব৷ প্রশ্ণ জাগতে পারে প্রাক্তন প্রবক্তা তাঁর  তত্ত্বের  নাম এরূপ রাখলেন কেন?

তত্ত্বটির  নাম প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ প্রথম সমাজে প্রগতিশীল শব্দের মধ্যে প্রবক্তা বলতে চান , এই তত্ত্বের সহায়তায় মানুষ ব্যষ্টিগতভাবে  ও সমষ্টিগত ভাবে প্রগতির পথ ধরে এগিয়ে চলতে পারবে৷ প্রত্যেকের প্রগতি হবে ৷ প্রগতি মানে কী? যে গতি শুভের দিকে৷ যার ফলে মানুষের  সর্বাত্মক কল্যান সাধিত হয়৷  আজকাল সাধারণত  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির  উন্নতিকেই  সমাজের প্রগতির নির্দেশ বলে অনেকে মনে করেন৷ তা কিন্তু নয় বিজ্ঞান এগিয়েছে৷  বিশাল বিশাল বহুতল অট্টালিকা তৈরী হচ্ছে, বিজ্ঞান মানুষকে নানান বিচিত্র ভোগপকরণ উপহার  দিয়েছে৷  বিজ্ঞানের এই অত্যাশ্চর্য উন্নতিকে আমরা প্রগতি বলতে পারি না৷ কারণ বিজ্ঞানের এই অবদানের মাধ্যমে মানুষের যেমন নানান সুবিধা হয়েছে, অন্যদিকে মানুষ হারিয়ে ফেলছে মনের শান্তি, বেড়ে চলেছে মানসিক উদ্বেগ আর ও মানসিক অবসাদ (মেন্টাল ষ্ট্রেস) জনিত নানান দূরারোগ্য রোগের শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে৷

উদাহরণ স্বরূপ , একসময় মানুষ পায়ে হেঁটে দূর দূর পথ অতিক্রম করত৷ বা গোরুর গাড়িতে  করে যেত ৷ তারপর একদিন মানুষ মোটরগাড়ী, ট্রেনে করে যাতায়াত শুরু করল৷ এর ফলে মানুষ খুব কম সময়ের মধ্যে অনেকদূর যেতে পারল৷  মানুষের কষ্ট অনেকটা লাঘব হল৷ কিন্তু অন্যদিকে যাবার দুর্ঘটনার  সম্ভাবনা বেড়ে গেল৷ ট্রেনে বাসে  দুর্ঘটনা হলে মানুষ দারুন ভাবে জখম তো হতেই পারে , মৃত্যুও  হতে পারে৷ কিন্তু যখন পায়ে হেঁটে গোরুর গাড়ীতে করে যেত তখন এতটা দুর্ঘনার সম্ভাবনা ছিল না৷  অর্থাৎ একদিকে যেমন মানুষ কষ্ট লাঘব জনিত আরাম পাচ্ছে,  অন্যদিকে দুর্ঘটনা জনিত উদ্বেগ ও আসংখ্যাও  বাড়ছে৷ তাই এক্ষেত্রে মানুষের সুখ বা তৃপ্তি গড়ে যে খুব একটা বাড়ছে তা বলছে পারছি না৷ বলা চলে এর পজিটিভ (ধনাত্মক) ও নেগেটিভ (ঋনাত্মক) ফল মিলে রেজাল্টা শূন্যই থাকছে৷

মানুষের জীবনের পূর্ণত্ব প্রাপ্তি, ব্রহ্ম সমপ্রাপ্তি৷ তখন মানুষ সমস্ত সুখ তথা আনন্দ--- পরমানন্দ লাভ  করে৷ এই আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উন্নতির কোনো নেগেটিভ (ঋনাত্মক) দিক নেই৷ তাহলেও ভৌতিক ক্ষেত্রের (ফিজিকাল স্ফিয়ার ) উন্নতিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না৷  কারণ দেশ-কাল-পাত্রের পরিবর্ত্তনের  সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভূত  সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে  বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রয়োজন৷ কিন্তু কেবল বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আমরা প্রগতি বলতে পারি না৷ তাই ভৌতিক, মানসিক তথা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক --- এই তিন ক্ষেত্রেরই সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতিতেই মানুষের যথার্থ প্রগতি৷

