তিরিশে এপ্রিলের নারকীয় হত্যাকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে যখনই মানুষের সার্বিক কল্যাণে কেউ এগিয়ে এসেছে তখনই স্বার্থান্বেষী কায়েমী শক্তি তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে ও ক্ষুদ্র স্বার্থের যূপকাষ্ঠে  বৃহত্তর স্বার্থের বলিদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে৷ গৌতম বুদ্ধ, যীশুখ্রীষ্ট, সক্রেটিস, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র সকলকেই ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে প্রবলের অত্যাচারে দুর্বল যখন চরম উৎপীড়িত, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির কশাঘাতে পরাধীন রাষ্ট্রগুলির মানুষজনের ওপর নির্যাতনের বিভীষিকা, একদিকে বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শোষণ আর অপরদিকে জড়বাদের জোড়া ফলায় সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত তখনই আবির্ভাব যুগপুরুষ তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্ত্তিত সর্বানুসূ্যত আনন্দমার্গ দর্শনের যা মানুষের ব্যষ্টিগত তথা সমষ্টিগত সকল প্রকার রোগের মকরধবজ স্বরূপ৷ আনন্দমার্গ দর্শনের মধ্যে রয়েছে সকল মানুষের জন্যে ভৌতিক, মানসিক  ও আধ্যাত্মিক শোষণমুক্তির দিগ্নির্দেশনা৷ পুঁজিবাদের ভৌতিক মুনাফা সর্বস্ব নীতি ধনীকে করেছে আরও ধনবান, দরিদ্র ক্রমশঃ শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে হয়েছে কঙ্কালসার৷ অপরপক্ষে কমিউনিজমের জড়বাদী তত্ত্ব মানুষের প্রাণধর্মকে শোষণ করে মনুষ্যত্বহীন পশুর স্তরে নাবিয়ে এনেছে৷ এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের আত্মসম্মান বা আত্মবিশ্বাস বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না৷ এই পরিস্থিতিতে আনন্দমার্গ দর্শন মানুষকে শোনাল আশ্বাসের বাণী, মনের মধ্যে ছোঁয়াল আত্মবিশ্বাসের পরশমণি৷

পরবর্তী ধাপে মানুষের সর্বাত্মক শোষণের অবসানকল্পে আবির্ভূত হ’ল পুজিবাদ ও জড়বাদের ত্রুটিমুক্ত সামাজিক তথা অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ Progressive utilization theory) বা সংক্ষেপে ‘প্রাউট’৷ প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার ওরফে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই দর্শন সমাজ নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছে সদ্বিপ্রের ওপর যাঁরা একদিকে আধ্যাত্মিকতায় সমুজ্জ্বল ও সমুন্নত, নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অত্যন্ত বলিষ্ঠ৷ প্রাউট দর্শনের মূল বক্তব্য হ’ল জগতের সমস্ত সম্পদের মালিক বিশ্বপিতা ও সমগ্র জাগতিক সম্পদ সকল সৃষ্ট জীবের যৌথ সম্পত্তি৷ তাই কোনও ব্যষ্টি সামবায়িক সংস্থার সুষ্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না ও সকল প্রকার সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে৷  স্বাভাবিকভাবেই প্রাউট দর্শন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে কোনওপ্রকার শোষণের সুযোগ থাকবে না৷ সর্বোপরি সমাজের নেতৃত্বে কঠোর নীতিবাদী, আধ্যাত্মিকতায় বলীয়ান, যম-নিয়মে প্রতিষ্ঠিত, আপোষহীন সংগ্রামী সদ্বিপ্র গোষ্ঠী থাকার ফলে সমাজ সঠিকপথে এগিয়ে চলতে বাধ্য হবে ও মানুষের ভৌতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক---ত্রিবিধ উন্নতি সাধন সম্ভব হবে৷ প্রাউট প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক-সামাজিক তথা ধর্মনৈতিক (যা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার পরিপন্থী) শোষণের সুবিধা না থাকার কারণে তথাকথিত স্বার্থলোলুপ সমাজ নায়কেরা এই দর্শন প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে ওঠে ও আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ তথা প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারকে তাদের প্রধান শত্রু রূপে চিহ্ণিত করে৷ পুঁজিবাদী ও জড়বাদী উভয়েই আনন্দমার্গ তথা প্রাউটের ব্যাপক প্রচারে শঙ্কিত হয়ে নিজেদের মৃত্যু-ঘণ্টাধবনি শুণতে পায়৷

