প্রাচীন পৃথিবীতে রাষ্ট্রিক ও বৈবসায়িক লেনদেনে প্রচলিত ছিল স্বর্ণমান৷ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বিত্তমান (bullion) ছিল স্বর্ণের৷ তবে কোন কোন দেশে রৌপ্যও ছিল৷ যে সকল দেশে স্বর্ণমান ছিল তারা কেউ কেউ রৌপ্য বিত্তমানকে স্বীকৃতি দিত, কেউ বা দিত না৷ স্বর্ণমানের দেশ রৌপ্য–মানকে স্বীকৃতি না দিলে বিত্তমানগত তারতম্যের দরুণ মুদ্রাগত লেনদেন সম্ভব ছিল না৷ তাই সেই সকল দেশের মধ্যে বিনিময় বাণিজ্য (barter trade) চলত৷
‘‘কুরঙ্গ বদলে লবঙ্গ নিব, কুমকুম বদলে চুয়া,
গাছফল বদলে জাইফল পাব, বহেড়ার বদলে গুবা৷’’
ৰাংলার সঙ্গে সিংহল বা শ্রীলংকার, সুবর্ণদ্বীপ বা বার্মার লেনদেন বিনিময় প্রথা বা অদলবদল প্রথায় •barter trade— চলত৷ ৰাংলার গ্রামজীবনের অধিকাংশ কেনাবেচা বিনিময় প্রথায় চলত––ল্পস্বল্প হত মুদ্রার মাধ্যমে৷ গ্রামের কৃষিজীবীরা কৃষিপণ্যের বিনিময়ে বৃত্তিজীবীদের কাছ থেকে পণ্য নিতেন৷ আজ থেকে ১৫০ বছর আগেও রাঢ়ের বীরভূম জেলায় মুদ্রা বিনিময় একরকম ছিল না বললেই চলে৷ চাষী চালের বিনিময়ে আঁব কিনত, পিদিম কিনত, পিলসুজ কিনত, ধুতি–শাড়ি কিনত৷ ছুতোর কাঠের বিনিময়ে বা চিঁড়ের বিনিময়ে বঁটি–কাটারি কিনত৷ বীরভূমের গ্রাম্য মানুষ এই প্রথাকে বলত অদল–বদল প্রথা৷
যেখানে বিত্তমানগত তারতম্য ছিল সেখানে স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রায় কেনাবেচা চলত না৷ সেকালে রাজশক্তি কিছু স্বর্ণমুদ্রা (সীনক), কিছু রৌপ্যমুদ্রা (টংক) বুলিয়ান হিসেবে রাজকোষে রাখতেন৷ কিছু জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন সরকারী উন্নয়নমূলক কর্ম ও কর্মচারীদের বেতনের মাধ্যমে৷ রাজশক্তি যেখানে এই মুদ্রা প্রস্তুত করতেন তাকে বলা হত ‘টঙ্ক শালা’, ৰাংলায় বলা হয় টাঁকশাল..... ইংরেজীতে প্পনুব্ধ্ব এই ‘টঙ্ক’ শব্দ থেকে ‘তঙ্ক’, ‘তঙ্কা’, ‘তনখা’ প্রভৃতি শব্দগুলি এসেছে৷ উত্তর ভারতে এখনও বেতন অথবা পেন্সন অর্থে ‘তন্খা’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে৷ শুভঙ্করীতেও (প্রবক্তা ঃ শুভঙ্কর দাশ, বাঁকুড়ার রাঢ়ী কায়স্থ) রয়েছে––
‘‘মন প্রতি যত তঙ্কা হইবেক দর.....’’
