৩১শে ডিসেম্বর (২০১৮) আনন্দনগরে পুরোধা প্রমুখের প্রবচনের সারাংশ

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

পরম চৈতন্য সত্তা  তথা  ব্রহ্ম  থেকে এই সৃষ্টি  হয়েছে৷ প্রকৃতি শক্তির  সত্ত্ব,রজঃ ও তমঃগুণের প্রভাবে  এই সৃষ্টি রচনা হয়েছে,  এই সৃষ্টিতে প্রাণী  ও অপ্রাণী রয়েছে৷ আমরা  যাদের  অপ্রাণী বলে মনে  করি  তারাই  তো চেতনারই রূপান্তরিত যত রূপ৷ প্রতিসঞ্চর  ধারায়  এই জড়  থেকে  চেতনার  বিকাশ  হয়েছে, জড় ধীরে ধীরে  এককোষী প্রাণী হয়ে তা  বিকশিত হয়ে  উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, পশুপাখী ও মানব হয়েছে৷ এই মানব শরীর পাওয়ার পেছনে  কারণ পরম চৈতন্যের  তথা  ব্রহ্মের  বিকাশ  ঘটেছে এই মানব  শরীরের  মধ্যে৷ মানুষের কর্মৈষণার  পিছনে  রয়েছে  তার  মধ্যে অনেক  বৃত্তি, বৃত্তিগুলিকে  বলা হয় মনের পেশা৷  এই বৃত্তিগুলির  মধ্যে  কিছু বৃত্তি  মানুষকে জড়ের দিকে  নিয়ে যায়৷ এই  যে মানুষের  মধ্যে  চৈতন্যের  বিকাশ  হয়েছে, এই চৈতন্যের  বিকাশের  জন্যে  মানুষ বিচারশীল  প্রাণী৷ কিন্তু বিচারশীলের  মত ঠিক ঠিক কাজ  করে চলে না৷  এর পিছনে  কারণ  হলো  চৈতন্যের  থেকে জড়বৃত্তি  বা খারাপ বৃত্তির প্রভাবের জন্য৷ ওই  খারাপ বৃত্তিগুলিকে  নিয়ন্ত্রণ তথা সংযম রাখার প্রয়াসই মানব জীবনের  সাধনা৷ এই সাধনার  দ্বারা  মানুষ   তার মধ্যে  বিকশিত  চৈতন্য  সত্তার  উপযোগ  করে পরমপুরুষের  পানে যেতে  পারে ও যেতে  যেতে সে পরমপুরুষে স্থিতিলাভ  করে প্রশান্তি  লাভ করতে  পারে৷ 

এই সৃষ্টি  কর্মে  বিধৃত৷ মানুষকে  কর্ম করতে হবে৷ যতক্ষণ তার শরীর আছে ততক্ষণ তাকে  কর্ম করেই যেতেই হবেই৷ কিন্তু  কর্মের  মূলরূপ  প্রারম্ভিক  স্তর  হলো  ইচ্ছা৷ এইজন্যে  ইচ্ছাকে  মূলকর্ম  বলা  হয়, তবে  কিছু কর্ম  প্রত্যক্ষ ইচ্ছার  ফলে হয়ে  থাকে  আর কিছু কর্ম অপ্রত্যক্ষ ইচ্ছার  ফলে হয়ে থাকে৷  কর্ম আবার  দু’ধরনের --- ১) প্রত্যয় মূলক কর্ম৷ মানুষের  যে  কর্মে   তার  স্বাধীনতা রয়েছে তা হলো  প্রত্যয় মূলক  কর্ম৷ যেমন  কোথাও যাওয়ার  ইচ্ছা হলে  তা সেখানে যেতে  পারে নাও পারে৷

