পরমপুরুষের পরম রচনাত্মক শক্তি নিজ আন্তরিকতা তথা ভূমামনের চেতনাশক্তির সাহায্যে ভৌতিক জগতের জড় অথবা জীব সত্তার বিভিন্ন রূপ প্রদান করে থাকে৷ প্রত্যেক বস্তু তাঁরই রচনা, প্রত্যেক বস্তু তাঁরই দ্বারা সংরক্ষিত ও পালিত হয়ে থাকে৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরই বিরাট ভূমামনে সমস্ত জাগতিক সত্তার অন্তিম পরিণতি ঘটে যায়৷ অর্থাৎ পরমসত্তার মানসিক আধার ভূমিতে সব কিছুর লয় হয়ে যায়৷ এই কারণে আমি বলি কোন বস্তুই ক্ষুদ্র নয়, কোন বস্তুই অনাবশ্যক নয়৷ যদি অগুন্তি প্রোটোপ্লাজম দ্বারা এই সামূহিক শরীর তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে তোমার মনও একটি সামূহিক মন৷ এছাড়া প্রত্যেক প্রোটোপ্লাজম একটি জীবিত সত্তা৷ আর এই কারণে প্রত্যেক জীবিত সত্তার নিজস্ব অণুশক্তি (Microcosm) আছে৷ এই মানব শরীরে তাদের অবিকশিত অনুভব সীমিত কার্যক্ষেত্রে সীমিত রূপে কাজ করে যায় বটে, কিন্তু তার সঙ্গে এটাও সত্য যে এই অণুমন সমূহের অস্তিত্বতো ভূমামনের ৰৃহৎ অধিক্ষেত্রের মধ্যেই৷
কিছু মানুষের এই রকম স্বভাব আছে যে সে নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ মনে করে৷ কেউ বলে, আমার তো কোন প্রয়োজন নেই কেউ বলে, আমি অশিক্ষিত, কেউ বলে, আমি ধনী নই ইত্যাদি৷ কিন্তু এটা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে কেউ যেন মনে কোন প্রকার হীনম্মন্যতা প্রশ্রয় না দেয়৷ কেননা ভূমামনের মধ্যে তোমার অত্যন্ত সম্মানজনক এক স্থান রয়ে গেছে৷ তাহলে কী করে সে এক অপ্রয়োজনীয় সত্তা হয়ে গেল? কেউই অপ্রয়োজনীয় নয়৷ এই কারণে একথা বলা হয়ে থাকে যে–পরমপুরুষ হচ্ছেন সকল জীবের সাক্ষীসত্তা (He is the cognitive counter part)–তিনি হচ্ছেন পরম জ্ঞাতৃসত্তা৷
অতএব ‘সমপ্লুশিনা’ অর্থাৎ এক অতি সাধারণ ক্ষুদ্র জীব উঁইপোকাও অনাবশ্যক নয়৷ ‘সমমশকেন’–একটি ছোট মশাও অনাবশ্যক নয়৷ ‘সমনাগেন’–‘নাগ’ শব্দের একটি অর্থ অজগর, এর অন্য অর্থ হ’ল সাদা হাতী৷ অর্থাৎ একটি ক্ষুদ্র উইপোকা কিংবা মশার মহত্ত্বও একটি সাদা হাতী থেকে কম নয়৷
‘সমএভিস্ত্রিভিলোকৈঃ’–ত্রিলোকের মহত্ত্বও ঠিক ততটাই অর্থাৎ একটি পোকা কিংবা মাছি থেকে অধিকও নয়, আবার কমও নয়৷ ত্রিলোকের অর্থ কী? –ত্রিভুবন৷ তোমার একটি ভৌতিক শরীর আছে, যা নানান ভৌত পদার্থ তথা অনেক তত্ত্ব দ্বারা নির্মিত৷ পঞ্চভূতের সমবায়ে সৃষ্ট জগৎকে আমরা ব্রহ্মাণ্ড বলে থাকি৷ তুমি এই ভৌতিক জগতেই বসবাস করছ৷ এটি হচ্ছে একটি