প্রাচীনকালে নারীর স্থান
(মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর শব্দ চয়নিকা–২৬ খণ্ড গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে ‘নারীর মর্যাদা’ বিষয়ক অনেক কিছুই বলেছেন৷ ওই গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ সংকলিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে৷ –সম্পাদক)
(মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর শব্দ চয়নিকা–২৬ খণ্ড গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে ‘নারীর মর্যাদা’ বিষয়ক অনেক কিছুই বলেছেন৷ ওই গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ সংকলিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে৷ –সম্পাদক)
এই সমাজে পুরুষেরা বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে৷ পুরুষদের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার জন্যে পরিত্যক্তা নারীদের একাংশ পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে ৰাধ্য হয়৷ যখন সমাজে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও পুরুষের সমান মর্যাদা পাবে তখন এই ধরণের বৃত্তি ৰন্ধ হয়ে যাবে৷ যে সব নারী ওই জঘন্য বৃত্তি পরিত্যাগ করে নিজের চরিত্র শুধরে নেবেন, সেই সব নারীকে উপযুক্ত মর্যাদা সমাজকে দিতে হবে৷ পতিতাবৃত্তি সামাজিক–র্থনৈতিক ব্যবস্থার কুফল৷
জীবজগৎ যেমন মুখ্যতঃ দুই বিভাজনে বিভক্ত–যুথবদ্ধ ও এককজীবী, ঠিক তেমনি ঘর–সংসারের ব্যাপারেও জীবজগৎ দুই ভাগে বিভক্ত৷ এক ঃ ঘরকন্না করা সংসারী (যেমন হাতী, সিংহ, পায়রা প্রভৃতি) দুই ৪ স্বৈরী বা স্বীৈরিণী (যেমন বাঘ, কুকুর, ছাগল, বেহাল প্রভৃতি)৷
প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ–সমাজে নারীর স্থান ছিল অন্যান্য যে কোন জীবের স্বাধীন নারীর মতই৷ পুরুষেরা যেমন প্রকৃতির কোলে নেচে গেয়ে হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে দিত নারীরাও তা–ই করত৷ এই অবস্থা চলেছিল যখন মানুষ সমাজ বলতে কোন কিছুই গড়েনি তখন তো বটেই, তার পরেও মাতৃশাসনের যুগেও৷ কিন্তু যখনই পিতৃশাসিত সমাজ ব্যবস্থা এল তখনই নারীর অধিকার ক্রমশঃ সঙ্কুচিত করা হতে থাকল৷ গোড়ার দিকে ঠিক করা হ’ল মেয়েরা ততটুকু স্বাধীনতা ভোগ করবে যতটুকু বিবাহের পরে তার শ্বশুরকুল তাকে ভোগ করতে দেবে বা বিবাহের পূর্বে পিতৃকুল তাকে যে সুযোগটুকু দেবে৷
অধিকাংশ জীবের মত মানুষের সমাজেও নারীরা শারীরিক বিচারে পুরুষের চাইতে দুর্বল৷ স্নায়ুর দুর্বলতার জন্যে মনও তাদের কিছুটা দুর্বল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজের কাছে তাদের মূল্য পুরুষের চাইতে এক পাইও কম নয়৷ স্বার্থপর পুরুষ কিন্তু এই মূল্যবোধের অপেক্ষা না রেখে নারীর দুর্বলতার সুযোগটুকুই ষোল আনা নিয়েছে ও নিচ্ছে৷ মুখে মাতৃজাতি বলে’ ঘোষণা করলেও আসলে তাদের অবস্থাটা করে’ রেখেছে ঠিক গৃহপালিত গোরু–ভেড়ার মত৷ একথা খুবই সত্যি যে কতকগুলি বিশেষ ক্ষেত্রে যোগ্যতার অভাবের ফলেই নারীরা ধীরে ধীরে তার অধিকার বা স্বাধীনতা খুইয়ে বসেছে, আর এই জন্যেই যাঁরা বিশেষ বিশেষ কতকগুলি যোগ্যতাকেই অধিকার প্রাপ্তির একমাত্র চাবিকাঠি হিস