২) দ্বিতীয় ধরণের কর্ম হলো  সংস্কার                  মূলক কর্ম সে  কর্মে  মানুষের  কোন  স্বাধীনতা নেই৷ আগের  জন্মে  তোমার ইচ্ছার  ফলে  যে কর্ম করা  হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ার ফল মানুষের  অভুক্ত  থেকে গেছে৷ এটা মানুষের  পরোক্ষ ইচ্ছায়  রূপান্তরিত হয়ে গেছে সেই পরোক্ষ ইচ্ছা মানুষকে  কাজ করিয়ে নেয়৷  তাই সেই  সংস্কারমূলক কর্ম  মানুষের  প্রত্যক্ষ ইচ্ছানুসারে  হয় না৷  আগের  জন্মের  প্রতিকর্মের  সংস্কার  ভোগের  জন্যে  মানুষকে  বিবশ  করে করিয়ে  নেয়৷  কেউ  এই জন্মে  চুরি  করে   কিন্তু পুলিশের  হাতে ধরা পড়ে  শাস্তি  পাচ্ছে৷  এ তার  আগের  জন্মের  প্রতিকর্মের  ফল  হিসাবে ভোগ করছে৷ এখানে  মানুষটির স্বাধীন ইচ্ছার  কোন ভূমিকা  নেই৷ প্রকৃতি  তা  তার আগের  জন্মের  প্রতিকর্মের ফল ভোগ করিয়ে ছাড়বে৷ সৎকর্মের  জন্য মানুষকে  পুন্যবাণ ও অসৎ কর্মের  জন্য মানুষকে  পাপী বলে থাকি৷ কিন্তু কর্মফল ভোগের পর  মানুষকে  পাপী বা পুণ্যবান  কোনটাই বলা যায় না৷ প্রতিকর্মের  বীজাত্মক  রূপ  থাকবেই, তুমি  যদি  কারও  ক্ষতি  কর তবে  তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে  হয়  এজন্মে বা পরজন্মে তোমাকে ক্ষতি ভোগ করতে  হবে৷

এখন  কর্মের  প্রতিক্রিয়া  মানুষের  বাসনা ভাণ্ডারে জমা হয়ে থাকে৷ এই বাসনাভাণ্ড পরিপক্ক হলে  তবেই  কর্মের  ভোগ হয়ে থাকে৷ কর্ম জিনিসটাই সবর্দা বাসনার ওপর নির্ভর করে৷ বাসনা অনুযায়ী কর্মে সুফল ও কুফল নির্ধারিত হয়৷ মানুষের সামগ্রিক সুখানুভূতি তথা সামগ্রিক দুখঃানুভূতি থেকেই তার বাসনা জাগ্রত হয় অথবা সুখানুভূতি বা দুঃখানুভূতির সামগ্রিক বীজাত্মক সংস্কারের নামই বাসনা৷ মানুষ আপন আপন বাসনা অনুসারে নিজের কর্মধারা নির্ধারিত করে নেয়৷ মানুষ বাসনার অনুকূল বস্তুসমূহের প্রাপ্তির জন্যে কাজ করে৷ আর বাসনার প্রতিকূল বিষয়সমূহ থেকে সে দূরে থাকতে চায়৷ যেমন মানুষ সুস্বাদু খাদ্য খেতে চায়, দুঃখদায়ক সংবাদ সে শুনতে চায় না৷ বাসনাকে যদি ঘটের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে ঘটের মধ্যে যে জল তাকে প্রত্যয়মূলক কর্মে বলতে পারি আর এই বাসনারূপী ঘটে কর্মরূপী জল নিঃশেষ করে দেওয়ার নামই মুক্তি৷ আর বাসনারূপী ঘটের আকার প্রাপ্ত কর্মকে কর্মাশয় বলা হয়৷ সংস্কারমূলক কর্ম সমাধা হলেই এই কর্মাশয় ক্ষয় হতে থাকে৷ আবার এ জন্মের কর্মের প্রতিক্রিয়া আবার এ জন্মের কর্মের প্রতিক্রিয়া কর্মাশয়ে আবার জমা হতে থাকেএখন এই ভাবেই কী মানব জীবন চলতে থাকবে? ভালো কর্ম করলেও তাও ভোগ করার জন্যে জন্ম নিতে হবে৷ জন্মের পর জন্ম হতেই থাকবে একে বলা হয় ভবসাগর৷ তাতে মানুষের মুক্তির পথ কী? 