মানুষ চায় দুঃখ থেকে ত্রাণ, মানুষ চায় সুখ৷ মানুষের রয়েছে অভাব, এই অভাব মিটলেই মানুষ পায় সুখ, না মিটলে মানুষ পায় দুঃখ৷ এই অভাব মেটানোর জন্যে ঈশ্বর বা প্রকৃতি মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন অজস্র সম্পদ--- প্রাকৃতিক সম্পদ, মানসিক সম্পদ ও আধ্যাত্মিক সম্পদ৷ মানুষ যদি এই সম্পদের যথাযথ উপযোগ গ্রহন করতে পারে তাহলেই মানুষের সমস্ত দুঃখ দূর হবে--- সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে৷ তাই এটাই আসল সমস্যা--- কীভাবে আমরা এই সমাজে সমূহের  যথাযথ উপযোগ গ্রহন করে ব্যষ্টিগত জীবনের ও সমষ্টিগত জীবনের মঙ্গল সাধন করতে পারি৷

যেমন, প্রকৃতিতে মৃত্তিকা, জল, বায়ু--- এ সবই সম্পদ৷ ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন--- এটাও একটা সম্পদ- মানসিক সম্পদ৷ এই সম্পদগুলির যথাযথ সদ্যব্যবহার করে মানুষ মাটির বুকে ফসল ফলায়, খাদ্য উৎপাদন করে৷ সেই খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করে৷ মানুষ সুখী হয়৷

কিন্তু  কূটবুদ্ধি-সম্পদকিছু মানুষ যখন এই খাদ্য প্রয়োজনাতিরিক্ত ভাবে নিজের জিম্বায়ে আটকে রেখে অন্যের অভাবের কারণ হয়,তখন বহু মানুষকে অভাবের জন্য কষ্ট পেতে হয় ৷

বিশ্বের সম্পদ সবাইকার জন্যে৷ কারণ এই সমস্ত সম্পদের শ্রষ্টা ঈশ্বরের সন্তান সবাই৷ পিতার সম্পদের উপর সমস্ত সন্তানেরই অধিকার থাকে৷ ঈশ্বর বা প্রকৃতি তো কারোর নামে কোনকিছু রেজিস্ট্রি করে দেননি৷

প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা তাঁর আজকের সমস্যা, গ্রন্থে বলেছেন,

ননজীবজগৎ একটি বৃহৎ যৌথ পরিবার–একথা ক্ষণেকের জন্যেও ভুললে চলবে না৷ প্রকৃতি বিশ্বের কোনো সম্পত্তিই ব্যষ্টিবিশেষের নামে লেখাপড়া করে দেননি৷ ব্যষ্টিগত মালিকানার সৃষ্টি করেছে স্বাথাপর সুবিধাবাদী মানুষেরা, কারণ এই ব্যবস্থার রন্ধ্রপথে তারা অন্যকে শোষণ করে’ নিজেদের স্ফীতোদর করবার সুযোগ পায়৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জীবমাত্রেরই যখন পৈত্রিক সম্পত্তি তখন কারও ঘরে প্রাচুর্যের স্রোত বয়ে যাক আর কেউ অনাহারে তিলে তিলে শুকিয়ে মরুক এই ব্যবস্থাটাকে ন্যায় ধর্মসম্মত বলা যেতে পারে কি? যৌথ পরিবারের নিজের ক্ষুধা বা প্রয়োজন মত অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–চি বা আরামের ব্যবস্থা সমগ্র পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী প্রত্যেকেই পায়৷ কিন্তু এই পরিবারের কোনো সদস্য যদি নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্ন–বস্ত্র, পুস্তক বা ঔষধ নিজের জিম্মায় আটকে রাখে তখন সে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্লোশের কারণ হয় না কি? সেক্ষেত্রে তার আচরণ নিশ্চয়ই ধর্মবিরোধী, নিশ্চয়ই সমাজ বিরোধী৷পপতাহলে মূল সমস্যাটা কোথায় ? এই বিশ্বের সম্পদ সমূহের কেমনভাবে ন্যায়সঙ্গতভাবে ‘উপযোগ’ গ্রহণ করা উচিত--- সেই নীতিটাকেই মানা হচ্ছে না৷ এজন্যই সমস্যা৷

এই আজকের সমস্যা  গ্রন্থেরই প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার বলেছেন,

            ‘‘মানুষের ক্ষুধা  অনন্ত৷ এই অনন্ত ক্ষুধাকে সে যদি জাগতিক ভোগ্য বস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয় তাহলে মানুষে-মানুষে সংঘর্ষ াধর্েই৷ কারণ জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ একজনের প্রাচুর্য ঘটলে অন্যের অভাব দেখা দের্ে৷ মানুষের এই ক্ষুধা মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদেই মেটাতেই হর্ে৷ হ্ম অকৃপণভাবে অনন্ত মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ মানুষকে সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে হর্ে৷’’

এই সম্পদ সমূহে কীভাবে সদ্যব্যবহার  করতে হবে  তারই মূলনীতিটাই হল প্রাউটের মূল কথা৷ আর এতেই রয়েছে বিশ্বের সমস্ত ,সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানের চাবিকাঠি৷

