বিলম্বিত বোধোহয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

৭৭ বছর হয়ে গেল দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা রেখে স্বাধীন দেশের জনগণের সরকার দেশের শাসন ভার হাতে নিয়েছে৷ এই ৭৭ বছরে আমরা কি পেলাম, কি হারালাম দেশের কি কল্যাণ হয়েছে তার হিসাব নিতে গেলে অনেকেই বলবেন কি দরকার অতীতের জাবর কেটে! বর্তমানের দুঃখ দুর্দ্দশা কিভাবে দূর হবে সেই পথ দেখান৷ লাভ বিশেষ না হলেও অতীতের জাবর কাটা একেবারে যে অমূলক তাও বলা যাবে না৷ সব আলোচনা সকল দেশবাসীর কাছে সন্তোষজনক নাও হতে পারে, তবে শুভ পরিণাম যদি কিছু থাকে তার ফল সকল দেশবাসীর জন্যে৷ মূল প্রশ্ণ ৭৭ বছরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা সার্থকরূপ পেয়েছে৷

ভারতবর্ষ জনগণতন্ত্রের দেশ৷ অর্থাৎ বিদেশী শাসককে বিদেয় করে দেশের শাসক নির্বাচনের ভার জনগণের উপর৷ গণতন্ত্রের সার কথা ‘‘জনগণের জন্যে জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার৷ ৭০ বছর পার করে এই প্রশ্ণ উঠতেই পারে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার কতটা সার্থক? আর্থিক বৈষম্য, সামাজিক, বিভেদ-বিদ্বেষ দল-উপদলের গোষ্ঠী কন্দল, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, রাজনৈতিক তঞ্চকতা ৭৭ বছরেদেশের পরতে পরতে দুর্নীতির আখড়া তৈরী করেছে৷ একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই ভারতবর্ষে শাসক-বিরোধী কোনপক্ষই জনগণের আস্থা ও সমর্থনের উপর নির্ভর করে না৷ কারণ ভারতবর্ষের রাজনীতি পরক্ষভাবে ও অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে দেশীয় পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে৷ তাই ভারতবর্ষে জনগণের জন্যে জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার অলীক কল্পনামাত্র৷ কারণ রাজনৈতিক দলগুলো পুঁজিপতিদের আর্থিক দানে চলে৷ এই সত্য আজ আর জনগণের ধারণা নয় নির্বাচনী বণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর৷

গণতন্ত্র সফল হবার অন্যতম শর্তগুলি হল---নৈতিকতা, শিক্ষার প্রসার ও জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সচেতনতা৷ তাছাড়া সার্থক গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষের জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন যথা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা থাকে ও প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমবৃদ্ধির ব্যবস্থা থাকবে৷ এগুলির কোনটাই সিংহভাগ জনগণ, সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের নেই৷ কারণ শাসক বিরোধী সবপক্ষকেই চলতে হয় ধনকুবেরদের মর্জিমত৷ তাই ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি চোখ ধাঁধানো শোষণমূলক ব্যবস্থা৷ এখানে শাসন ক্ষমতার চরম অপব্যবহার হয়৷ জনগণের সমর্থণের উপর নির্ভর না করে নানারকম ছল-চাতুরী ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায় প্রতিটি দল৷ একবার ক্ষমতা দখল করলে অবাধে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অত্যাচার চালাতে থাকে৷

ভারতীয় যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যে যদি কেন্দ্রীয় শাসকদলের পছন্দের দল ক্ষমতায় না থাকে তবে বঞ্চনা, অত্যাচার ও বৈষম্যমূলক আচরণের স্বীকার হতে হয় রাজ্যস্তরের শাসককে আর তার ফল ভোগ করতে হয় রাজ্যবাসীকে৷ গত দশবছরে পশ্চিমবঙ্গ সেই বঞ্চনা অবহেলা ও অত্যাচারের শিকার৷ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে কেন্দ্রীয় এজেন্সী দিয়ে নানাভাবে রাজ্যের শাসকদলকে হেনস্থা করা হচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক সচেতন রাজ্যে তাতেও বড় কোন সাফল্য কেন্দ্রীয় শাসকদল পায়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠাময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, রাজ্যের প্রাপ্য না দেওয়া গণতন্ত্রের ঘাতকদের কাজ৷

তবে দেরীতে হলেও কেন্দ্রীয় শাসকদলের রাজ্য শাখার সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বোধোদয় হয়েছে৷ সম্প্রতি লোকসভা ও চারটি বিধানসভা উপনির্বাচনে পরাস্ত হওয়ার পর তিনি কর্মীদের সামনে বলেছেন ইডি, সিবিআই, দিয়ে ভোটে জেতা যাবে না৷ ২০২১ থেকে ২৪ পর্যন্ত রাজ্য শাসকদলের একাধিক নেতা, মন্ত্রীদের জেলে পুরেও ভোটে জেতা যায়নি৷ তাই কেন্দ্রীয় শাসক দলের রাজ্য সভাপতি দলীয় কর্মীদের জনগণের দরবারে যেতে বলেছেন, দেরীতে হলেও রাজ্য সভাপতির যে বোধোদয় হয়েছে তা যদি আন্তরিক হয় ও দেশের সব নেতা নেত্রীদের মধ্যে প্রসারিত হয় তবেই গণতন্ত্র রাজনৈতিক ভাবে সার্থক হবে৷