ভুবন৷ কোন জীবিত প্রাণীর যে ভৌতিক শরীর আছে, এর যে সূক্ষ্মতম অংশ আছে তা যখন চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে মানসধাতুতে (ectoplasm) রূপান্তরিত হয়ে যায়, তখন তা মনের রূপ ধারণ করে যাকে ‘মন’ (অণুমন) বলি৷ আবার তোমরা জান যে তোমার তুমিটাই সমগ্র মন নয়৷ তুমি হচ্ছো মনের ধারণকর্তা৷ এইভাবে মানসিক জগৎ ও ভৌতিক–দুই স্তরেই তোমার অস্তিত্ব আছে৷ এছাড়া সূক্ষ্মতর মানসিক জগতেও তোমার তৃতীয় অস্তিত্ব আছে৷
পরম সত্তার Astral স্তর থেকে নীচে নেমে আসা ও আবার সেই স্তরে ফিরে যাওয়া বা ওই স্তরে বিচরণ করাকে কারণ সত্তা বলা হয়ে থাকে৷ Astral ও causal–শব্দ দু’টি সমার্থৰোধক৷ সংস্কৃতে এদের উপযুক্ত শব্দ হচ্ছে–‘কারণ জগৎ’৷
তোমার মধ্যে যে ‘আমি আছি’ ৰোধ আছে তা তোমার ভৌতিক তথা মানসিক শরীরের মধ্যে রয়েছে৷ এটা তোমার Astral বা কারণ জগৎ৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল–তোমার শরীরটা কী? তোমার শরীর অর্থাৎ তোমার মধ্যে যদি ‘তুমি’কে দেখতে চাই, তুমি দেখাতে পারবে না৷ বস্তুতঃ তোমার সেই ‘আমি’, ‘আমি আছি’ ৰোধের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে৷ অর্থাৎ ওই কেন্দ্রীভূত ‘অহম্’ সূক্ষ্ম কারণ জগৎকে স্পর্শ করে আছে৷ অর্থাৎ ওই সূক্ষ্ম কারণ জগৎই তোমার তৃতীয় ভুবন৷ তাই তোমার আছে–এক ভৌতিক জগৎ, দ্বিতীয় মানসিক জগৎ ও তৃতীয় এক সূক্ষ্ম কারণ জগৎ৷
এই ভাবে অণুমন তথা, ভূমামন দু’য়ের জন্যেই আছে তিনটি জগৎ৷ অণুমনের ক্ষেত্রে এই তিনটি জগৎ মনের দ্বিতীয় শ্রেণী, প্রথম শ্রেণী হচ্ছে ৰোধাত্মক মন (cognitive mind)৷ দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে বর্ত্তমান মন (Doer mind) তথা বিষয়ভূত মন৷ মনকে দেখা যায় না৷ অনুভব করতে হয়৷ এই ভাবে জীবের ক্ষেত্রে আছে তিনটি ভুবন (ত্রিভুবন)৷
যখন মানুষ পরম সত্তার দিকে এগিয়ে যায়–প্রথমে তাকে ভৌতিক জগৎ হয়ে এগিয়ে যেতে হয়৷ এই ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতাত্মক জগতের অংশ, আর তা মন নয়৷ দ্বিতীয় স্তরে মানুষ অনুভব করে যে সে স্বয়ং বিরাটের অংশ৷ তৃতীয় স্তরে মানুষ অনুভব করে যে সে এমন এক বিষয়, যা ভূমাসত্তার বিষয়বস্তু৷
এই ভাবে শেষ স্তরে মানুষ নিজেকে পরমপুরুষের চরণে সমর্পিত করে দেয় তথা তাঁর সাথে তার একাত্মীকরণ হয়ে যায়৷ একেই নির্বিকল্প সমাধি বলা হয়ে থাকে৷ এটাই মানব জীবনের অন্তিম লক্ষ্য তথা মানব প্রগতি তথা মানুষের গতিশীলতার চরণ পরিসমাপ্তি৷