তখন ভারতের কেন্দ্রীয় স্তরে ও অন্যান্য রাজ্যে পুঁজিবাদের ধবজাধারী সরকার আর পশ্চিমবঙ্গে জড়বাদী কমিউনিষ্ট দ্বারা চালিত সরকার ক্ষমতায় আসীন ছিল৷ ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে আধ্যাত্মিকতার চিরন্তন প্রবাহ আপামর সাধারণ ভারতবাসীর মর্মে স্বাভাবিকভাবে অধ্যাত্মবাদের উন্মেষ ঘটায়৷ সেই কারণে আধ্যাত্মিকতা সমন্বিত প্রাউট দর্শন ভারতবাসীকে সহজেই আকৃষ্ট করেছিল ও দেশের মানুষ আনন্দমার্গ তথা প্রাউট দর্শনকে আপন করে নিয়েছিল৷ সারা দেশে এই দর্শনের দ্রুত প্রচার ও প্রসারের ফলে কায়েমী স্বার্থবাদীরা অশনি সংকেত লক্ষ্য করে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়ে ও আনন্দমার্গকে উৎখাত করতে উঠে পড়ে লাগে৷ এই জন্যেই আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের জন্মলগ্ণ থেকেই  তার প্রভূত জনপ্রিয়তার ফলে সরকারী তরফে (কেন্দ্র ও রাজ্য) আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের বিরোধিতায় বিশেষ তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়৷ কিন্তু সার্বিক বিরোধিতা ও কুৎসা সত্বেও  আনন্দমার্গের প্রসারকে রুদ্ধ করা যায় নি৷ বরং তা আরও দ্বিগুণ শক্তিতে দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, নগরে ও বহির্বিশ্বে প্রসারিত হতে থাকে৷ একদিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সিবিআই ও অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কমিউনিষ্ট পরিচালিত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জড়বাদী কমিউনিষ্ট দল আনন্দমার্গকে ধবংস করার ব্লু-প্রিণ্ট রচনা করতে থাকে৷ এরই পরিণামে সংঘের ওপর চরম আঘাত আসে ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় আশ্রম, পুরুলিয়া জেলার জয়পুর থানার অন্তর্গত বাগলতা অঞ্চলের আনন্দনগরে৷ জঙ্গলাকীর্ণ, বন্য জীবজন্তুসংকুল পাহাড়ী অঞ্চলের পাথর ভেঙ্গে অতি কষ্টে জনহিতকর প্রকল্পগুলি যথাক্রমে বিদ্যালয়, হাসপাতাল, অনাথাশ্রম, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কুষ্ঠাশ্রম ইত্যাদি গড়ে তোলার জন্যে দিবারাত্রি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীগণ পরিশ্রম করে চলেছিলেন যাতে সেই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষজন শিক্ষার আলো, অসুখের চিকিৎসা, নিঃস্ব ও দরিদ্র শিশুরা অনাথাশ্রমে থেকে লেখাপড়ার সুযোগ পায়৷ এই বিশাল কর্মযজ্ঞের ফলে আদিবাসী অধ্যুষিত ওই অঞ্চলে দলীয় সমর্থন ও প্রতিপত্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় গড়জয়পুর ব্লকের দলদাস আধিকারিক ও কর্মচারীর যোগসাজশে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় হাজারে হাজারে সশস্ত্র কমিউনিষ্ট শয়তানের দল আনন্দনগরের মহান কর্মযজ্ঞকে পণ্ড করবার জন্যে নিরীহ, নিরস্ত্র সন্ন্যাসীদের আক্রমণ করে৷ ফলস্বরূপ প্রকাশ্য দিবলোকে পাঁচজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী কমিউনিষ্ট গুণ্ডা-দস্যুদের অস্ত্রাঘাতে নিহত হন পুলিশ প্রশাসনের সামনেই৷ পরবর্তীকালে আদালতের বিচারে কমিউনিষ্টদের এই চক্রান্ত প্রমাণিত হয় ও ১৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়৷ অপরাধীদের মধ্যে গড়জয়পুরের বিডিও অশোক চক্রবর্তীও দোষী সাব্যস্ত ও দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত হন৷ এছাড়া ১৯৬৯ সালে কোচবিহারে ধর্মমহাচক্রের সময়ে আনন্দমার্গের একনিষ্ঠ ভক্ত ও কর্মী রবি সরকার নরাধম কমিউনিষ্টদের আক্রমণে নিহত হন৷