যাই হোক রাজশক্তি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্যে যে পরিমাণ রজতমুদ্রা বাজারে ছাড়তেন তাকে বলা হত ‘গণটঙ্ক’৷ মনে রেখো এই ‘টঙ্ক’ শব্দ থেকেই ‘টঙ্কা’ বা ‘টাকা’ শব্দও এসেছে৷ তোমরা ‘টঙ্ক’ বলতে গিয়ে ভুল করে’ যেন ‘টঙ্গ’ বলে ফেলো না৷ ‘টঙ্গ’ শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে পায়ের নিম্নাংশ, উর্দুতে যাকে ‘টাঙ্গ্’ বলা হয় ৷ সংস্কৃতে পৃষি দীর্ঘ করে’ টাঙ্গ শব্দটিও চলতে পারে৷ এই ‘টাঙ্গ’ শব্দটি থেকে ‘টেংড়ি’, ‘ঠ্যাঙ’ প্রভৃতি শব্দ এসেছে৷ একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ীকে ফার্সীতে বলা হয় ‘ইক্কা’ অর্থাৎ যা একে তৈরী............একক বা ব্ভুন্ব্ধ ৷ ‘টাঙ্গা’ শব্দ সেই অর্থেই চলে৷ ফার্সী ‘ইক্কা’ ও সংস্কৃত ‘টাঙ্গ’ দু’য়ের মিশ্রণে ৰাংলায় একক অর্থে টেক্কার বদলে ‘ইক্কা’ শব্দটি অনায়াসে চলতে পারে৷ এক ঘোড়ার গাড়িকে এই সেদিন পর্যন্ত ‘এক্কা’ গাড়ী বলা হত৷ এক্ষেত্রে অবশ্য ‘টেক্কা’ গাড়ী শব্দ চলবে না৷ কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতায় আছে–––‘‘বেঘোরে বেহারে চড়িনু এক্কা’’৷ সেকালের ঘোড়ায় টানা গাড়ীর ওপরে ছাউনি (ছই বা টপ্পর ) থাকলে তাকেও ‘টঙ্গা’ বলা হত ৷ উত্তর ভারতে আজও তা বলা হয়৷ ‘টঙ্গা’ শব্দটিও সংস্কৃত ‘টঙ্গ’ শব্দ থেকে এসেছে ৷ যাই হোক, ‘গণটঙ্ক’ শব্দের অর্থ সাধারণের ব্যবহার্য রজতমুদ্রা৷
একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, যদিও মূর্ত্তিশিল্প, মন্দির শিল্পগুলিতে সূক্ষ্মত্বের নানা নিদর্শন থাকে যার দ্বারা মানব মনের সূক্ষ্ম রসৰোধের পরিচয় পাওয়া যায়, প্রাচীন ভারতে সর্বত্র –– বিশেষ করে’ দক্ষিণ ভারতে ও ওড়িষ্যায় –– অনেক রাজাই গণটঙ্ক বা গণসীনক উন্নয়নমূলক কাজে বা জনসেবায় খরচ না করে’ মন্দির তৈরীতে ব্যয় করতেন ৷ শোণা যায় প্রাচীন উৎকলের চার বৎসরের রাজস্ব বাবদ আয়ের এক কণাও জনসেবায় ব্যয়িত হয়নি ৷ সবটাই খরচ করা হয়েছিল কোণার্কের মন্দির নির্মাণে৷ কোণার্ক মন্দির স্থাপত্যশিল্পের অনবদ্য নিদর্শন, কিন্তু ওড়িষ্যার দরিদ্র মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে ওই মন্দির নির্মাণ করা কতটা সঙ্গত কাজ হয়েছিল আজকের ওড়িষ্যার শিক্ষিত তরুণেরা তার চুলচেরা বিচার করে’ দেখবে বলেই আশা রাখি৷
গণসীনক বা গণটঙ্ক সাধারণ সরকারী কাজকর্ম ও সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাদে যতটা বেশী উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা যায় ততই ভাল৷ তাতে জনসাধারণের সেবা বেশী হবে, উন্নয়নও তাতে বেশী হবে ও মুদ্রার ঘুর্ণায়মানতার দরুণ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি তাতে বেড়ে যাবে৷ রাজকর্মচারীদের গ্রাসাচ্ছাদনের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে, কিন্তু জনসেবা বাবদ যে অর্থ ব্যয় তা অতি প্রয়োজনীয় বলে তাকে কর্ত্তন করে’ সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি সমর্থন করা যায় না৷ কারণ উন্নয়নমূলক কার্যে যত অধিক অর্থ ব্যয় করা হয় প্রকারান্তরে তার মাধ্যমে সরকারী কর্মচারীদের উন্নতিই হবে, কিন্তু উন্নয়নমূলক কাজ না করে’ সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করলে বাজারে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না৷ ফলে অধিক বেতন পেয়েও সাধারণতঃ সরকারী কর্মচারীদের কোন লাভ হবে না৷ কোন দ্রব্যের আজ বাজার দর যদি হয় ৫ টাকা কেজি, সরকারী কর্মচারীদের স্বচ্ছন্দে রাখবার জন্যে তাদের বেতন যদি দ্বিগুণিত করে’ দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে সরকারী কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতাও কি সেইজন্যে দ্বিগুণ পরিমাণ হয়ে যাবে? বেশী টাকা বাজারে নিয়ে গেলেও সরকারী কর্মচারীরা সেখানে গিয়ে দেখবে ভষ্মে ঘি ঢ়ালার সামিল হচ্ছে৷ বাজার চড়ে হয়েছে আকাশ–ছোঁয়া৷ মূদ্রাস্ফীতি দেশকে আরও চরম ভাবে গ্রাস করবে৷ তাই উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ করে’ অন্য কোন খাতে ব্যয় বাড়ালে অর্থনৈতিক বিচারে তা আত্মহত্যার সামিল হবে৷ উন্নয়নমূলক কার্যের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়লে কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধি না করিয়েও ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকবে৷ আর এই ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারী নির্বিশেষে সকলেরই লাভ৷
বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক বিচারে উন্নয়নমূলক কার্য বলতে সেই কাজকেই ৰোঝায় যা প্রত্যক্ষভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করে, অপ্রত্যক্ষভাবে সম্পদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে৷ যা প্রত্যক্ষভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করে না, অপ্রত্যক্ষভাবে সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজন–পূর্ত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে উন্নয়নমূলক কাজ বলে গণ্য করা যাবে না৷ (১৭ এপ্রিল ১৯৮৮ , কলিকাতা)