‘‘ভারতের সমস্ত ভাষাগুলিকে সমান অধিকার ও মর্যাদা দিতে হবে৷ সংস্কৃত হবে সকলের সাধারণ ভাষা কেননা তা সমগ্র ভারতেরই পিতৃপুরুষদের ভাষা৷ যদি সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে সংস্কৃতকে স্বীকৃত দেওয়া হয় তাহলে তা সকলের পক্ষেই সুবিধাজনক হবে৷ আগেই বলা হয়েছে ভারতের সমস্ত ভাষারই মূল উৎস সংস্কৃত৷ যখনই কোনো ভাষায় কোনো বিশেষ শব্দের অভাব হবে, সংস্কৃতের শব্দ সম্ভার থেকে সেটা সংগ্রহ করা সম্ভবপর হবে৷ যদি জোর করে তোমাকে হিন্দী শিখতে হয়, যেমনটি আজ করা হচ্ছে, সেটা বাঞ্ছনীয় নয়৷ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ মাতৃভাষায় নিজেদের অভিব্যক্ত করার সুযোগ না পাচ্ছে ততক্ষণ তারা অন্যের সঙ্গেও যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয় না৷’’
প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ‘‘ভাষার তাৎপর্য’’ প্রবন্ধে উপরোক্ত কথাগুলিতে স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছেন বহুভাষাভাষীর রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মজবুত করতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার গুরুত্ব কতটা৷ মাতৃভাষাকে অবদমন করতে গেলে পরিণতি কি হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশ৷ তা দেখেও ভারতের শাসকবর্গের চৈতন্য হয়নি৷ তারা জোরপূর্বক হিন্দি চাপাতে চায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে৷ বাধাও পাচ্ছে, দক্ষিণ ভারত একপ্রকার হিন্দিকে বর্জন করেছে বলা যায়৷ বহু রাজ্যেই মাতৃভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে৷ সংবিধানেও তা স্বীকৃত আছে৷
ব্যাতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ, স্বাধীনতার জন্মলগ্ণ থেকেই দিল্লী বাঙালী বিদ্বেষী৷ তাদের লোভ বাঙলার ধনসম্পদের প্রতি৷ বাংলার উন্নত ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতিতে তারা উপেক্ষা করেই এসেছে৷ শুধু তাই নয়, তাকে আরও নীচুস্তরে নামিয়ে আনার প্রয়াস করে চলেছে৷ আর তাদের একাজে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সাহায্য করে গেছে ৭৬ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের অপদার্থ শাসকেরা৷
বাঙলা শোষকের কাছে উর্বরভূমি৷ তারা বাঙলায় আছে উন্নত ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি প্রীতি নয়, তার কৃষিজ,খনিজ, বনজ, জলজ সম্পদ লুন্ঠনের জন্যে৷ তাই বাঙলা আজ ভারতের নয়া উপনিবেশ৷
প্রাউট প্রবক্তা শোষণ বিষয়ে বলেছেন --- “ফ্যাসিষ্ট শোষকরা তাদের শোষণের সুবিধার জন্যে প্রথমেই প্রাকৃতিক সম্পদপূর্ণ একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয়৷ ফ্যাসিষ্টদের ক্রুরদৃষ্টি যে জনগোষ্ঠীর ওপর নিৰদ্ধ হবে সেই জনগোষ্ঠীকে তারা প্রথমেই চেষ্টা করবে তাদের নিজস্ব সামাজিক–সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উৎখাত করতে৷ এই প্রয়োজনে ফ্যাসিষ্ট শক্তি সর্বদাই ওই জনগোষ্ঠীর ওপর অন্যতর এক ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে চাপিয়ে দিতে চায়, যার ফলে ওই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যষ্টি মানস সহজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, তার মধ্যে এক ধরনের পরাজিত মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে৷ ওই পরাজিত মনোভাব তার তেজকে, সংগ্রামশীলতাকে ধ্বংস করে’ তার মানসিকতাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে ফেলে৷ তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের জন্যে ফ্যাসিষ্টরা ওই পটভূমিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে৷ ফ্যাসিষ্ট শোষণের প্রধান লক্ষ্য হ’ল প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনের জন্যে প্রয়োজনে একটি জনগোষ্ঠীকে শোষণের প্রধান লক্ষ্য হ’ল প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনের জন্যে প্রয়োজনে একটি জনগোষ্ঠীকে ইতিহাসের বুক থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়া” ৷ স্বাধীনতার পর থেকে এই ফ্যাসিষ্ট শোষণের শিকার বাঙলা৷ ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ভিনরাজ্য থেকে বাঙলার ঘাড়ে চেপে বসা জনগোষ্ঠীগুলিকে খুশী করতে বাঙলার শাসকবর্গ তার নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বাঁচাবার কোন চেষ্টাই করেনি ৭৫ বছরে৷ বর্তমান সরকার বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে মাঝে মাঝে একটা করে সিদ্ধান্ত নেয়৷ তারপরেই ভিনরাজ্যের ভাষাভাষীদের গোঁসা ভাঙাতে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরেও আসে৷ এবারেও মন্ত্রীসভা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কিন্তু পরদিন শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট সেটা বাংলা ভাষা সাহিত্য কৃষ্টি সংস্কৃতির সুরক্ষার থেকেও ভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠীগুলোকে খুশী করার প্রয়াস বেশী৷ মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রবাদটা অবশ্যই মনে রাখা উচিত--- ‘যে সকলকে খুশী রাখতে চায়, সে কাউকে খুশী রাখতে পারে না৷’’ তাই বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর দিকে না তাকিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র বাঙালীর মাতৃভাষা ও তার উন্নত মানের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে, হিন্দি আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে সুস্পষ্ট ভাষানীতি ঘোষণা করা হোক৷ যাতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সরকারী বে-সরকারী সমস্ত বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো বাধ্যতামূলক হবে ও সরকারী বেসরকারী কাজে বাংলাভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে৷ ভারতবর্ষের বহুরাজ্যেই বাঙালীর বাস আছে৷ কিন্তু তারা সেইসব রাজ্যের ভাষা শিখতে বাধ্য হয়৷ সরকার সেখানে বাঙলা ভাষা শিক্ষার বিশেষ কোনো আইন করেনি৷ তাই বাঙলায় থাকতে গেলেও বাংলা ভাষা শিখতেই হবে৷ ঘরে বসে যে যার ভাষা শিখুক৷ কর্মক্ষেত্রে বাংলা একমাত্র বাংলাই ব্যবহার করতে হবে৷ এটাই হবে ভাষানীতি৷