কেন্দ্রের তৎকালীন সরকারও এ বিষয়ে পিছিয়ে ছিল না৷ তারা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনী সিবিআইকে লেলিয়ে দিয়ে আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের প্রবক্তার বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলার জাল রচনা করল৷ সিবিআই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্রয়ে, প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় বীরবিক্রমে এই পরিকল্পনায় সামিল হ’ল৷ ১৯৭১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর  মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মিথ্যা সাজানো ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলায় পটনার বাসভবন থেকে গ্রেফ্তার করা হয়৷ জেলের ভিতরে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর অমানবিক ব্যবহার ও নিপীড়ন চলতে থাকে৷ এই অবস্থাতেও সংঘের কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবেই চলছিল৷ ফলে সিবিআই আরও বেশী বিভ্রান্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল যার চরম পরিণতি ঘটল ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী, যেদিন ঔষধের পরিবর্তে মার্গগুরুকে বিষ প্রয়োগ করা হ’ল৷ তিনি ঐশী শক্তির প্রভাবে সেই তীব্র কালকূট গলাধঃকরণ করে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়ে গেলেন কিন্তু তাঁর শরীরে সেই ভয়ানক হলাহলের বিষম প্রতিক্রিয়া দেখা দিল৷ তিনি এই বিষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানালেন ও সেই দাবীতে ১৯৭৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে অনশন শুরু করেন৷ সুদীর্ঘ এই অনশন চলেছিল ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট পর্যন্ত, যেদিন পটনা উচ্চ আদালতের বিচারে তাঁর বিরুদ্ধে রচিত সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা সাজানো প্রমাণিত হয় ও তিনি সসম্মানে মুক্তিলাভ করেন৷ পৃথিবীর ইতিহাসে সুবিচারের দাবীতে পাঁচ বছর চার মাস দুই দিন অনশন একটি বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব ঘটনা৷

ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আকাশে ঘটে গেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা৷ ১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন মধ্যরাত্রি থেকে সারা দেশে ঘোষিত হ’ল ‘জরুরী অবস্থা‘৷  অগণিত রাজনৈতিক দল ও সংস্থা নিষিদ্ধ হ’ল৷ আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ সহ সমস্ত শাখা সংঘটন নিষিদ্ধের তালিকা ভুক্ত হ’ল৷ সংঘের সর্বস্তরের হাজার হাজার কর্মী কারারুদ্ধ হলেন৷ জনকল্যাণে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়, কলেজ, হাসপাতাল সব বন্ধ হয়ে গেল৷ যাঁরা জেলের বাইরে ছিলেন তাঁরা হলেন গৃহছাড়া৷ সংঘের তখন ভয়ানক দুর্দিন৷ অনাথাশ্রমের ছেলেমেয়েরা নিরাশ্রয় হ’ল৷ একমাত্র পরমপুরুষের কৃপাই ছিল তাদের রক্ষাকবচ৷ এই দুরন্ত ঝঞ্ঝাও আনন্দমার্গকে ধবংস করতে পারে নি৷ বরঞ্চ দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আরও বিশাল মহীরুহের আকারে স্বমহিমায় বিস্তৃত হ’ল৷ অধ্যাত্মবাদীদের এই দুর্জয় শক্তি, অদম্য অনুপ্রেরণা, আদর্শের জন্যে জীবনপণ সংগ্রাম, জড়বাদীদের ভীষণভাবে আতঙ্কিত করে তুলল৷ তারা আবার নবপর্যায়ে আক্রমণের নীল নক্সা রচনা করতে শুরু করল৷ কখনও বিদেশের গুপ্তচর, সি আই এ-র দালাল, ধর্মের শত্রু, ইসলাম বিদ্বেষী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ভূষিত করে আনন্দমার্গের নামে চলল কুৎসা ও অপপ্রচার৷ কলকাতাস্থিত কমিউনিষ্ট নেতৃত্ব এক গণ কনভেনশনে আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে ঘোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হ’ল যার কার্যকর রূপ প্রদর্শিত হল ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল৷ এই দিনের জঘন্যতম আক্রমণের পটভূমিকা তৈরী করার জন্যে ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হ’ল তিলজলা, কসবা অঞ্চলে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের নামে৷ যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর দল অসহায়, নিরাশ্রয়, দরিদ্র ছোট ছোট শিশুদের দিয়েছিল মায়ের মমতাভরা কোল, পিতার স্নেহসিক্ত নিশ্চিন্ত আশ্রয়, তাদের বিরুদ্ধে ছেলেধরার গুজব তুলে নগরবাসীদের সতর্ক ও সাবধান করা হ’ল৷ একজন সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দুটি শিশুকে দেখে তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে অত্যাচার ও গ্রেফ্তারের ব্যবস্থা করা হ’ল কমিউনিষ্ট বিধায়কের নির্দেশে৷ পরবর্তীকালে অবশ্য আদালত তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন যেহেতু শিশুগুলির মাতা-পিতা জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা স্বেচ্ছায় ওই শিশুগুলির দায়িত্ব সেই সন্ন্যাসিনীর হাতে অর্পণ করেছিলেন৷

