পরম চৈতন্য সত্তা তথা ব্রহ্ম থেকে এই সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রকৃতি শক্তির সত্ত্ব,রজঃ ও তমঃগুণের প্রভাবে এই সৃষ্টি রচনা হয়েছে, এই সৃষ্টিতে প্রাণী ও অপ্রাণী রয়েছে৷ আমরা যাদের অপ্রাণী বলে মনে করি তারাই তো চেতনারই রূপান্তরিত যত রূপ৷ প্রতিসঞ্চর ধারায় এই জড় থেকে চেতনার বিকাশ হয়েছে, জড় ধীরে ধীরে এককোষী প্রাণী হয়ে তা বিকশিত হয়ে উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, পশুপাখী ও মানব হয়েছে৷ এই মানব শরীর পাওয়ার পেছনে কারণ পরম চৈতন্যের তথা ব্রহ্মের বিকাশ ঘটেছে এই মানব শরীরের মধ্যে৷ মানুষের কর্মৈষণার পিছনে রয়েছে তার মধ্যে অনেক বৃত্তি, বৃত্তিগুলিকে বলা হয় মনের পেশা৷ এই বৃত্তিগুলির মধ্যে কিছু বৃত্তি মানুষকে জড়ের দিকে নিয়ে যায়৷ এই যে মানুষের মধ্যে চৈতন্যের বিকাশ হয়েছে, এই চৈতন্যের বিকাশের জন্যে মানুষ বিচারশীল প্রাণী৷ কিন্তু বিচারশীলের মত ঠিক ঠিক কাজ করে চলে না৷ এর পিছনে কারণ হলো চৈতন্যের থেকে জড়বৃত্তি বা খারাপ বৃত্তির প্রভাবের জন্য৷ ওই খারাপ বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ তথা সংযম রাখার প্রয়াসই মানব জীবনের সাধনা৷ এই সাধনার দ্বারা মানুষ তার মধ্যে বিকশিত চৈতন্য সত্তার উপযোগ করে পরমপুরুষের পানে যেতে পারে ও যেতে যেতে সে পরমপুরুষে স্থিতিলাভ করে প্রশান্তি লাভ করতে পারে৷
এই সৃষ্টি কর্মে বিধৃত৷ মানুষকে কর্ম করতে হবে৷ যতক্ষণ তার শরীর আছে ততক্ষণ তাকে কর্ম করেই যেতেই হবেই৷ কিন্তু কর্মের মূলরূপ প্রারম্ভিক স্তর হলো ইচ্ছা৷ এইজন্যে ইচ্ছাকে মূলকর্ম বলা হয়, তবে কিছু কর্ম প্রত্যক্ষ ইচ্ছার ফলে হয়ে থাকে আর কিছু কর্ম অপ্রত্যক্ষ ইচ্ছার ফলে হয়ে থাকে৷ কর্ম আবার দু’ধরনের --- ১) প্রত্যয় মূলক কর্ম৷ মানুষের যে কর্মে তার স্বাধীনতা রয়েছে তা হলো প্রত্যয় মূলক কর্ম৷ যেমন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা হলে তা সেখানে যেতে পারে নাও পারে৷