‘গন্ধর্ব’ শব্দটি যদি পুংলিঙ্গে ব্যবহূত হয় (গন্ধর্বঃ) তার মানে হয় গন্ধর্ব অর্থাৎ নৃত্যে গীতে বাদ্যে দক্ষ এক প্রকারের দেবযোনি যা’ তেজ, মরুৎ আর ব্যোম এই তিনটি তত্ত্বে তৈরী অর্থাৎ যাতে ক্ষিতি ও অপ্ তত্ত্ব নেই, আর ক্ষিতি ও অপ্ তত্ত্ব না থাকায় সাধারণভাবে তা’ পরিদৃশ্য নয়৷ গন্ধর্ব–প্রেষিত ধ্বনি, রাগাত্মিকা অভিব্যক্তি শ্রুতিগ্রাহ্য, অনুভব্য কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় দৃশ্য নয়৷ মনকে নিজের ক্ষিতি, অপ্ তত্ত্ব থেকে বিচ্যুত করে সম্পূর্ণতঃ ঔর্ধ্বদৈহিক ভাবে নিষিক্ত করতে পারলে তবেই তা’ মানসলোকে দৃশ্য৷
গন্ধর্ব একটি দেবযোনি যা’ কতকটা অপ্সরা পর্যায়ভুক্ত৷
এবার বলতে হয় পার্বতীর কথা৷ ‘পার্বতী’ শব্দটার মানে কী? কেউ হয়তো বলবেন ‘পর্বতস্য দুহিতা’, ‘পর্বতস্য কন্যা’ ইত্যর্থে পার্বতী (ষষ্ঠী তৎপুরুষ) অর্থাৎ পাহাড়ের মেয়ে৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, পঞ্চভূতাত্মক শরীরে কোন নারী কি পাহাড়ের মেয়ে হতে পারে? কোন নদীকে বরং পাহাড়ের মেয়ে বললেও বলতে পারি৷ কোন নারীকে পাহাড়ের মেয়ে বলতে পারি কি?
এই দশ লাখ বৎসরের মানুষের ইতিহাসে মানুষের প্রতি সুবিচার করা হয়নি৷ মানুষের একটি শ্রেণী, একটি বর্গের প্রতি বেশী বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, বেশী আদিখ্যেতা করা হয়েছে, ও তা, করতে গিয়ে অন্যকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে৷ একজন মানুষ লড়াই করল, মরল, আত্মদান দিল, কাগজে বড় করে তা ছেপে দেওয়া হ’ল, আর সে মরে যাওয়ার পর ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে নিয়ে তার বিধবা স্ত্রীকে কী ধরণের অসুবিধায় পড়তে হ’ল সেকথা খবরের কাগজে বড় করে ছাপানো হ’ল না অর্থাৎ একতরফা বিচার করে আসা হয়েছে৷ যদিও ব্যাকরণগত ব্যাপার, আর হঠাৎ বদলানো যায় না, তবু ‘ম্যান’ ‘man’ এই কমন জেণ্ডারের মধ্যে ‘ম্যান’, আর ‘ওম্যান’ •woman— দুই–ই এসে যায়৷ অথচ ‘ওম্যান’ এই কমন জেন্ডার
জীবজগৎ যেমন মুখ্যতঃ দুই বিভাজনে বিভক্ত–যুথবদ্ধ ও এককজীবী, ঠিক তেমনি ঘর–সংসারের ব্যাপারেও জীবজগৎ দুই ভাগে বিভক্ত৷ এক ঃ ঘরকন্না করা সংসারী (যেমন হাতী, সিংহ, পায়রা প্রভৃতি) দুই ৪ স্বৈরী বা স্বীৈরিণী (যেমন বাঘ, কুকুর, ছাগল, বেহাল প্রভৃতি)৷
রাঢ়ে যখন পৌরাণিক ধর্ম এল, সে একা আসেনি৷ সঙ্গে নিয়ে এল অজস্র সামাজিক ক্ষত, অজস্র সামাজিক আধি–ব্যাধি৷ প্রাচীনকাল থেকে অর্থাৎ এদেশে আর্যাগমনের সময় থেকে বর্ণ–বিভাজন ব্যবস্থা ভারতের অন্যান্য জায়গার মত রাঢ়েও এসেছিল – একথা আগেই বলেছি৷ কিন্তু বর্ণবৈষম্য মোটেই ছিল না৷ এমনকি এ জাতি, ও–জাতি বিবাহেও কেউ বড় একটা আপত্তি করতেন না৷ কিন্তু যখন পৌরাণিক ধর্ম রাঢ়ে এল, তখন রাঢ়ে পৌরাণিক ধর্মাবলম্বী রাজারা কিছুসংখ্যক গোঁড়া ব্রাহ্মণ ও গোঁড়া কায়স্থের সাহায্যে রাঢ়ের বুকে বর্ণবৈষম্যটা জগদ্দল পাথরের মত চাপিয়ে দিতে চাইলেন৷ ঢ়িলেঢ়ালা বর্ণ–ব্যবস্থাযুক্ত রাঢ় এটা ঠিকভাবে মেনে নিতে পারল না৷ সমাজে দেখা দিল নানান ধরণের বিশৃঙ্