এই কারণেই তিনি তাঁর তত্ত্বের নাম দিয়েছেন প্রগতিশীল নিয়োগ তত্ত্ব৷

অর্থাৎ কীভাবে এর যথাযথ উপযোগ গ্রহণ করতে হবে---প্রকৃত কল্যাণমূলক তত্ত্ব  বা নীতি হওয়া উচিত হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, অনুমান ভিত্তিক হলে চলবে না৷ বাস্তব পরিস্থিতিকে দেখে সিদ্ধান্ত তৈরী করতে হবে৷ যেমন গাছ থেকে ফল পড়া দেখে নিউটন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব দিলেন৷ এটাই প্রকৃতি কল্যাণমূলক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য৷

প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের প্রগতি ও উপযোগের ব্যাখ্যা করা হল, এবার তত্ত্ব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করব৷

মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘‘সভ্যতা সংকটজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে  আছে৷ আর এই সংকটের প্রধান কারণ, আগে সিদ্ধান্ত (থিওরী) তৈরী করে নেওয়া হচ্ছে, প্রয়োগের দিকটা (প্র্যাকটিষ্ট) আসছে পরে৷’’

এইভাবে আগে সিদ্ধান্ত ওপরে তার প্রয়োগ করতে গেলে সেখানে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ণ  খুব কঠিন ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে৷  সমাজ দর্শণের ক্ষেত্রে এক শ্রেণী দার্শনিক সিদ্ধান্ত নিলেন,মানুষকে যদি সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেওয়া হয়৷ তার সবদিক থেকে মঙ্গল হবে ও সমাজের সবদিক থেকে মঙ্গল হবে৷  এই অনুমানের বশবর্ত্তী হয়ে তাঁরা ব্যষ্টিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ (individualism) তত্ত্ব দিলেন৷ এর স্বপক্ষে ব্যাপক প্রচারও করলেন৷ পরবর্ত্তীকালে দেখা গেল এ থেকেই  ধনতন্ত্র ও ধনতান্ত্রিক শোষন শুরু হয়ে গেল ৷ এখানে দার্শনিকরা  বাস্তব প্রয়োগ না দেখে আগেই সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন ও পরে তা প্রয়োগ করতে গেলেন৷ তাই শেষ পর্যন্ত তা সমাজের পক্ষে কল্যাণকর হচ্ছে না৷ অপর দিকে ধনতান্ত্রিক শোষনের বীভৎস রূপ দেখে একশ্রেনীর দার্শনিক অনুমান করে নিলেন, না ব্যষ্টির কোনো স্বাতন্ত্র্য থাকতে পরে না, সমষ্টিই আসল কথা৷ সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বলি দেওয়াতেই সমাজের সর্র্বধিক মঙ্গল৷ কেউ কেউ বললেন , ব্যক্তিগত সম্পত্তির লোভ করলেই সমাজে কোনো প্রচার   শোষন থাকবে না৷ এ থেকে আবার দেখা দিল জনসাধারণের ব্যাপকভাবে স্বাধীনতা হরণ, স্বৈরাচার, একনায়কতান্ত্রিক শোষন৷ এক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োগ বাস্তব পরিস্থিতি  না দেখেই এ কেবল অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই দর্শন দেওয়া হয়েছিল৷ তার পরিনামও শেষ পযর্ন্ত ভাল হয়নি৷ এক ধরনের শোষন দূর করতে গিয়ে ভিম ধরেেনর আরও তীব্র শোষন ও নির্র্যতিতা হয়েছে৷ রক্তের স্ত্রোত বয়ে গেছে৷

তাই মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘প্রথমে বাস্তব জগৎকে পর্যবেক্ষন করে তাকে অনুধাবন করা হল৷ উদাহরণ, আপেল মাটিতে পড়ার পর সিদ্ধান্ত তৈরী হল --- সিদ্ধান্ত তৈরী হবার পর আপেল মাটিতে পড়েনি৷ এইসব ক্ষেত্রে, যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমিকে অনুসরণ করে,  প্রয়োগভূমি থেকে আত্মপ্রকাশ করে  তাকে স্বল্প প্রয়াসেই বাস্তবে রূপায়িত করা যায়, তবে তা প্রচেষ্টা, সময় ও সংযোগের ওপর নির্ভরশীল, চেষ্টা অধিক হলে অল্প সময়েই বাস্তবায়িত হবে৷’’

প্রাউট হ’ল সেইরূপ প্রয়োগভৌমিক তত্ত্ব অর্থাৎ যে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমি থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে,৷ তাই মানব সমাজের  সর্বাত্মক কল্যাণের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি নিয়ে এর আবির্ভাব৷