২) দ্বিতীয় ধরণের কর্ম হলো সংস্কার মূলক কর্ম সে কর্মে মানুষের কোন স্বাধীনতা নেই৷ আগের জন্মে তোমার ইচ্ছার ফলে যে কর্ম করা হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ার ফল মানুষের অভুক্ত থেকে গেছে৷ এটা মানুষের পরোক্ষ ইচ্ছায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে সেই পরোক্ষ ইচ্ছা মানুষকে কাজ করিয়ে নেয়৷ তাই সেই সংস্কারমূলক কর্ম মানুষের প্রত্যক্ষ ইচ্ছানুসারে হয় না৷ আগের জন্মের প্রতিকর্মের সংস্কার ভোগের জন্যে মানুষকে বিবশ করে করিয়ে নেয়৷ কেউ এই জন্মে চুরি করে কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে শাস্তি পাচ্ছে৷ এ তার আগের জন্মের প্রতিকর্মের ফল হিসাবে ভোগ করছে৷ এখানে মানুষটির স্বাধীন ইচ্ছার কোন ভূমিকা নেই৷ প্রকৃতি তা তার আগের জন্মের প্রতিকর্মের ফল ভোগ করিয়ে ছাড়বে৷ সৎকর্মের জন্য মানুষকে পুন্যবাণ ও অসৎ কর্মের জন্য মানুষকে পাপী বলে থাকি৷ কিন্তু কর্মফল ভোগের পর মানুষকে পাপী বা পুণ্যবান কোনটাই বলা যায় না৷ প্রতিকর্মের বীজাত্মক রূপ থাকবেই, তুমি যদি কারও ক্ষতি কর তবে তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে হয় এজন্মে বা পরজন্মে তোমাকে ক্ষতি ভোগ করতে হবে৷
এখন কর্মের প্রতিক্রিয়া মানুষের বাসনা ভাণ্ডারে জমা হয়ে থাকে৷ এই বাসনাভাণ্ড পরিপক্ক হলে তবেই কর্মের ভোগ হয়ে থাকে৷ কর্ম জিনিসটাই সবর্দা বাসনার ওপর নির্ভর করে৷ বাসনা অনুযায়ী কর্মে সুফল ও কুফল নির্ধারিত হয়৷ মানুষের সামগ্রিক সুখানুভূতি তথা সামগ্রিক দুখঃানুভূতি থেকেই তার বাসনা জাগ্রত হয় অথবা সুখানুভূতি বা দুঃখানুভূতির সামগ্রিক বীজাত্মক সংস্কারের নামই বাসনা৷ মানুষ আপন আপন বাসনা অনুসারে নিজের কর্মধারা নির্ধারিত করে নেয়৷ মানুষ বাসনার অনুকূল বস্তুসমূহের প্রাপ্তির জন্যে কাজ করে৷ আর বাসনার প্রতিকূল বিষয়সমূহ থেকে সে দূরে থাকতে চায়৷ যেমন মানুষ সুস্বাদু খাদ্য খেতে চায়, দুঃখদায়ক সংবাদ সে শুনতে চায় না৷ বাসনাকে যদি ঘটের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে ঘটের মধ্যে যে জল তাকে প্রত্যয়মূলক কর্মে বলতে পারি আর এই বাসনারূপী ঘটে কর্মরূপী জল নিঃশেষ করে দেওয়ার নামই মুক্তি৷ আর বাসনারূপী ঘটের আকার প্রাপ্ত কর্মকে কর্মাশয় বলা হয়৷ সংস্কারমূলক কর্ম সমাধা হলেই এই কর্মাশয় ক্ষয় হতে থাকে৷ আবার এ জন্মের কর্মের প্রতিক্রিয়া আবার এ জন্মের কর্মের প্রতিক্রিয়া কর্মাশয়ে আবার জমা হতে থাকেএখন এই ভাবেই কী মানব জীবন চলতে থাকবে? ভালো কর্ম করলেও তাও ভোগ করার জন্যে জন্ম নিতে হবে৷ জন্মের পর জন্ম হতেই থাকবে একে বলা হয় ভবসাগর৷ তাতে মানুষের মুক্তির পথ কী?