এরপর এল সেই বিভীষিকাময় ৩০শে এপ্রিলের সকাল৷ কলকাতার ভি.আই.পি. নগরে অবস্থিত আনন্দমার্গের আশ্রমে আসার পথে বিজন সেতু ও বণ্ডেল গেট চত্বরে কাতারে কাতারে বর্বর, পাষণ্ড নরপিশাচের দল  লাঠি, বাঁশ, ছুরি, শাবল নিয়ে আক্রমণ করল সংঘের কাজে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের৷ ট্যাক্সি থেকে টেনে হিঁচরে নামিয়ে, রিক্সা থেকে ফেলে দিয়ে হাতের অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে মারল ১৬ জন সন্ন্যাসী ও ১ জন সন্ন্যাসিনীকে৷ ছুরি দিয়ে উপরে ফেলল চোখ, সর্বাঙ্গে ঢেলে দিল অ্যাসিড ও পেট্রোল৷ তারপর দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন লাগাল সেই অত্যাচারিত, ক্ষত-বিক্ষত নগ্ণ দেহে৷ প্রকাশ্য দিবালোকে তিলোত্তমা কলকাতার রাস্তায় থানা থেকে অদূরে এই ধরণের সংঘটিত বিভীষিকাময় তাণ্ডব চলল কয়েক ঘণ্টা ধরে৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরণের নৃশংসতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কোনও নজির নেই৷ পরবর্তী সময়ে সংবাদে প্রকাশিত হয় যে, পুলিশ প্রশাসন ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্তাগণ ঘোষণা করেছিলেন---কলকাতায় কোন ছেলে চুরির ঘটনা ঘটেনি৷ সুতরাং এটা জলের মত পরিষ্কার যে শুধুমাত্র আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের হত্যা ও আনন্দমার্গকে শেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই গুজবের চক্রান্ত করা হয়েছিল৷ বাঙলা তথা ভারতবর্ষের বুকে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের ওপর এই নারকীয় হত্যালীলার সংবাদে সমগ্র সভ্য সমাজ শিউরে উঠেছিল৷ ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত বাক্রুদ্ধ হয়েছিল পৃথিবী৷ এই বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের দল গর্জে উঠেছিল বিংশ শতাব্দীর জঘন্যতম অন্যায়ের প্রতিবাদে৷ দেশে-বিদেশে উপযুক্ত বিচার ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে সরব হয়েছিল সর্বস্তরের মানুষ৷ প্রাকৃতিক নিয়মে এই সব অপরাধীদের সাজা অবশ্যই হবে---হয়তো ইতোমধ্যে হয়েওছে৷ কিন্তু মানুষের আদালতে এখনও বিচার বাকী৷ আমরা আশাবাদী, মানুষের আদালতেও এই নরপিশাচদের প্রকৃত বিচার ও শাস্তির দণ্ডাজ্ঞা অবশ্যই ঘোষিত হবে---আর সেই দিন পদদলিত মানবতা সুউচ্চ গরিমায় ও স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবে৷

আনন্দমার্গের ওপর আক্রমণের এখানেই শেষ নয়৷ এই ধরণের আরও অজস্র ঘটনার মধ্যে অন্যতম পুরুলিয়ার আনন্দনগরে ১৯৯০ সালের ২রা এপ্রিলের আর একটি ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড৷ সেদিন কৃষিবিজ্ঞানী অসীমানন্দ অবধূত সহ পাঁচ জনকে খুন করে কমিউনিষ্ট জহ্লাদ বাহিনী৷ তাঁদের অপরাধ ছিল, পুরুলিয়ার পাথুরে টাঁর জমিতে আঙ্গুর, চা, কফি ইত্যাদি অর্থকরী ফসল উৎপাদনের পদ্ধতি স্থানীয় মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছিলেন৷ এই ধরণের ধারাবাহিক আক্রমণ যত আনন্দমার্গ সংঘটনের ওপর এসেছে, সংঘটন ততই ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে বিস্তার লাভ করেছে আর ওই সব পুঁজিবাদী, জড়বাদী হিংস্র হায়নার দল ক্রমশঃ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে৷ আনন্দমার্গীদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন এসেছে যে প্রাউট দর্শনের জন্যে তা একদিন এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবেই ও মানুষের সর্বাত্মক কল্যাণে সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত মানব সমাজ রচিত হবেই --- এটা মহাসম্ভূতির আপ্তবাক্য, তাই অবশ্যম্ভাবী৷

পরিশেষে স্মরণ করি মহা সম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মহান বাণী---

‘‘অন্ধকার যতই হোক না কেন, তারপর প্রভাত আসবেই আসবে৷ অন্ধকারের পিশাচ যতই অট্টহাসি হাসুক না কেন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তার সব কিছু শূন্যে মিলিয়ে যাবেই যাবে৷’’