এখন, মানুষের কর্ম ও প্রতি কর্মের ভোগ জন্ম জন্মান্তর চলতে থাকবে৷ এ জন্যে মানুষকে প্রতি কম? নিতে হবে অর্থাৎমধু বিদ্যার অনুশীলন করতে হবে তা অভিজ্ঞ আচার্যের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে৷ বাসনা ভাণ্ডার পুরুষ ভাবের দ্বারা অর্থাৎ ব্রহ্ম ভাবনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে ও আলোকে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে৷ এককালে বাসনা ভাণ্ডার স্থিত পুরাতত্রন কর্মাশয় হেতু সাধকের পূর্বকৃত কর্মের ফল ভোগ তাড়াতাড়ি হবে কিন্তু তার নোতুন কর্মাশয় পুরুষ বা ব্রহ্মভাবের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকবে৷ কাল ভবিষ্যতে বা ভবিষ্যতে জীবনে কর্মফল ভোগ হবে না৷ কারণ, তার পুরুষ ভাবাত্মক বা ব্রহ্মবাবাত্মক কর্মাশয় জৈবী হয়ে থাকার জন্যে৷

তাই মানুষকে ব্রাহ্মী ভাবে তার বাসনা ভাণ্ডারকে পূর্ণ করার কৌশল হ’ল যোগ সাধনার অনুশীলন৷ এই সাধনাকে সোজাসুজি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়৷ প্রথমতঃ মনকে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়কে বিচ্ছিন্ন করে ব্রহ্মভাবের দিকে নিয়ে যেতে হবে৷ ফলে কর্মাশয় ব্রহ্মভাব পূর্ণ হবে৷ দ্বিতীয়তঃ আসন, প্রাণায়ামের দ্বারা মনের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশঃ বাড়বে৷ এতে মানব শরীর ক্রমশঃ পবিত্র হবে, তবে এর সঙ্গে সঙ্গে সাত্ত্বিক খাদ্য খেতে হবে৷ সাত্ত্বিক আহার না করলে সাধনায় বাধা আসবে সাধনায় মন বলবে না৷  ঈশ্বর প্রণিধানে মন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরে উন্নীত হয়৷ আসন, যম, নিয়ম, প্রত্যাহার প্রাণায়াম, ধারণা ধ্যান সমাধি হলো আধ্যাত্মিক সাধনা৷ আমাদের ওইগুলির অনুশীসনের দ্বারা সাত্ত্বিক ভাব জাগাতে হবে৷ মনের অনেক কোষ আছে---কামময়, মনোময়, অতিমানস, বিজ্ঞানময়, হিরন্ময়৷ কোষগুলি সাধনার দ্বারা পাকা হয় এতে বাসনাভাণ্ড ভেঙ্গে যায় আর কর্মাশয় ব্রহ্মভাবাত্মক হয়ে পড়ায় পুনজন্মের সম্ভাবনা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়৷ তখন সাধক দগ্দ বীজ হয়ে যাবে৷ প্রত্যয়মূলক কর্মের প্রতিক্রিয়া আর হবে না, ধ্যান খুব বেশী করে অভ্যাস করতে হবে৷ দগ্দবীজে যেমন অঙ্কুর হয় না তেমনই দগ্দবীজ হয়ে গেলে আর পুণর্জন্ম হবে না৷ তবে এক্ষেত্রে দগ্দবীজ হয়ে গেলেও বাসনাভোগ তো থেকেই যায় সেই জন্য সাধনার তৃতীয় স্তরে এই বাসনাভাবকে বাসনাপুরুষের পদমূলে সমর্পণ করতে হবে৷ পরমপুরুষে লীন হবার কৌশল হ’ল, সব কিছু ভুলে যাওয়া---কেবল পরমপুরুষের ভাবনা নেওয়া৷একেই বলে পুরুষ খ্যাতি৷ আমার সবকিছুকে ‘কেবল তুমি’-তেরূপান্তরিত করতে হবে৷ এইটাই হ’ল সত্যিকারের মানব জীবন---এটাই পরমাগতি৷

আমরা পরমপিতার কাছ থেকে এসেছি, তাই তিনি কত না ব্যাকুল হয়ে রয়েছেন তাঁর সন্তানকে তাঁর কোলে নিয়ে চির শান্তিতে রাখার জন্যে৷ কিন্তু তাঁর কোলে যাবার জন্যে আমরা ব্যাকুল হচ্ছি না৷ আমরা তাঁর দিকে এক পা এগিয়ে গেলে তিনি শত পা এগিয়ে এসে আমাদের কোলে তুলে নেবেন৷ পরমপুরুষের কৃপাই সাধকের পরমপ্রাপ্তি৷ শেষ পর্যন্ত তাঁর কৃপা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই৷