এখন, মানুষের কর্ম ও প্রতি কর্মের ভোগ জন্ম জন্মান্তর চলতে থাকবে৷ এ জন্যে মানুষকে প্রতি কম? নিতে হবে অর্থাৎমধু বিদ্যার অনুশীলন করতে হবে তা অভিজ্ঞ আচার্যের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে৷ বাসনা ভাণ্ডার পুরুষ ভাবের দ্বারা অর্থাৎ ব্রহ্ম ভাবনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে ও আলোকে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে৷ এককালে বাসনা ভাণ্ডার স্থিত পুরাতত্রন কর্মাশয় হেতু সাধকের পূর্বকৃত কর্মের ফল ভোগ তাড়াতাড়ি হবে কিন্তু তার নোতুন কর্মাশয় পুরুষ বা ব্রহ্মভাবের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকবে৷ কাল ভবিষ্যতে বা ভবিষ্যতে জীবনে কর্মফল ভোগ হবে না৷ কারণ, তার পুরুষ ভাবাত্মক বা ব্রহ্মবাবাত্মক কর্মাশয় জৈবী হয়ে থাকার জন্যে৷
তাই মানুষকে ব্রাহ্মী ভাবে তার বাসনা ভাণ্ডারকে পূর্ণ করার কৌশল হ’ল যোগ সাধনার অনুশীলন৷ এই সাধনাকে সোজাসুজি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়৷ প্রথমতঃ মনকে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়কে বিচ্ছিন্ন করে ব্রহ্মভাবের দিকে নিয়ে যেতে হবে৷ ফলে কর্মাশয় ব্রহ্মভাব পূর্ণ হবে৷ দ্বিতীয়তঃ আসন, প্রাণায়ামের দ্বারা মনের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশঃ বাড়বে৷ এতে মানব শরীর ক্রমশঃ পবিত্র হবে, তবে এর সঙ্গে সঙ্গে সাত্ত্বিক খাদ্য খেতে হবে৷ সাত্ত্বিক আহার না করলে সাধনায় বাধা আসবে সাধনায় মন বলবে না৷ ঈশ্বর প্রণিধানে মন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরে উন্নীত হয়৷ আসন, যম, নিয়ম, প্রত্যাহার প্রাণায়াম, ধারণা ধ্যান সমাধি হলো আধ্যাত্মিক সাধনা৷ আমাদের ওইগুলির অনুশীসনের দ্বারা সাত্ত্বিক ভাব জাগাতে হবে৷ মনের অনেক কোষ আছে---কামময়, মনোময়, অতিমানস, বিজ্ঞানময়, হিরন্ময়৷ কোষগুলি সাধনার দ্বারা পাকা হয় এতে বাসনাভাণ্ড ভেঙ্গে যায় আর কর্মাশয় ব্রহ্মভাবাত্মক হয়ে পড়ায় পুনজন্মের সম্ভাবনা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়৷ তখন সাধক দগ্দ বীজ হয়ে যাবে৷ প্রত্যয়মূলক কর্মের প্রতিক্রিয়া আর হবে না, ধ্যান খুব বেশী করে অভ্যাস করতে হবে৷ দগ্দবীজে যেমন অঙ্কুর হয় না তেমনই দগ্দবীজ হয়ে গেলে আর পুণর্জন্ম হবে না৷ তবে এক্ষেত্রে দগ্দবীজ হয়ে গেলেও বাসনাভোগ তো থেকেই যায় সেই জন্য সাধনার তৃতীয় স্তরে এই বাসনাভাবকে বাসনাপুরুষের পদমূলে সমর্পণ করতে হবে৷ পরমপুরুষে লীন হবার কৌশল হ’ল, সব কিছু ভুলে যাওয়া---কেবল পরমপুরুষের ভাবনা নেওয়া৷একেই বলে পুরুষ খ্যাতি৷ আমার সবকিছুকে ‘কেবল তুমি’-তেরূপান্তরিত করতে হবে৷ এইটাই হ’ল সত্যিকারের মানব জীবন---এটাই পরমাগতি৷
আমরা পরমপিতার কাছ থেকে এসেছি, তাই তিনি কত না ব্যাকুল হয়ে রয়েছেন তাঁর সন্তানকে তাঁর কোলে নিয়ে চির শান্তিতে রাখার জন্যে৷ কিন্তু তাঁর কোলে যাবার জন্যে আমরা ব্যাকুল হচ্ছি না৷ আমরা তাঁর দিকে এক পা এগিয়ে গেলে তিনি শত পা এগিয়ে এসে আমাদের কোলে তুলে নেবেন৷ পরমপুরুষের কৃপাই সাধকের পরমপ্রাপ্তি৷ শেষ পর্যন্ত তাঁর কৃপা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই৷